মেট্রোরেলে নতুন আশা মিরপুরে 

মেট্রোরেলের নির্মাণকাজ শেষ হয়ে আসায় পুরোনো ব্যবসায়ীদের অনেকে নতুন করে বিক্রয়কেন্দ্র সাজিয়েছেন। 

ফাইল ছবি

রাজধানীর উত্তরা থেকে মিরপুর হয়ে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেলের নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০১৭ সালে। এরপর বেহাল সড়ক, ধুলাবালু, যানজট ও জলাবদ্ধতা মিলিয়ে কয়েক মাস আগপর্যন্তও মিরপুর এলাকা ছিল অনেকের কাছে দুর্ভোগের অপর নাম। জনদুর্ভোগের পাশাপাশি ধস নেমেছিল এই এলাকার ব্যবসা-বাণিজ্যেও। পাঁচ বছরের বেশি সময় পরে ২৮ ডিসেম্বর চালু হতে যাচ্ছে মেট্রোরেল (উত্তরা-আগারগাঁও)। এতে নতুন করে আশা দেখতে শুরু করেছেন এই এলাকার ব্যবসায়ীরা। 

রাজধানীর ব্যস্ততম বেগম রোকেয়া সরণি সড়কের একটা বড় অংশ দখল করে মেট্রোরেলের নির্মাণকাজ হয়েছে। এতে বছরের পর বছর মিরপুরের বাসিন্দাদের দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শেওড়াপাড়া থেকে মিরপুর–১০ গোলচত্বর পর্যন্ত দুই পাশের শত শত ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। 

নির্মাণকাজের কারণে দিন-রাত সড়কে যানজট লেগেই থাকত। এতে অনেক প্রতিষ্ঠান দিনের পর দিন ক্রেতার দেখা পায়নি। লোকসান গুনতে গুনতে কেউ কেউ ব্যবসাও গুটিয়ে ফেলতে বাধ্য হয়েছেন। তবে এখন সেই চিত্র অনেকটাই পাল্টেছে। 

গতকাল মঙ্গলবার দেখা যায়, মেট্রোরেলের কারণে শেওড়াপাড়া থেকে মিরপুর-১২ পর্যন্ত পুরো এলাকার ব্যবসা-বাণিজ্যে লেগেছে পরিবর্তনের ছোঁয়া। পুরোনো ব্যবসায়ীদের অনেকে বিক্রয়কেন্দ্রগুলো নতুন করে সাজিয়েছেন। পাশাপাশি এ এলাকায় এসেছে অনেক নতুন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। 

মিরপুরের কাজীপাড়া-শেওড়াপাড়া এলাকা আসবাব ব্যবসার জন্য প্রসিদ্ধ। এখানে এক দশকের বেশি সময় ধরে আসবাব বিক্রি করছে ব্রাদার্স ফার্নিচার। প্রতিষ্ঠানটির শাখা ব্যবস্থাপক মো. শরিফুল ইসলাম বলেন, নির্মাণকাজের কারণে আগে এখানে আসতে যে দুর্ভোগ হতো, সেটা এখন কমেছে। তবে এ এলাকায় যাতায়াত নিয়ে মানুষের মধ্যে যে আতঙ্ক ছিল, তা এখনো কাটেনি। তাই এখনো আশানুরূপ গ্রাহক বাড়েনি। 

পাঁচ বছর ধরে ভালো বিক্রির আশায় ব্যবসা ধরে রেখেছি। তবে গত দুই মাসে গ্রাহক উপস্থিতি অনেক বেড়েছে। আশা করছি, শিগগিরই আবার সুদিন ফিরবে।
মো. আনোয়ারুল হক, ব্যবস্থাপক, গ্রামসিকো ফার্নিশিং

ঘরের পর্দা, সোফার কাপড় আর ঝাড়বাতি বিক্রি করে গ্রামসিকো ফার্নিশিং নামের একটি প্রতিষ্ঠান। কাজীপাড়া মেট্রোস্টেশনসংলগ্ন একটি ভবনে এর বিক্রয়কেন্দ্র। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপক মো. আনোয়ারুল হক বলেন, ‘নির্মাণকাজের কারণে অনেক দিন ব্যবসা বন্ধ রাখতে হয়েছে। এরপরও পাঁচ বছর ধরে ভালো বিক্রির আশায় ব্যবসা ধরে রেখেছি। তবে গত দুই মাসে গ্রাহক উপস্থিতি অনেক বেড়েছে। আশা করছি, শিগগিরই আবার সুদিন ফিরবে।’

