সংকটের কথা জানা ছিল, কোনো উদ্যোগ ছিল না

গ্যাসের সরবরাহ নিশ্চিত হলে বাজারে চিনির সরবরাহ বাড়বে বলে আশ্বাস দিয়েছেন মিলমালিকেরা।

ফাইল ছবি: প্রথম আলো

ডলারের অস্থিরতায় ঋণপত্র খোলায় জটিলতা, জ্বালানিসংকটসহ নানা কারণে উৎপাদন কমে বাজারে চিনির সংকট হতে পারে সরকারকে এমন কথা জানিয়েছিল বাংলাদেশ সুগার রিফাইনার্স অ্যাসোসিয়েশন। চলতি মাসের ২০ তারিখে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব বরাবর দেওয়া ওই চিঠি দেওয়া হয়। এর মধ্যেই তেতে ওঠে দেশের চিনির বাজার। প্রতি কেজি খোলা চিনি ১১০ টাকা পর্যন্ত কিনতে হয়েছে। যেখানে খোলা চিনির সরকার–নির্ধারিত মূল্য প্রতি কেজি ৯০ টাকা।

এখন চিনির বাজারের অস্থিরতা কমাতে মাঠে নেমেছে জাতীয় ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তর। সংস্থাটি গতকাল সোমবার চিনির বাজার–সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে এক মতবিনিময় করেছে। সেখানে মিলমালিকদের প্রতিনিধিরা আশ্বাস দিয়েছেন দ্রুতই বাজারে চিনির সরবরাহ বাড়বে। তাতে চিনির বাজারের অস্থিরতা কেটে যাবে। মিলমালিকের প্রতিনিধিরা আশার কথা শোনালেও নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানিপ্রাপ্তির নিশ্চয়তা চেয়েছে। উচ্চ চাপের গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত হলে উৎপাদন বাড়বে। তখনই কেবল সরবরাহের সংকট কাটতে পারে বলে জানিয়েছেন তাঁরা।

২০ অক্টোবর সরকারকে চিনিসংকটের বিষয়ে সতর্ক করে বাণিজ্যসচিব বরাবর মিলমালিকদের দেওয়া চিঠিতে বলা হয়, ‘অত্যন্ত দুঃখ ও চিন্তার বিষয় এই যে, ২০২২ সালে অর্থাৎ এই বছরে এখন পর্যন্ত প্রায় ১৮ লাখ টন অপরিশোধিত চিনি আমদানি হয়েছে। বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দরে ১টি অপরিশোধিত চিনির জাহাজ রয়েছে। তবে রপ্তানিকারক দেশ ব্রাজিল থেকে বাংলাদেশে আসার মতো কোনো জাহাজ লাইনআপে (অপেক্ষমাণ) নাই।’

বাংলাদেশ সুগার রিফাইনার্স অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব গোলাম রহমানের স্বাক্ষর করা ওই চিঠিতে চিনিশিল্প রক্ষার জন্য কিছু দাবি জানানো হয়। এর মধ্যে রয়েছে অপরিশোধিত চিনির ওপর শুল্ক প্রত্যাহার করা, ডলারপ্রাপ্তি নিশ্চিত করা, ব্যাংকে বিধিনিষেধ ছাড়া ঋণপত্র খোলার অনুমতি দেওয়া, ঋণপত্রের ঋণ পরিশোধের সময় এক বছর করা ও নিরবচ্ছিন্নভাবে কারখানায় গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করা।

এদিকে চিনির বাজারের বর্তমান পরিস্থিতির ওপর সরকারকে একটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। সংস্থাটির মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান স্বাক্ষরিত ওই প্রতিবেদনে চিনি উৎপাদনকারী মিলগুলোতে পর্যাপ্ত গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে সুপারিশ করা হয়েছে।

দেশব্যাপী বাজার অভিযান ও মিলগুলো পরিদর্শন করে দেওয়া প্রতিবেদনটিতে মিলগুলোর কিছু অনিয়মের চিত্র উঠে এসেছে। যেমন মেঘনা সুগার রিফাইনারির সরবরাহ আদেশে মূল্য উল্লেখ ছিল না। সিটির সুগার ইন্ডাস্ট্রিজের সরবরাহ আদেশে ইউনিট মূল্য লেখা হয়নি। প্রতিষ্ঠানটি তার সক্ষমতার ৫০ শতাংশ চিনি উৎপাদন করছে। এস আলম সুগার রিফাইনারিতে ৫০ কেজির বস্তায় ২০০ থেকে ২৮০ গ্রাম চিনি কম পাওয়া যায়।

বেশি অনিয়মের চিত্র উঠে এসেছে দেশবন্ধু সুগার মিলে। প্রতিষ্ঠানটির একাধিক সরবরাহ আদেশের মেয়াদ শেষ হওয়ার ১০ থেকে ১২ দিন পরও চিনি সরবরাহ করা হয়েছে। পাকা রসিদে পণ্যের একক মূল্য লেখা নেই। মিলগেটে কোনো মূল্যতালিকা প্রদর্শন করা হয় না। অন্য চিনি কারখানায় জ্বালানিসংকট থাকলেও এখানে সেই সমস্যা নেই। তবে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের করা আরেকটি প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, দেশবন্ধু গ্রুপের এই প্রতিষ্ঠানের কাছে অপরিশোধিত চিনির মজুত আছে মাত্র ৪ হাজার ৪০০ টন।

বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে বর্তমান মজুত ও আমদানি অপেক্ষমাণ চিনি বিবেচনায় সরবরাহে সমস্যা নেই। মিলের অপরিশোধিত চিনির মজুত দিয়ে আরও ৩৫ থেকে ৪০ দিন চলবে। যে পরিমাণ চিনি আমদানি অপেক্ষমাণ আছে, তা দিয়ে আগামী তিন মাস চলতে সমস্যা হবে না। তবে ২০২১ সালের এপ্রিল থেকে আগস্ট মাসের তুলনায় চলতি ২০২২ সালের একই সময়ে দেশে চিনি আমদানি কম হয়েছে ১৯ হাজার ২১১ টন।

ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মতবিনিময় সভায় চিনি পরিশোধন কারখানার প্রতিনিধিরা বলেন, সামগ্রিকভাবে বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম বেড়েছে। জাহাজের পরিবহন ব্যয় ও ঋণপত্রের ডলার বাবদও অতিরিক্ত অর্থ গুনতে হচ্ছে। এতে পণ্যের মূল্য একেক সময় একেক রকম হচ্ছে। এ জন্য সরকারের প্রতি ১৫ দিন পর দাম সমন্বয়ের বিষয়ে আহ্বান জানানো হয়। এ ছাড়া চিনির শুল্ককাঠামো সংস্কারের প্রস্তাবও দেন তাঁরা।

দেশবন্ধু গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক গোলাম রহমান বলেন, ‘চিনি নেই—এমনটা বলা যাবে না, অপরিশোধিত চিনি আছে। আমরা পরিশোধনের পর প্রয়োজনমতো চিনি সরবরাহের চেষ্টাও করে যাচ্ছি। তবে গ্যাস-সংকটের কারণে চিনির কয়েকটি কারখানা পুরোদমে চালানো যাচ্ছে না। এ জন্য বাজারে প্রভাব পড়েছে।’ তবে পরস্পরকে দোষারোপের সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে এসে বাজারের সংকটের দায় সবারই নেওয়া উচিত। কোনো এক পক্ষের ওপর বিষয়টি না চাপিয়ে একসঙ্গে কাজ করলে দ্রুত সংকটের সমাধান হবে বলেও মনে করেন তিনি।

সভায় বিভিন্ন বাজার থেকে আসা পাইকারি ব্যবসায়ী ও পরিবেশকেরা অভিযোগ করে বলেন, মিলগুলোর কাছে বারবার চিনি চেয়েও তাঁরা পাচ্ছেন না। অন্যদিকে মিল ফটকে গাড়ি বসিয়ে রাখায় ভাড়া টাকা গুনতে হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন তাঁরা। চিনি কেনার ক্ষেত্রে মিলগুলো পাকা রসিদ দিতে অনীহা দেখাচ্ছে এবং অনেক ক্ষেত্রে রসিদে পণ্যমূল্য না লিখে বাড়তি দামে বিক্রি করছে, এমন অভিযোগও করেন পাইকারি ব্যবসায়ীরা।

কারওয়ান বাজারের চিনি পরিবেশক আবু বকর সিদ্দিক বলেন, ‘মিল থেকে চিনি না দেওয়ায়, বাইরে থেকে বেশি দামে চিনি কিনতে হচ্ছে। এদিকে পাউরুটি, বিস্কুট বা কেক তৈরির প্রতিষ্ঠানগুলো আমাদের বলছে, “চিনি দিন, না হলে আমাদের কারখানা বন্ধ হয়ে যাবে।” চিনি না পাওয়ায় সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।’

সভায় ভোক্তা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেন, ‘সরকার শুল্ক হ্রাস করলে দাম কমে আসবে, এমন কথা দিতে পারলে অবশ্যই সরকার সেটি বিবেচনার নেবে। তবে আপাতত আমাদের প্রত্যাশা মিলের ফটকে দাঁড়িয়ে থাকা ট্রাকগুলো ভরে বাজারে চিনি পাঠানো শুরু করবেন।’

এদিকে চিনির বাজার পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) রাজধানীর ১১টি স্থানে ভর্তুকি মূল্যে চিনি বিক্রি শুরু করেছে। গতকাল দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া ও বৃষ্টির মধ্যে সাধারণ মানুষকে লাইনে দাঁড়িয়ে সাশ্রয়ী মূল্যে চিনি কিনতে দেখা গেছে। বিশেষ এই চিনি বিক্রি কর্মসূচি উন্মুক্ত। টিসিবির পরিবার কার্ডধারীদের পাশাপাশি যে কেউ ৫৫ টাকা কেজি দরে এই চিনি কিনতে পারবেন। তবে এক দফায় পাবেন মাত্র ১ কেজি।