পণ্যের দাম বাড়ছে যে কারণে 

ডলারের দাম ছয় মাসে ২২ শতাংশ বেড়েছে। তাতে একই দামে পণ্য আমদানিতে আগের চেয়ে শুল্ক–কর বেশি পড়ছে। এতে পণ্যের দাম বাড়ছে।

চট্টগ্রাম বন্দরের জাহাজ থেকে আমদানি পণ্যবাহী কনটেইনার নামানো হচ্ছে। ডলারের দর বেড়ে যাওয়ায় আমদানি ব্যয় অনেকটা বেড়ে গেছে। এতে সৃষ্টি হয়েছে ডলার–সংকট। সাম্প্রতিক ছবি
জুয়েল শীল

জুন মাসে দেশে যেসব চিনি বাজারজাত হয়, তার কাঁচামাল আনা হয় বিশ্ববাজার থেকে। টনপ্রতি দাম পড়ে ৪৪৮ ডলার। তখন প্রতি কেজিতে গড়ে ১৯ টাকা শুল্ক–কর পরিশোধ করেছেন আমদানিকারকেরা।

কিন্তু চলতি নভেম্বর মাসে বাজারজাত হওয়া চিনির কাঁচামালে টনপ্রতি দাম পড়েছে ৪৪৫ ডলার। কম দামে কেনার পরও প্রতি কেজি চিনিতে জুন মাসের তুলনায় ছয় টাকা বাড়তি শুল্ক–কর দিতে হচ্ছে। এতে প্রতি কেজি চিনিতে শুল্ক–কর বেড়ে দাঁড়াচ্ছে ২৫ টাকা। কোনো চালানে অবশ্য এই করভার আরও চার টাকা বেশি, অর্থাৎ কেজিপ্রতি ২৯ টাকা পড়ছে। সে ক্ষেত্রে আমদানিকারককে কেজিপ্রতি বাড়তি শুল্ক–কর দিতে হচ্ছে ১০ টাকা।  

চিনিতে শুল্ক–কর বাড়ানো হয়নি, মার্কিন ডলারের বিনিময়মূল্য বাড়ানো হয়েছে। যেমন জুন মাসে প্রতি ডলারের বিনিময়মূল্য ছিল ৮৬ টাকা ৭৩ পয়সা। এরপর দফায় দফায় ডলারের দাম বাড়ানো হয়েছে। এই নভেম্বরে এসে ডলারের দাম বাড়িয়ে ১০৬ টাকা ১৭ পয়সায় নির্ধারণ করা হয়। ছয় মাসে প্রতি ডলারের দাম মোট ১৯ টাকা ৪৪ পয়সা বাড়ানো হয়েছে। এ দাম ধরেই কাস্টমস বিভাগ আমদানি পণ্যের ওপর শুল্ক–কর নির্ধারণ করে টাকায়। এতে পণ্যের করভার বেড়ে যাচ্ছে। যে কারণে কম দামে পণ্য কেনার পরও রাজস্ব বেশি দিতে হচ্ছে ব্যবসায়ীদের।

ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর মার্চ থেকে মে মাস পর্যন্ত আন্তর্জাতিক বাজারে নিত্যপণ্যের দাম যেভাবে চূড়ায় উঠেছিল, এখন সে অবস্থা নেই। কয়েকটি বাদ দিলে বেশির ভাগ পণ্যের দামই কমে এসেছে।

আমদানিকারকেরা বলছেন, চিনির মতো যেসব ভোগ্যপণ্যে করভার রয়েছে, সেগুলোর প্রতিটিতে এখন আগের তুলনায় শুল্ক–কর বেশি দিতে হচ্ছে। কোম্পানিগুলো আপাতত এ বাড়তি শুল্ক–কর পরিশোধ করলেও তা কিন্তু আখেরে আদায় হবে ক্রেতাদের কাছ থেকে। চিনির মতো সয়াবিন তেল ও পাম তেলের দাম বাড়ারও বড় কারণ হচ্ছে ডলারের উচ্চ দামজনিত শুল্ক–কর।

