শীত আসার আগেই বেড়েছে প্রসাধনী বেচাকেনা

তাপমাত্রা কমে আসায় দোকানে লোশন, ক্রিম, গ্লিসারিন, লিপজেল ও অলিভ অয়েল তুলেছেন দোকানি। গতকাল ঢাকার কারওয়ান বাজারে
প্রথম আলো

অক্টোবরে সারা দেশে সর্বনিম্ন গড় তাপমাত্রা ছিল ২৩ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস, এই তথ্য আবহাওয়া অধিদপ্তরের। সংস্থাটির মতে, মাসের শেষ দিনে গত মঙ্গলবার সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তবে দু-এক জায়গায় তাপমাত্রা আরও কমে ১৬–তেও নেমেছিল। রাজধানীতে সাধারণত নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে শীত বোঝা যায়। এবারে অক্টোবরেই, মানে হেমন্তের শুরুতে শীত শীত ভাব শুরু হয়েছে। ফলে শীতে ব্যবহার্য বিভিন্ন প্রসাধন পণ্যের বিক্রি জমে উঠেছে।

সম্প্রতি ঢাকার নিউমার্কেট, গাউছিয়া, ইস্টার্ন মল্লিকা ও বসুন্ধরা শপিং কমপ্লেক্স ঘুরে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাপমাত্রা নেমে আসার ফলে লোশন, ক্রিম, গ্লিসারিন, লিপজেল ও অলিভ অয়েল (জলাপাইয়ের তেল) প্রভৃতি পণ্যের চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে। বাজারে ইতিমধ্যে নামীদামি প্রায় সব ব্র্যান্ডের শীতের নতুন প্রসাধনী চলে এসেছে। গত বছরের মজুতও আছে।

এবার শীতের প্রসাধনীর বেচাকেনা একটু আগেভাগে শুরু হয়েছে উল্লেখ করে ইউনিলিভার বাংলাদেশের বিপণন ব্যবস্থাপক (ত্বকের যত্ন) জিশান রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রাথমিক বেচাকেনা ভালো হওয়ায় আমরা আত্মবিশ্বাস পাচ্ছি। বোঝা যাচ্ছে, এবার শীতকালে বাজারটা বেশ বাড়বে।’

উত্তরবঙ্গের দিনাজপুর শহরে গত মঙ্গলবার সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ১৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যা আবহাওয়া অধিদপ্তরের প্রত্যাশিত সর্বনিম্ন গড় তাপমাত্রার চেয়ে সাড়ে ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস কম। তাপমাত্রা কমার ফলে দিনাজপুরের বাজারে প্রসাধনী বেচাকেনা বেড়েছে। শহরের মালদহপট্টির স্বপ্ন প্রসাধনীর স্বত্বাধিকারী আমির হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, এক সপ্তাহ ধরে শীতের প্রসাধনী বিক্রি বাড়ছে। তবে চাহিদা বেশি লোশনজাতীয় পণ্যের।

দিনাজপুরের ব্যবসায়ীরা বলেন, প্রতিবছর সাধারণত শীত শুরু হওয়ার অন্তত ২০ থেকে ২৫ দিন আগে থেকে কোম্পানিগুলো বাজারে শীতের প্রসাধনী দিয়ে যায়। এবারও তারা আগেভাগে পণ্য দিয়ে গেছে। কারণ, পুরোনো মজুতের প্রসাধনী অনেকে নিতে চান না। তাতে মৌসুমের শুরুতে যে কোম্পানির প্রসাধনী আগে আসে, সেটার বিক্রি বেশি হয়।

দিনাজপুরের মালদহপট্টিতে লোশন কিনতে আসা তৃষ্ণা রায় বলেন, ‘দিনের বেলা গরম থাকলেও মাঝরাত থেকে ভালোই শীত অনুভূত হচ্ছে। আপাতত লোশন কিনেছি। দাম একটু বেশি মনে হলো।’

স্কয়ার টয়লেট্রিজের প্রধান বিপণন কর্মকর্তা জেসমিন জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘ক্রেতাদের ক্রয়ক্ষমতার কথা বিবেচনা করে মেরিল ব্র্যান্ডের কোনো পণ্যের দাম এ বছর বাড়ানো হয়নি; বরং ১২০ গ্রামের মেরিল গ্লিসারিনের দাম কমেছে ২৫ টাকা।’

কোম্পানিগুলো বলছে, গতবার শীতের প্রসাধনীর দাম বাড়লেও এবার বাড়েনি। কারণ, গত বছর বিশ্ববাজারে কাঁচামালের দাম বেশি ছিল। তবে এমন কথাও শোনা যায়, বিশ্ববাজারে কাঁচামালের দাম যেভাবে কমেছে, সেভাবে দেশের বাজারে প্রসাধন পণ্যের দাম সমন্বয় হয়নি।

দেশীয় পণ্যের দাম না বাড়লেও ডলারের দাম বেশি থাকায় এবার আমদানি করা শীতের প্রসাধনী বাড়তি দামে কিনতে হবে ক্রেতাদের। দেশের প্রসাধনীর চাহিদার একটা অংশ বিদেশ থেকে আমদানি করে পূরণ করা হয়। অবশ্য অতিরিক্ত দামের কারণে আমদানি করা পণ্য সাধারণ ক্রেতাদের নাগালের বাইরে রয়েছে। এগুলোর দাম দেশি পণ্যের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি। এ খাতে দেশীয় নতুন বিনিয়োগ আসছে। দেশে তৈরি পণ্যের বাজারও বাড়ছে।

দেশের প্রসাধনী খাতে নতুন বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান রিমার্ক এইচবির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আশরাফুল আম্বিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘দেশে গুণগত মানের পণ্য উৎপাদন করতে পারলে আমদানিনির্ভরতা কমবে। তাতে ডলার সাশ্রয় হবে, কর্মসংস্থানও বাড়বে। আমরা নিওর ব্র্যান্ডের শীতের প্রসাধনী নিয়ে এসেছি বাজারে। এগুলোর চাহিদা ভালো।’

লাইট ক্যাসেল পার্টনারস ও অ্যালাইড মার্কেট রিসার্চের মতো গবেষণা সংস্থাগুলোর ভাষ্যমতে, ২০২০ সালে দেশে প্রসাধন পণ্যের বাজার ছিল ১২৩ কোটি মার্কিন ডলারের, যা বেড়ে ২০২৭ সালের মধ্যে ২১২ কোটি ডলারে উন্নীত হবে। ২০২১ থেকে ২০২৭ সাল পর্যন্ত এই বাজার ৮ দশমিক ১ শতাংশ হারে বাড়বে বলে জানায় গবেষণা সংস্থা দুটি। দেশে এ খাতে সুপ্রতিষ্ঠিত কোম্পানিগুলো হচ্ছে ইউনিলিভার, স্কয়ার, কোহিনূর কেমিক্যালস, কেয়া, কিউট ও রিমার্ক এইচবি প্রভৃতি।

অ্যাসোসিয়েশন অব স্কিন কেয়ার অ্যান্ড বিউটি প্রোডাক্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স । তিনি বলেন, বিদেশি পণ্যের নামে বাজারে ভেজাল অনেক পণ্য বিক্রি হয়। এর চেয়ে দেশি কোম্পানির পণ্য ব্যবহার করাই ভালো।
বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক জামাল উদ্দিন.

লোশন-ক্রিমের দরদাম যেমন

দেশে শীতের প্রসাধন পণ্যগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় ক্রিম ও লোশন। এ ছাড়া এই সময়ে অনেকে গ্লিসারিনও ব্যবহার করে থাকেন। আর সাম্প্রতিক বছরগুলোয় অলিভ অয়েলের ব্যবহারও বেড়েছে। ঠোঁটের যত্ন নেওয়ার জন্য বাজারে আছে লিপজেল।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশীয় ব্র্যান্ডগুলো মধ্যে একটি ৪০০ গ্রামের লোশন ৪৫০ থেকে ৫১০ টাকা এবং ১২০ গ্রাম গ্লিসারিন ৯০ থেকে ১২০ টাকা দামে বিক্রি হয়। একটি ১০০ মিলিগ্রামের দেশীয় ক্রিমের দাম ৮০ থেকে ১১০ টাকা। এ ছাড়া একটি দেশীয় লিপজেলের দাম ৩০ থেকে ৭০ টাকা পর্যন্ত।

তবে আমদানি করা কিছু প্রসাধন পণ্য দেশীয় ব্র্যান্ডের চেয়ে দ্বিগুণ দামে বিক্রি হচ্ছে। আবার কোনো কোনোটির দাম রীতিমতো কয়েক গুণ বেশি। যেমন দেশি ব্র্যান্ডের ৪০০ গ্রামের একটি লোশন কমবেশি ৫০০ টাকায় পাওয়া যায়। কিন্তু আমদানি করা লোশনের বিভিন্ন ব্র্যান্ডের দাম ৯০০ থেকে ১০০০ টাকা। এদিকে দেশীয় ১০০ মিলিগ্রামের ক্রিম ১০০ টাকার আশপাশে বিক্রি হলেও বিদেশি কোনো ব্র্যান্ডের সমপরিমাণ ক্রিম কিনতে হলে তার দাম দিতে হবে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা। বিদেশি লিপজেল কিনতে চাইলে দেশীয় ব্র্যান্ডের চেয়ে ১০০ থেকে ৩০০ টাকা বেশি গুনতে হবে।

দেশের বাজারে আমদানি করা পণ্যের নামে অবশ্য ভেজাল পণ্যের ছড়াছড়ি থাকে বলে অভিযোগ রয়েছে। গত বছরের নভেম্বরে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে একটি চিঠির মাধ্যমে জানানো হয়, দেশের প্রসাধনীর বাজারে ছয়টি অনিয়ম রয়েছে।

ভেজাল রুখতে সাধারণ মানুষের সচেতনতাও জরুরি বলে মনে করেন অ্যাসোসিয়েশন অব স্কিন কেয়ার অ্যান্ড বিউটি প্রোডাক্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক জামাল উদ্দিন। তিনি বলেন, বিদেশি পণ্যের নামে বাজারে ভেজাল অনেক পণ্য বিক্রি হয়। এর চেয়ে দেশি কোম্পানির পণ্য ব্যবহার করাই ভালো।

[প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহায়তা করেছেন প্রতিনিধি, দিনাজপুর।]