দারিদ্র্য কমেছে, বৈষম্য বেড়েছে

গত ছয় বছরে দেশের দারিদ্র্যের হার আরও কমেছে। এখন সার্বিক দারিদ্র্যের হার ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ। ছয় বছর আগে অর্থাৎ ২০১৬ সালে এ হার ছিল ২৪ দশমিক ৩ শতাংশ। তবে দারিদ্র্য কমার গতি কমেছে, বৈষম্যও বেড়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) গতকাল বুধবার খানার আয় ও ব্যয় জরিপ ২০২২–এর প্রাথমিক ফলাফল প্রকাশ করেছে। জরিপের ফলাফল প্রকাশ উপলক্ষে আগারগাঁওয়ের বিবিএস মিলনায়তনে এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানে জরিপের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন বিবিএসের উপপরিচালক এবং খানার আয় ও ব্যয় জরিপ প্রকল্পের পরিচালক মহিউদ্দিন আহমেদ। প্রধান অতিথি ছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান।

বিবিএসের জরিপ অনুযায়ী, দেশে এখন অতি দারিদ্র্যের হার ৫ দশমিক ৬ শতাংশ। ছয় বছর আগে যা ছিল ১২ দশমিক ৯ শতাংশ। শহরের চেয়ে গ্রামে দারিদ্র্য বেশি। গ্রামে এখন দারিদ্র্যের হার সাড়ে ২০ শতাংশ, শহরে এই হার ১৪ দশমিক ৭ শতাংশ। এ সময়ে বছরে গড়ে দশমিক ৯৩ শতাংশীয় পয়েন্ট হারে দারিদ্র্য কমেছে। এর আগের ছয় বছরে অর্থাৎ ২০১০ থেকে ২০১৬ সালে প্রতিবছর গড়ে ১ দশমিক ৩ শতাংশীয় পয়েন্ট হারে দারিদ্র্য কমেছিল। অর্থাৎ দারিদ্র্য কমার গতি কমে গেছে।

অন্যদিকে মানুষের মধ্যে আয়বৈষম্য আগের চেয়ে বেড়েছে। বিবিএসের তথ্য-উপাত্ত অনুযায়ী, ২০২২ সাল শেষে গিনি সহগ বেড়ে দাঁড়িয়েছে দশমিক ৪৯৯ পয়েন্ট। ২০১৬ সালে গিনি সহগ ছিল দশমিক ৪৮২ পয়েন্ট। সাধারণত দশমিক ৫০০ হলেই একটি দেশকে উচ্চ আয়বৈষম্যের দেশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সে দিক থেকে অতি সামান্য দূরে আছে বাংলাদেশ।

বিবিএসের অনুষ্ঠানে উপস্থিত পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান এবং পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম দুজনেই এই বৈষম্য বৃদ্ধির কথা স্বীকার করেছেন। তাঁরা বলেছেন, উন্নয়নের এক পর্যায়ে বৈষম্য বৃদ্ধি পায়, পরে তা কমে আসে।

পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, ‘কোভিড ও ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্যে অর্থনীতি ভালো চলেছে, দারিদ্র্য কমেছে। এটা আমাদের জন্য বিরাট অর্জন। কোভিডের সময়ে ঝুঁকি নিয়ে অনেক সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছি। আমরা পুরোপুরি লকডাউন দিইনি। কলকারখানা খোলা ছিল, চলাচল পুরোপুরি বন্ধ হয়নি। বড় প্রণোদনার মাধ্যমে প্রায় ১০০ কোটি ডলার অর্থনীতিতে জোগান দেওয়া হয়েছে, যা রক্তের মতো সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়েছে।’ তিনি আরও বলেন, একটি বর্ধনশীল অর্থনীতিতে প্রথম দিকে বৈষম্য বাড়ে।

অন্যদিকে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলমের মতে, বৈষম্য খুব বাড়েনি। দশমিকের পরে একটা সংখ্যা বসেছে মাত্র। বৈষম্য পরিস্থিতি স্থিতিশীল অবস্থায় আছে।

এবারের খানা আয় ও ব্যয় জরিপে সারা দেশের ১৪ হাজার ৪০০ পরিবারের তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। ২০২২ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বছরব্যাপী তথ্য সংগ্রহ করা হয়। খানার আয় ও ব্যয় জরিপে শুধু দারিদ্র্য পরিস্থিতিই তুলে ধরা হয় না। ওই জরিপে পরিবারের আয়, খাবারের ধরন, ক্যালরি গ্রহণ, জীবনযাত্রায় খরচ—এসব চিত্র উঠে এসেছে।

মৌলিক চাহিদা পূরণের খরচ ধরে দারিদ্র্য পরিমাপ করে বিবিএস। একজন মানুষের দৈনিক গড়ে ২১২২ ক্যালরি খাদ্যগুণসম্পন্ন খাবার কিনতে এবং খাদ্যবহির্ভূত যত খরচ মেটাতে যত টাকা প্রয়োজন হয়, ওই টাকা আয় করতে না পারলেই ওই ব্যক্তিকে দরিদ্র হিসেবে ধরা হয়। তবে খাবারের দাম এলাকাভেদে ভিন্ন হয়।