বাজার ব্যবস্থাপনায় নজরদারি বাড়ানো উচিত, যাতে আমদানি ব্যয়ের সঙ্গে বাজারমূল্যের পার্থক্য খুব বেশি না হয়।
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম, গবেষণা পরিচালক, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ 

পণ্যের দাম বাড়ার আরও যত কারণ

জুন মাসের পর পণ্যের দাম বাড়ার বড় কারণ ছিল বেশি দামে ডলার কিনে পণ্য আমদানি। সেই মাসের তুলনায় এখন প্রতি কেজি নিত্যপণ্যে ক্রেতাদের ৭ থেকে ৩০ টাকা পর্যন্ত বাড়তি খরচ হচ্ছে। জুন মাসের তুলনায় এখন প্রতি কেজি চিনি ও গমে ৮ টাকা, মসুর ডালে ১৮ টাকা, সয়াবিন তেলে ৩০ টাকা বাড়তি খরচ হচ্ছে।

বেশি দামে ডলার কিনে কাঁচামাল আমদানির ঋণপত্র (এলসি) খোলার পর শুল্ক–কর বেশি পড়ছে। এরপর সেই কাঁচামাল যখন পণ্য উৎপাদনের জন্য কারখানায় নেওয়া হচ্ছে, তখন আরেক দফা বাড়তি খরচ যোগ হচ্ছে। কারণ, গ্যাস–বিদ্যুৎ–সংকটে কারখানা চালু রাখতে না পারায় কোম্পানিগুলোর উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া জ্বালানির দাম বাড়ায় পরিবহন খরচ বেড়েও পণ্যমূল্যের দাম বৃদ্ধি পায়।

আলাপকালে কয়েকজন আমদানিকারক প্রথম আলোকে জানান, ডলার–সংকটের কারণে ঋণপত্র খুলতে এখন তাঁরা হিমশিম খাচ্ছেন। কাঠখড় পুড়িয়ে যাঁরা ঋণপত্র খুলতে পারছেন, তাঁদের বাড়তি কমিশন দিতে হচ্ছে। ঋণপত্র খোলার জন্য বিদেশি ব্যাংকের কনফার্মেশন (নিশ্চিতকরণ) পাওয়ার খরচও এখন আগের তুলনায় দু–তিন গুণ বেশি।

জানতে চাইলে টি কে গ্রুপের পরিচালক মো. শফিউল আথহার তাছলিম প্রথম আলোকে বলেন, রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের পর বিশ্ববাবাজারে নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে রেকর্ড হয়েছিল। এরপর জুন–জুলাই থেকে কমে এখন আবার অনেক পণ্যের দাম কিছুটা বেড়েছে। তবে এটা ঠিক, ঋণপত্র খোলায় বাড়তি কমিশন থেকে শুরু করে নিত্যপণ্য বাজারজাত করা পর্যন্ত প্রতিটি ধাপেই খরচ বেড়েছে। তিনি বলেন, ‘ডলারের বিনিময়মূল্য বেড়ে করভার বেড়েছে। আগের তুলনায় ২২ শতাংশ বেশি দামে ডলার কিনতে হচ্ছে। উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার কারণেও খরচ বেড়েছে। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় পরিবহন খরচও বৃদ্ধি পেয়েছে।’ 

ডলারের বিনিময়মূল্য বেড়ে করভার বেড়েছে। আগের তুলনায় ২২ শতাংশ বেশি দামে ডলার কিনতে হচ্ছে। উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার কারণেও খরচ বেড়েছে। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় পরিবহন খরচও বেড়েছে।
মো. শফিউল আথহার তাছলিম, পরিচালক, টি কে গ্রুপ 

