খসড়া রপ্তানি নীতিতে নগদের বদলে গ্যাস–বিদ্যুতে ছাড়সহ যেসব প্রস্তাব
২০২৬ সালে বাংলাদেশ এলডিসি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর রপ্তানিতে নগদ সহায়তা থাকবে না। তাই বিকল্প সহায়তার পথ সন্ধান করছে সরকার।
দেশের পণ্য রপ্তানি খাত থেকে নগদ সহায়তা তুলে নেওয়া হলেও তার বদলে গ্যাস-বিদ্যুৎ, পানিসহ বিভিন্ন ধরনের সেবা মাশুলে রেয়াতি সুবিধা দেওয়া হবে। খসড়া রপ্তানি নীতিতে ২০২৪ থেকে আগামী ২০২৭ সাল পর্যন্ত তিন বছর রপ্তানিকারকদের এসব সুবিধা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সম্প্রতি খসড়া রপ্তানি নীতি প্রকাশ করেছে। তাতে ২০২৭ সালের মধ্যে রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১১০ বিলিয়ন বা ১১ হাজার কোটি মার্কিন ডলার।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বলছে, ২০২৬ সালে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বেরিয়ে যাবে। এর ফলে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে দেশের ভাবমূর্তি যেমন উজ্জ্বল হবে, তেমনি তৈরি হবে বিনিয়োগের সম্ভাবনাও। অন্যদিকে রপ্তানি ও অর্থনৈতিক খাতে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ দেখা দেবে। এলডিসি থেকে উত্তরণের পর উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের বাজারে শুল্ক ও কোটামুক্ত রপ্তানি সুবিধা হারাবে বাংলাদেশ। ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) বাজারে ১০ শতাংশ শুল্ক দিয়ে পণ্য রপ্তানি করতে হবে। এতে অন্যান্য দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংক গত জানুয়ারিতে সরকারের নির্দেশনায় রপ্তানিতে নগদ সহায়তা কমানোর প্রজ্ঞাপন জারি করে। তাতে প্রথম দফায় পণ্যভেদে সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ পর্যন্ত নগদ সহায়তা কমানো হয়। নগদ সহায়তার বদলে এখন রপ্তানিতে বিকল্প সুবিধা দেওয়ার চিন্তা করছে সরকার। এ জন্য খসড়া নীতিমালার অন্যতম লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে, রপ্তানিতে আর্থিক বা নগদ সহায়তার বদলে বিকল্প সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে ব্যবসা-বাণিজ্য ও রপ্তানি প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা। তারই অংশ হিসেবে রপ্তানি খাতসংশ্লিষ্ট শিল্পে বিভিন্ন পরিষেবার ক্ষেত্রে রেয়াতি সুবিধা প্রদানের প্রস্তাব করা হয়েছে।
রপ্তানি খাতকে নানা সুবিধা দিতে নতুন করে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তত্ত্বাবধানে রপ্তানি উৎসাহিতকরণ তহবিল (ইপিএফ) গঠনের কথা বলা হয়েছে। এ তহবিল থেকে রপ্তানিকারকেরা পণ্য উৎপাদনে কম সুদে ও সহজ শর্তে ঋণ, বিদেশে বিক্রয়কেন্দ্র বা ওয়্যারহাউস স্থাপন, বাজার উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ, তরল বর্জ্য পরিশোধনাগার (ইটিপি) এবং পরিবেশবান্ধব কারখানা নির্মাণে সহায়তা পাবেন।
বিভিন্ন পরিষেবার ক্ষেত্রে রেয়াতি হারে সুবিধা দেওয়ার বিষয়ে যে কথা বলা হয়েছে, তা বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) বিধিবিধানের সঙ্গে যেন সাংঘর্ষিক না হয়, সেটি নিশ্চিত করতে হবে।
খসড়া নীতিতে বলা হয়েছে, রপ্তানিকারকদের নগদ সহায়তার বদলে বিদ্যুৎ-পানি-গ্যাস ও ডিজেল-ফার্নেস অয়েল ইত্যাদি সেবার ক্ষেত্রে রেয়াতি হারে সুবিধা বা ভর্তুকি দেওয়া যায় কি না, তা পরীক্ষা করে দেখা হবে। দেশের প্রধান প্রধান রপ্তানি পণ্য উৎপাদনকারী শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোকে বিদ্যুৎ বিলে ৫ থেকে ১০ শতাংশ রেয়াতি সুবিধা দেওয়ার প্রস্তাব রাখা হয়েছে। এ ছাড়া সব ধরনের লাইসেন্সিং ফি মওকুফ, মূলধনি ও খুচরা যন্ত্রাংশ আমদানিতে রপ্তানিকারকদের জন্য শুল্কহার হবে ১ শতাংশ।
নতুন নীতিমালার খসড়ায় বলা হয়েছে, রপ্তানি বাড়ানোর লক্ষ্যে রাশিয়াসহ সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নভুক্ত দেশসমূহ, মিয়ানমার, ইরান ও ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর সঙ্গে ব্যাংকিং লেনদেনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। সেই সঙ্গে রপ্তানিমুখী শিল্পপ্রতিষ্ঠানের উৎপাদিত পণ্যের ২০ শতাংশ শুল্ক-কর পরিশোধ সাপেক্ষে স্থানীয় বাজারে বাজারজাতকরণের সুবিধা দেওয়া হবে।
বর্তমানে রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে অনুমোদন ছাড়া স্থানীয় বাজারে পণ্য বিপণনের কোনো সুযোগ নেই। একাধিক রপ্তানিকারক জানান, রপ্তানির ক্ষেত্রে স্থানীয় বাজার থেকে কোনো কাঁচামাল কেনা হলে তার বিপরীতে শুল্ক-কর ছাড়ের সুবিধা পাওয়া যায়। যেহেতু রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো এ ছাড় সুবিধা নিয়ে থাকে, সেহেতু তাদের উৎপাদিত পণ্য স্থানীয় বাজারে বিক্রির সুযোগ নেই। তবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) অনুমতি নিয়ে কেউ চাইলে স্থানীয় বাজারে পণ্য বাজারজাত করতে পারে।
খসড়া নীতিমালা অনুযায়ী, যেসব প্রতিষ্ঠান তাদের উৎপাদিত পণ্যের ৮০ শতাংশ রপ্তানি করে, তারা রপ্তানিমুখী শিল্প হিসেবে বিবেচিত হবে। সে ক্ষেত্রে শুল্ক-কর পরিশোধ করে উৎপাদিত বাকি ২০ শতাংশ পণ্য স্থানীয় বাজারে বিক্রি করা যাবে।
খসড়া রপ্তানি নীতির নানা পদক্ষেপ সম্পর্কে জানতে চাইলে নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সাবেক সভাপতি ফজলুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের দেশে নীতিমালা খুব সুন্দর হয়। সেখানে নানা সুবিধার কথা বলা থাকে। কিন্তু প্রায়োগিক ক্ষেত্রে গিয়ে দেখা যায়, এসব নীতিমালার অনেক কিছুই পাওয়া যায় না। কারণ, নীতিমালা কোনো আইন নয়। ফলে এটি বাস্তবায়নের আইনি বাধ্যবাধকতা থাকে না। এ জন্য এক মন্ত্রণালয়ের নীতিমালা বাস্তবায়নে অন্য মন্ত্রণালয় বা বিভাগ আগ্রহ দেখায় না।
এদিকে খসড়া নীতির বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের মতামত সংগ্রহ করছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। আজ ২ মার্চ শনিবারের মধ্যে সব পক্ষকে খসড়া নীতির ওপর মতামত দিতে বলা হয়েছে। এরপর মতামতের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় সংযোজন-বিয়োজন করে নীতিমালাটি চূড়ান্ত করা হবে।
খসড়া নীতিমালায় রপ্তানি খাতে প্রণোদনার জন্য নানা পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। এসব পদক্ষেপের বিষয়ে জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘নগদ সহায়তার বদলে রপ্তানির ক্ষেত্রে বিকল্প বিভিন্ন সুবিধা প্রদানের কথা বলা হয়েছে। এটা রপ্তানি খাতের জন্য ইতিবাচক দিক। বিভিন্ন পরিষেবার ক্ষেত্রে রেয়াতি হারে সুবিধা দেওয়ার বিষয়ে যে কথা বলা হয়েছে, তা বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) বিধিবিধানের সঙ্গে যেন সাংঘর্ষিক না হয়, সেটি নিশ্চিত করতে হবে। তবে আমি মনে করি, এলডিসি থেকে উত্তরণের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে সবার আগে রপ্তানি পণ্যের বহুমুখীকরণ ও নতুন নতুন বাজার সৃষ্টিতে জোর দিতে হবে।’