পাবনার রূপপুরে ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াটের দুটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের কাজ চলছে
ফাইল ছবি

যুদ্ধের কারণে রাশিয়া থেকে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের অর্থ আসা কমে গেছে। আবার এ প্রকল্পের যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য বাংলাদেশ থেকে রাশিয়ায় অর্থ পাঠানোও বন্ধ রয়েছে। এ অবস্থায় তৃতীয় দেশের মাধ্যমে অর্থ আদান-প্রদান স্বাভাবিক করতে কাজ করছে দুই দেশ।

রাশিয়ার সঙ্গে এ প্রকল্পের অর্থ লেনদেনে জড়িত দেশের একাধিক ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, যুদ্ধ শুরুর পর রাশিয়ার আর্থিক লেনদেনের ক্ষেত্রে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা ও আন্তর্জাতিক লেনদেনব্যবস্থা সুইফট থেকে রাশিয়ার ব্যাংকগুলোকে বের করে দেওয়ার কারণে এ সমস্যা তৈরি হয়েছে।

পাবনার রূপপুরে ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াটের দুটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করছে সরকার। এ বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ১ হাজার ৩০০ কোটি মার্কিন ডলার। প্রতি ডলারের বিনিময়মূল্য ১০৫ টাকা ধরে হিসাব করলে দেশীয় মুদ্রায় যার পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ১ লাখ ৩৭ হাজার কোটি টাকা। দেশে প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে সিংহভাগ অর্থায়ন করছে রাশিয়া। দেশটি এ প্রকল্পে ঋণ দিচ্ছে ১ হাজার ১৩৮ কোটি ডলার।

রাশিয়া সরাসরি অর্থ পাঠাতে পারছে না। আগে অন্য দেশের ব্যাংকের মাধ্যমে এ দেশে অর্থ পাঠাত। এখন সেসব দেশের ব্যাংকগুলোও ঝুঁকির কারণে রাশিয়ার অর্থ নিচ্ছে না।
এস এম পারভেজ তমাল, চেয়ারম্যান, এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক

গত আগস্ট পর্যন্ত ঋণের ৪৯৭ কোটি ডলার ছাড় করা হয়েছে। বাকি আছে ৬৪১ কোটি ডলার। এ প্রকল্পের মেয়াদ ২০১৬ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত। তবে ২০২৪ সালে এ কেন্দ্র থেকে বাণিজ্যিকভাবে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরুর কথা রয়েছে।

রূপপুর প্রকল্পে রাশিয়ার পরমাণু শক্তি করপোরেশন রোসাটমের নেতৃত্বে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করছে এটমস্ট্রয়এক্সপোর্ট। আর কাজটি ভাগ করে দেওয়া হয়েছে বিভিন্ন দেশের ২২টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছে। তাতে প্রকল্পটির ঋণের টাকার একটি বড় অংশ যাচ্ছে এই প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে।

আরও পড়ুন

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য উচ্চক্ষমতার চুল্লি দেবে রাশিয়া

বেসরকারি খাতের এনআরবি কমার্শিয়াল (এনআরবিসি) ব্যাংকের মাধ্যমে রাশিয়া থেকে পাঁচ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের অর্থ আসত। গত আগস্টে ব্যাংকটিতে রাশিয়া থেকে এসেছে মাত্র ২ লাখ ২০ হাজার ডলার। অথচ জুলাইয়ে এসেছিল ৬০ লাখ ৩০ হাজার ডলার, জুনে প্রায় ৪ কোটি ১০ লাখ ডলার।

এ বিষয়ে এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের চেয়ারম্যান এস এম পারভেজ তমাল প্রথম আলোকে বলেন, রাশিয়া সরাসরি অর্থ পাঠাতে পারছে না। আগে অন্য দেশের ব্যাংকের মাধ্যমে এ দেশে অর্থ পাঠাত। এখন সেসব দেশের ব্যাংকগুলোও ঝুঁকির কারণে রাশিয়ার অর্থ নিচ্ছে না। তাই এখন রাশিয়া থেকে অর্থ আসাসহ সবকিছু নির্ভর করছে বৈশ্বিক পরিস্থিতির ওপর।

‘যেহেতু ঋণের কিস্তি পরিশোধের জন্য বিকল্প দেশের মাধ্যমে লেনদেনের প্রস্তাব এসেছে, তাই অর্থ আসাতেও এমন উপায় বের হবে। রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকলেও ভারত, চীন দেশটির সঙ্গে ব্যবসা করছে। লেনদেনেও তাদের কোনো সমস্যা হচ্ছে না। তাহলে বাংলাদেশেরও কোনো সমস্যা হবে না।’
জাহিদ হোসেন, বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ

বেসরকারি খাতের প্রিমিয়ার ব্যাংকের মাধ্যমে রাশিয়া থেকে চার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের অর্থ আসত। গত জুনে ব্যাংকটিতে এ প্রকল্পের জন্য রাশিয়া থেকে এসেছে ১ কোটি ৮০ লাখ ডলার। জুলাইয়ে এসেছিল ২ কোটি ডলার। আর আগস্টে এসেছে ১ কোটি ২০ লাখ ডলার।

প্রিমিয়ার ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম রিয়াজুল করিম প্রথম আলোকে বলেন, অন্য দেশ হয়ে রূপপুর প্রকল্পের জন্য রাশিয়া থেকে অর্থ এখনো আসছে। তবে অর্থ আসা আগের চেয়ে কমে গেছে।