দেশে আমদানি কমেছে

ঋণপত্র খোলার হার কমে আসায় খাদ্যশস্য ও চিনি আমদানি কমে গেছে। তবে সয়াবিন ও পাম তেল, মসুর ও মটর ডালের আমদানি এখনো গত বছরের তুলনায় বেশি। ডলার–সংকটের কারণে আমদানি কমে বাজার অস্থিতিশীল হচ্ছে।

চিনির উদাহরণ দেওয়া যাক। চলতি ২০২২–২৩ অর্থবছরের প্রথম সাড়ে চার মাসে বন্দর দিয়ে অপরিশোধিত চিনি আমদানি হয়েছে ৩ লাখ ৩৬ হাজার টন, যা গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৭ লাখ ৯২ হাজার টন। অর্থাৎ এক বছরে আমদানি কমেছে ৫৮ শতাংশ। 

এদিকে আমদানির পাশাপাশি বাজারে চিনি সরবরাহের পরিমাণও কমেছে। চারটি পরিশোধন কারখানা চলতি অর্থবছরের প্রথম সাড়ে চার মাসে ৭ লাখ ৩৮ হাজার টন পরিশোধিত চিনি সরবরাহ করেছে। গত অর্থবছরে একই সময়ে এ পরিমাণ ছিল সোয়া ৯ লাখ টন। এক বছরে বাজারে চিনি সরবরাহ কমেছে ২০ শতাংশ।

রাশিয়া–ইউক্রেনের বাজার খোলায় গত এক মাসে দেশে সরকারি–বেসরকারি খাতে খাদ্যশস্য আমদানি কিছুটা বাড়লেও তা এখনো গত বছরের তুলনায় কম। যেমন চলতি ২০২২–২৩ অর্থবছরের সাড়ে চার মাসে গম আমদানি হয়েছে সাড়ে ১৪ লাখ টন। গত অর্থবছরের একই সময়ে আমদানি হয়েছিল ২৪ লাখ ২২ হাজার টন। অর্থাৎ এক বছরে গম আমদানি কমেছে ৪০ শতাংশ।

চালের আমদানিও কমেছে। সাড়ে চার মাসে চাল আমদানি হয়েছে সাড়ে পাঁচ লাখ টন। গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল সাড়ে ছয় লাখ টন। 

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) বাংলাদেশে আটার দাম বাড়ার জন্য বিশ্ববাজারকে দায়ী করেনি। চলতি মাসে সংস্থাটির খাদ্যমূল্য প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অক্টোবরে বাংলাদেশে গমের আটার দাম বেড়ে নতুন রেকর্ড হয়েছে। আমদানিতে ধীরগতি এবং জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি পেয়ে পরিবহন খরচ বেড়ে যাওয়াকেই দায়ী করেছে সংস্থাটি। 

করণীয় কী

দেশে নিত্যপণ্যের বাজারের অবস্থা জানিয়ে মতামত জানতে চাইলে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম প্রথম আলোকে বলেন, আন্তর্জাতিক বাজার কিছুটা স্থিতিশীলতার দিকে যাচ্ছে। সে তুলনায় ডলারের বিনিময়মূল্য বেড়ে দেশে আমদানি ব্যয় বাড়ছে। এ পরিস্থিতিতে খাদ্যনিরাপত্তার বিষয়টি সামনে রেখে জরুরি খাদ্যপণ্যের আমদানি ও সরবরাহ যাতে ঠিক থাকে, সেটাকে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত। কারণ, বর্তমান পরিস্থিতিতে স্বাভাবিক সময়ের মতো পণ্য সরবরাহ, চাহিদা পূরণ ও আমদানি ব্যয় মেটানোর ক্ষেত্রে রাশ টানার সময় এসেছে। আবার বাজার ব্যবস্থাপনায় নজরদারি বাড়ানো উচিত, যাতে আমদানিব্যয়ের সঙ্গে বাজারমূল্যের পার্থক্য খুব বেশি না হয়।