অনুষ্ঠানে পুরো প্রতিবেদনের ওপর বক্তব্য দেন বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক বিনায়ক সেন। তিনি বলেন, চরম দরিদ্র বা নিঃস্ব পরিবারের সংখ্যা দিন দিন নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে। এখন এমন দরিদ্র পরিবার খুঁজে পাওয়া যায় না। প্রতিবেদনে উঠে আসা অতি দারিদ্র্যের হার ৫ দশমিক ৬ শতাংশকে যৌক্তিক বলে মনে করেন তিনি। তিনি আরও বলেন, এ দেশে গরিবেরা ধনী হওয়ার চেষ্টা করছে। বিনায়ক সেন আরও বলেন, আয়বৈষম্য বেড়েছে, এটা ঠিক। কিন্তু এ দেশে যাদের মূলধন পাওয়ার সুবিধা আছে, তারা দ্রুত তাদের অবস্থার পরিবর্তন করে উঠে যাচ্ছে। এ কারণেও হয়তো বৈষম্য বাড়ছে।

জনপ্রতি মাসে আয় ৭,৬১৪ টাকা

একজন মানুষের মাসিক আয় কত এবং একটি পরিবারে মাসিক আয়-ব্যয় কত, তা সর্বশেষ খানার আয় ও ব্যয় জরিপে উঠে এসেছে। সেখানে দেখা গেছে, একজন মানুষের মাসিক গড় আয় ৭ হাজার ৬১৪ টাকা। এর মধ্যে শহরের একজন মানুষের মাসিক গড় আয় ১০ হাজার ৯৫১ টাকা। আর গ্রামের মানুষের আয় অর্ধেকের কাছাকাছি, ৬ হাজার ৯১ টাকা।

এবার দেখা যাক, একটি পরিবারের মাসিক আয় কত, ব্যয় কত। বিবিএস বলছে, বাংলাদেশে একটি খানা বা পরিবারের গড় সদস্যসংখ্যা ৪ দশমিক ২৬। ওই পরিবারের মাসিক আয় ৩২ হাজার ৪২২ টাকা। মাসে খরচ হয় গড়ে সাড়ে ৩১ হাজার টাকা। খাবারের পেছনে প্রতি মাসে গড়ে ১৪ হাজার ৩ টাকা খরচ করে একটি পরিবার। মোট আয়ের তুলনায় খাবারের পেছনে খরচ দিন দিন কমছে। ছয় বছর আগে খাবারের পেছনে আয়ের ৪৮ শতাংশের মতো খরচ হতো, খাদ্যবহির্ভূত খাতে ৫২ শতাংশ খরচ হতো। এই হার এখন বেড়ে খাদ্যবহির্ভূত পণ্যে আয়ের প্রায় ৫৫ শতাংশ খরচ হয়, বাকি ৪৫ শতাংশ খরচ হয় খাবারের পেছনে।

শহরের পরিবারগুলোর গড় আয় মাসিকের খরচের তুলনায় বেশি। শহরের একটি পরিবারের গড় আয় ৪৫ হাজার ৭৫৭ টাকা; আর খরচ ৪১ হাজার ৪২৪ টাকা। কিন্তু গ্রামের চিত্র ভিন্ন। গ্রামের একটি পরিবারের মাসিক গড় আয় ২৬ হাজার ১৬৩ টাকা। গড়ে খরচ হয় ২৬ হাজার ৮৪২ টাকা। অর্থাৎ গ্রামে আয়ের চেয়ে খরচ বেশি। শহর-গ্রাম নির্বিশেষে ছয় বছরের ব্যবধানে মাসিক আয় ও খরচ—দুই–ই দ্বিগুণ হয়েছে।

ক্যালরি গ্রহণ বেড়েছে

ছয় বছরের ব্যবধানে দেশের মানুষের দৈনিক গড় ক্যালরি গ্রহণ বেড়েছে। বিবিএসের সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী, দেশের মানুষ দৈনিক গড় ২৩৯৩ ক্যালরি খাবার গ্রহণ করে। চাল, ডাল, গম, শাকসবজি, মাছ, মাংস, ডিম, দুধ ও ফলমূল থেকেই সাধারণত এই ক্যালরি আসে। ছয় বছর আগে ২০১৬ সালে দেশের মানুষ গড়ে দৈনিক ২২১০ ক্যালরি খাবার গ্রহণ করত।

আলোচনা

পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম বলেন, গ্রামগঞ্জে অনেক রাস্তাঘাট হয়েছে, যা মানুষের আয় বাড়াতে সহায়তা করেছে। গত ১২ বছরে মাথাপিছু আয় তিন গুণ বেড়েছে। যারা উন্নয়ন নেতিবাচকভাবে দেখে, তারা পরাজিত হবে।

উন্নত দেশের মানুষ ক্যালরি বেশি গ্রহণ করে, বাংলাদেশে কম—এমন প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হলে শামসুল আলম বলেন, ‘ওই সব দেশের লোকজন বাটার খায়, শ্যাম্পেন খায়। এসব খাবারে ক্যালরি বেশি। আমাদের দেশের সংস্কৃতি অনুসারে এসব খাবার কখনো যোগ হবে না।’

পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সচিব শাহনাজ আরেফিন বলেন, ‘সত্য ও নিরপেক্ষ তথ্য দিয়ে আমরা সরকারকে নীতি প্রণয়নে সহায়তা করি। সঠিক তথ্য–উপাত্ত দিয়ে নীতি গ্রহণ করলে দেশ এগিয়ে যাবে।’

বিবিএসের মহাপরিচালক মতিয়ার রহমান বলেন, আয় বাড়লে মানুষ মৌলিক চাহিদা পূরণে খাবারের পাশাপাশি অন্য খাতে খরচ বাড়ায়। গত তিনটি খানার আয় ও ব্যয় জরিপে দেখা গেছে, খাবার খরচের চেয়ে খাদ্যবহির্ভূত খাতে খরচ বেশি।

অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য কাউসার আহাম্মদ, বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের অর্থনীতিবিদ জিয়ামেনা ভি ডেল কার্পিও, পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের যুগ্ম সচিব দীপংকর রায় প্রমুখ।