একইভাবে বেসরকারি খাতের দি সিটি ব্যাংক, ট্রাস্ট ব্যাংকসহ আরও কয়েকটি ব্যাংকের মাধ্যমে অর্থ আসাও কমে গেছে।

অর্থ আসা কমে গেলেও প্রকল্পটির কাজে এখন পর্যন্ত কোনো সমস্যা হচ্ছে না। এ বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, প্রকল্পটির খরচের বড় অংশ ব্যয় হচ্ছে যন্ত্রপাতি কেনাকাটার পেছনে—এসব যন্ত্রপাতি রাশিয়া থেকে আসছে। তাই অর্থ আসা কমে গেলেও তাতে কোনো সমস্যা হচ্ছে না।

রাশিয়া গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে হামলা শুরু করে। এরপর পশ্চিমা দেশগুলো একজোট হয়ে রাশিয়ার ওপর নানামুখী নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। তারই অংশ হিসেবে আন্তর্জাতিক পর্যায়ের লেনদেনব্যবস্থা সুইফট থেকে রাশিয়ার ব্যাংকগুলোকে বের করে দেওয়া হয়। এরপর থেকেই কমে গেছে অর্থ আসা। আবার প্রকল্পের বিভিন্ন কেনাকাটা বাবদ বাংলাদেশের পক্ষ থেকে রাশিয়ায় অর্থ পাঠানোও বন্ধ হয়ে গেছে। এদিকে রূপপুর প্রকল্পে রাশিয়ার দেওয়া ঋণের সুদ ও আসল দেশটির নিজস্ব মুদ্রা রুবলে পরিশোধের জন্য এরই মধ্যে বাংলাদেশ সরকারকে চিঠি দিয়েছে রাশিয়া।

অর্থ পাঠানোও বন্ধ

রূপপুর প্রকল্পে সরকার যে অর্থ খরচ করে, তার বড় অংশই লেনদেন হয় সোনালী ব্যাংকের মাধ্যমে। সরকারের এই খরচের একটি বড় অংশ কেনাকাটা বাবদ রাশিয়ায় পাঠানো হতো। রাশিয়ার যে ব্যাংকের মাধ্যমে বাংলাদেশের সোনালী ব্যাংক এই প্রকল্পের অর্থ লেনদেন করে, নিষেধাজ্ঞার মধ্যে থাকায় সেই রুশ ব্যাংকটি তাদের সঙ্গে লেনদেন থেকে বিরত থাকতে বলেছে বাংলাদেশকে। ব্যাংকটির নাম ব্যাংক ফর ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড ফরেন ইকোনমিক অ্যাফেয়ার্স (ভিইবি)।

সোনালী ব্যাংক সূত্র জানা যায়, রূপপুর প্রকল্পের জন্য আর রাশিয়ায় অর্থ পাঠানোর প্রয়োজন হবে না। কারণ, রাশিয়ার ব্যাংকের নামে সোনালী ব্যাংকে হিসাব খোলা হয়েছে। সেই হিসাবেই বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে অর্থ জমা করে দেওয়া হয়েছে।

রাশিয়ার ঋণের শর্ত অনুযায়ী, ২০২৬ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশকে শুধু সুদ এবং এরপর থেকে সুদ ও আসল বছর বছর কিস্তিতে পরিশোধ করতে হবে।

আলোচনা বিকল্প ব্যাংকিং নিয়ে

রাশিয়ার সঙ্গে এখন বিকল্প লেনদেনমাধ্যম নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। এ নিয়ে রাশিয়ার সঙ্গে অনলাইনে নিয়মিত সভা করছে সরকারের বিভিন্ন পক্ষ। রাশিয়া চায়, বাংলাদেশ তৃতীয় কোনো দেশের মাধ্যমে ঋণের সুদ ও আসল পরিশোধ করুক। আর তৃতীয় দেশটি হবে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞামুক্ত। আবার তৃতীয় দেশের মাধ্যমে যে মুদ্রায় লেনদেন হবে, সেটি হতে হবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফের রিজার্ভ মুদ্রা (স্পেশাল ড্রয়িং রাইটস বা এসডিআর)।

আইএমএফের রিজার্ভ মুদ্রা তালিকায় এখন মার্কিন ডলার, যুক্তরাজ্যের পাউন্ড স্টার্লিং, ইউরো, জাপানি ইয়েন ও চীনের ইউয়ান রয়েছে। ব্যাংকার ও অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ চীনের মাধ্যমে লেনদেন করতে পারে। চীনে অবস্থিত ব্যাংকে ইউয়ান মুদ্রায় লেনদেন করা যায়, এমন হিসাব রয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের।

রাশিয়ার প্রস্তাব অনুযায়ী, প্রথমে বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাঠানো হবে চীনে। সে ক্ষেত্রে ডলার ইউয়ানে পরিবর্তিত হয়ে জমা হবে রাশিয়ার হিসাবে। পরে চীন ইউয়ানকে রুবলে পরিবর্তন করে তা রাশিয়ায় পাঠাবে।

জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘যেহেতু ঋণের কিস্তি পরিশোধের জন্য বিকল্প দেশের মাধ্যমে লেনদেনের প্রস্তাব এসেছে, তাই অর্থ আসাতেও এমন উপায় বের হবে। রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকলেও ভারত, চীন দেশটির সঙ্গে ব্যবসা করছে। লেনদেনেও তাদের কোনো সমস্যা হচ্ছে না। তাহলে বাংলাদেশেরও কোনো সমস্যা হবে না।’