পুরোনো ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি ইলেকট্রনিকস, ফ্যাশন, রেস্তোরাঁ ও বেকারি পণ্যের বিভিন্ন নতুন নতুন প্রতিষ্ঠানও এসেছে এ এলাকায়। গত অক্টোবর মাসে শেওড়াপাড়া এলাকায় কার্যক্রম শুরু করে ভিশন এম্পোরিয়ামের একটি বিক্রয়কেন্দ্র। মাত্র আড়াই মাসে পাঁচ শতাধিক গ্রাহকের কাছে পণ্য বিক্রি করেছে তারা। একই এলাকায় মাস তিনেক আগে শাখা খুলেছে বিক্রমপুর মিষ্টান্ন ভান্ডার। প্রতিষ্ঠানটির শাখা ব্যবস্থাপক অমিত ঘোষ বলেন, প্রাথমিক পর্যায়ের হিসেবেও বেশ ভালো গ্রাহক পাওয়া যাচ্ছে। 

পরিবর্তনের প্রভাব মিলেছে ব্যাংকের লেনদেনেও। পূবালী ব্যাংকের শেওড়াপাড়া শাখার এক কর্মকর্তা জানান, গত তিন মাসে তাঁদের শাখায় লেনদেন অনেক বেড়েছে। নতুন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের হিসাবও বেড়েছে। 

তবে বর্তমান অর্থনৈতিক সংকটের কারণে ব্যবসায় মন্দার কথাও জানিয়েছেন কেউ কেউ। শেওড়াপাড়ার রড-সিমেন্ট বিক্রির দোকান শাইনিং শ্যাডো স্টিল হাউসের হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা জাকিয়া সুলতানা বলেন, মেট্রোরেলের নির্মাণকাজ শেষ হওয়ায় যেভাবে বিক্রি বাড়বে আশা করেছিলাম, তা হয়নি। জিনিসপত্রের দাম বাড়ায় বেচাকেনা কমে গেছে। 

মিরপুর-১০ এলাকায় বেনারসিপল্লি ছাড়াও আছে বেশ কিছু বিপণিবিতান। তাদের সবাই জানিয়েছে, এখন মেট্রোরেল চালু হলে তাদের দুর্দশা কাটবে। বেনারসিপল্লিতে শতাধিক শাড়ির দোকান আছে। এখানে প্রতি মৌসুমে (নভেম্বর-জানুয়ারি) ১০০ কোটি টাকার বেশি বেচাকেনা হয়। তবে মেট্রোরেলের কাজের কারণে তিন-চার বছর তাদের ব্যবসার গতি কমে গিয়েছিল। এখন আবার তা বাড়ছে। 

বেনারসিপল্লি দোকান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ আবুল কাশেম বলেন, ‘মেট্রোরেলের নির্মাণকাজ চলার কারণে অনেক দিন ব্যবসায় মন্দাভাব ছিল। সম্প্রতি সেই অবস্থা কাটতে শুরু করেছে। গত দুই মাসে বেচাকেনা ৩০ শতাংশ বেড়েছে। এখন মেট্রোরেল চালু হলে তা আমাদের জন্য হবে বাড়তি পাওনা।’

সরেজমিনে মিরপুর ১১ মেট্রোস্টেশন থেকে পল্লবীর দিকে যেতেই ইলেকট্রনিক, গৃহস্থালি, পোশাক ও খাবারের ব্র্যান্ডের নতুন নতুন বিক্রয়কেন্দ্র চোখে পড়ে। পল্লবী স্টেশন পার হতে সবকিছু কেমন যেন বদলে গেল। স্টেশন শেষ হতেই হাতের বাঁয়ে পুরোনো একটি ভবন সংস্কারের কাজ চলছে। সেখানে ইতিমধ্যে কার্যক্রম শুরু করেছে গ্রামীণ ইউনিক্লোর চোখধাঁধানো দোতলা বিক্রয়কেন্দ্র। পাশেই আরেক ব্র্যান্ড মিনিসো। 

শুধু এই ভবনই নয়, আশপাশের আরও বেশ কিছু ভবন সংস্কার করে বাণিজ্যিকভাবে ভাড়া দেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে দেশের শীর্ষ পোশাক, খুচরা বিক্রয় ও খাবারের ব্র্যান্ডগুলোর বিক্রয়কেন্দ্রের কার্যক্রম শুরু হয়েছে এখানে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, মেট্রোরেল চালু হলে মিরপুরে অন্যান্য এলাকার মানুষের যাতায়াত বাড়বে। এতে ব্যবসায়ও ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে।