মুঠোফোন ছাড়া এখন আর জীবন চলে না। গতানুগতিক মুঠোফোন তো বটেই, ছোট থেকে বড় সবার হাতে হাতেই এখন স্মার্টফোন। মুঠোফোনের ব্যবহার বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে মুঠোফোনসংশ্লিষ্ট ঝামেলাও। হুটহাট ফোন বিকল হওয়া বা নষ্ট হওয়ার ঘটনাও পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। মুঠোফোন এখন দৈনন্দিন জীবনের অতি প্রয়োজনীয় অনুষঙ্গ। তাই নষ্ট হলেই কেউ তা ফেলে দিতে চান না। কারণ, মুঠোফোনে অনেক কিছুই এখন সংরক্ষিত থাকে। এ কারণে ফোন নষ্ট হলে সবাই ছোটেন তা মেরামতে। এ কারণে দেশে নীরবে গড়ে উঠেছে মুঠোফোন মেরামতের বিশাল এক বাজার। রাজধানী থেকে শুরু করে বড় শহর, গ্রামে-গঞ্জে এখন বাজার বিস্তৃত। স্বল্প বিনিয়োগে ভালো আয়ের পথ হিসেবে তরুণদের অনেকেই মুঠোফোন মেরামতকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন।
রাজধানীর মোতালিব প্লাজা, ইস্টার্ন প্লাজা, বসুন্ধরা সিটি, গুলিস্থান ভূগর্ভস্থ মার্কেট, পল্টনের বায়তুল ভিউ টাওয়ার, মিরপুর-১০, মিরপুর-১ ও ২ এলাকার বেশ কয়েকটি বিপণিবিতান এরই মধ্যে পরিচিতি পেয়েছে মুঠোফোন মেরামতের মার্কেট হিসেবে। সম্প্রতি এসব বিপণিবিতান ঘুরে দেখা গেছে, ছোট–বড় দোকানে এক বা একাধিক মেরামতকারী দিনভর মুঠোফোনের বিভিন্ন যন্ত্রাংশ খুলছেন আর মেরামত করছেন। যেসব ফোন মেরামতের অযোগ্য, সেগুলো ফেলে দেওয়া হচ্ছে দোকানের ডাস্টবিনে। বিকল এসব ফোনের জায়গা হয় ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে। বাংলাদেশে মুঠোফোন মেরামতের ব্যবসা শুরু হয় মূলত নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকে। তত দিনে দেশে ল্যান্ডফোনের চাহিদা কমতে শুরু করে। তখন এ ব্যবসা ছিল গুলিস্তানের স্টেডিয়াম ও ভূগর্ভস্থ মার্কেটকেন্দ্রিক।
এখন মুঠোফোন মেরামতের জন্য দেশের সবচেয়ে প্রসিদ্ধ জায়গা রাজধানীর হাতিরপুলের মোতালিব প্লাজা। এই মার্কেটে ছয় শতাধিক দোকান রয়েছে। তার মধ্যে পাঁচ শতাধিক দোকান কোনো না কোনোভাবে মুঠোফোন মেরামতের কাজের সঙ্গে জড়িত। নতুন মুঠোফোন ও মুঠোফোনের যন্ত্রাংশ বিক্রির পাশাপাশি এসব দোকানের প্রতিটিতে ৫ থেকে ১৫ জন কর্মী নিয়মিতভাবে মুঠোফোন মেরামতের কাজ করেন। সারা দেশে ঠিক কত লোক এ কাজে জড়িত, তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। তবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ঢাকা ও আশপাশের শহরে লক্ষাধিক আর সারা দেশে আড়াই থেকে তিন লাখের মতো মানুষ মুঠোফোন মেরামতের কাজের সঙ্গে জড়িত।
মোতালিব প্লাজা দোকান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. আখতারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, দেশে সবচেয়ে বেশি মেরামতকারী রয়েছেন মোতালিব প্লাজায়। সব মিলিয়ে কয়েক হাজার লোক এ কাজের সঙ্গে জড়িত। এসব মেরামতকারীর দক্ষতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন উঠলে বা কোনো সেবা গ্রহণকারী প্রতারণার শিকার হলে তাৎক্ষণিকভাবে প্রতিকারের ব্যবস্থা করা হয়।
রাজধানীতে মুঠোফোন মেরামত করা হয়, এমন একাধিক বিপণিবিতান ঘুরে জানা যায়, মুঠোফোন মেরামতকারী ব্যক্তিদের অধিকাংশই অল্প শিক্ষিত। তা সত্ত্বেও তাঁরা সব ধরনের মুঠোফোন মেরামতে বেশ দক্ষ।
মেরামতের ব্যবসা যেভাবে চলে
রাজধানীর বিভিন্ন বিপণিবিতানের অন্তত অর্ধশত মেরামতকারী বা মেকানিকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সবাই সব ধরনের কাজ পারেন না। জটিল কাজ হলে সেটা সংশ্লিষ্ট মার্কেটের দক্ষ মেরামতকারীর হাতে চলে যায়। একক মালিকানার প্রতিষ্ঠান ছাড়া একাধিক শাখা নিয়ে ছোট আকারের কোম্পানি খুলেও এখন অনেকেই এ ব্যবসা করছেন।
এমনই একটি প্রতিষ্ঠান মুঠোফোন ফিক্সার। রাজধানীর বিভিন্ন বিপণিবিতানে প্রতিষ্ঠানটির পাঁচটি শাখা রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী সজীব জমাদ্দার বলেন, বিদেশ থেকে এসে নিজের আইফোন ঠিক করার মতো কাউকে পাইনি। তখন নিজেই এই ব্যবসায় নেমে গেলাম। এখন কমিশনের মাধ্যমে ৫০–৬০ কর্মী আমার অধীনে কাজ করেন। তবে উন্নত প্রশিক্ষণ ও সরকারি নীতিসহায়তা পেলে এ খাতে প্রচুর কর্মসংস্থানের সুযোগ রয়েছে।
রাজধানীতে মোতালিব প্লাজা, ইস্টার্ন প্লাজা, বসুন্ধরা সিটি, গুলিস্থান ভূগর্ভস্থ মার্কেট, পল্টনের বায়তুল ভিউ টাওয়ার, মিরপুর-১০, মিরপুর-১ ও ২ এলাকা মিলে হাজারের বেশি মুঠোফোন মেরামতের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান আছে। শুধু মেরামতের কাজ বাবদ এসব প্রতিষ্ঠানের প্রতিদিনের গড় আয় ১০ থেকে ১৫ হাজার। অবশ্য কোম্পানি আকারে বড় কিছু প্রতিষ্ঠানও আছে, যেখানে মেরামতকারীর সংখ্যা বেশি। তাদের আয় কিছুটা বেশি। তবে গড় আয়ের হিসাবে ঢাকার এসব মার্কেটে দৈনিক মুঠোফোন মেরামতের ব্যবসার আকার দেড় কোটি টাকার বেশি। এর মধ্যে প্রায় অর্ধেক ব্যবসা হয়ে থাকে মোতালিব প্লাজাকে ঘিরে। খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতে, সারা দেশে মুঠোফোন মেরামত ব্যবসার বার্ষিক আকার আনুমানিক দুই থেকে তিন হাজার কোটি টাকা।
মোতালিব প্লাজার মুঠোফোন ক্লিনিকের মালিক মো. মিন্টু প্রথম আলোকে জানান, ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে তিনি এই কাজের সঙ্গে জড়িত। নিজেই মেরামতের কাজ করেন। পাশাপাশি অন্য আরও কয়েকজনকে নিয়োগ দিয়ে কাজ করান। সে ক্ষেত্রে আয় ভাগাভাগি হয়। দিনের আয়ের ৫০ শতাংশ মেরামতকারী পান। বাকি ৫০ শতাংশ দোকানমালিকের কাছে যায়। দোকানের জায়গা ভাগাভাগি করেও চলে এ ব্যবসা। মেরামতের কাজে ব্যবহৃত আমদানি করা যন্ত্রাংশও বিক্রি করেন তাঁরা।
তবে নতুন যন্ত্রাংশের বাইরে, পুরোনো মুঠোফোনের যন্ত্রাংশও মেরামতের কাজে ব্যবহৃত হয়। চাইলেই কেউ মেরামতকারী হিসেবে কাজ শুরু করতে পারেন না। কাজ শুরুর আগে কাজটি শিখতে হয়। এ জন্য শুরুতে তিন থেকে এক বছরের প্রশিক্ষণ নিতে হয়। প্রশিক্ষিত মুঠোফোন মেরামতকারী মাসে ১৫ থেকে ৬০ হাজার টাকা আয় করতে পারেন। কয়েক বছরের অভিজ্ঞতা আর দক্ষতা থাকলে মাসে লক্ষাধিক টাকাও আয় করা সম্ভব।
দেশে অনলাইনে মুঠোফোন মেরামতের সেবা দেয় সেবা ডট এক্সওয়াইজেড। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা ইলমুল হক প্রথম আলোকে বলেন, দিনে ১৫ থেকে ২০টি ফোন মেরামতের জন্য আমাদের কাছে আসে। আমাদের প্ল্যাটফর্মে ১৫০ থেকে ২০০ জন মেরামতকারী আছেন।
এ খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা জানান, সম্প্রতি মুঠোফোনের ডিসপ্লে, ব্যাটারি, কাভারসহ সব ধরনের যন্ত্রাংশের দাম বেড়েছে। তাতে নষ্ট হওয়া ফোনের মেরামত খরচও বেড়ে গেছে। বর্তমানে ছোটখাটো মেরামত কাজের জন্য ২০০ থেকে ৫০০ টাকা লাগে। আর আইসি বা সার্কিট ঠিক করার মতো কাজের ক্ষেত্রে এক থেকে তিন হাজার টাকা খরচ হয়।
দক্ষতার অভাব ও প্রশিক্ষণ
দেশে মুঠোফোন মেরামতের বড় বাজার গড়ে উঠলেও এ খাতের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের প্রাতিষ্ঠানিক খুব বেশি প্রশিক্ষণ নেই। এ খাতের নতুন কর্মীরা পুরোনোদের কাছ থেকে শিখে কাজটি করে থাকেন। দিনে দিনে মুঠোফোন মেরামতের ব্যবসার প্রসার ঘটলেও দেশে এ খাতে প্রশিক্ষণের জন্য বড় কোনো প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি। খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকলে এ খাতে মূল্য সংযোজন যেমন বাড়বে, তেমনি কর্মসংস্থানেরও বড় সুযোগ রয়েছে। বর্তমানে মুঠোফোন মেরামতের অনেক দোকান কোনো খরচ ছাড়া আগ্রহীদের প্রশিক্ষণও দিয়ে থাকে। সে ক্ষেত্রে কাজ শেখার পর ওই দোকানেই কাজ করার শর্ত থাকে।
প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগের কথা জানতে চাইলে জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নির্বাহী চেয়ারম্যান নাসরীন আফরোজ প্রথম আলোকে বলেন, কারিগরি খাতকে আরও সমৃদ্ধ করতে সরকার নানাভাবে কাজ করছে। আমরা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়ে সারা দেশে মুঠোফোন মেরামতকারী তৈরিতে প্রশিক্ষণ দেওয়ার কাজে সহযোগিতা করে যাচ্ছি।
রাজধানীতে বিভিন্ন বিপণিবিতানের পাশাপাশি মুঠোফোন উৎপাদক ও বাজারজাতকারী কোম্পানিগুলোও মেরামতের বিক্রয়োত্তর সেবা দিয়ে থাকে। তুলনামূলক প্রশিক্ষিত মেরামতকারী দিয়ে চলে এসব সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান। তবে এসব প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে নির্দিষ্ট মেয়াদ বা ওয়ারেন্টি শেষে গ্রাহকদের টাকার বিনিময়ে সেবা নিতে হয়। তাতে খরচটা সাধারণ মেরামতকারী দোকানের চেয়ে একটু বেশি পড়ে।
স্যামসাংয়ের বসুন্ধরা সিটি কাস্টমার কেয়ারের কর্মকর্তা শুভ সরকার প্রথম আলোকে বলেন, সাধারণত দেখা যায়, গরমকালে মুঠোফোনে বেশি সমস্যা হয়। তখন দিনে শতাধিক ফোন মেরামতের জন্য আসে। শীতকালে তা দিনে ৬০ থেকে ৭০টিতে নেমে আসে। আমাদের এখানকার মেরামতকারীরা প্রকৌশল ডিগ্রিধারী, অভিজ্ঞ ও দক্ষ।
আইনি সুরক্ষা কতটুকু
উৎপাদক প্রতিষ্ঠান বা ব্র্যান্ডগুলোর একচেটিয়া প্রভাব কমাতে সম্প্রতি ভারতে মেরামতের অধিকার নিয়ে আইন পাসের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। মুঠোফোন, কম্পিউটার, ট্যাবসহ অন্যান্য ইলেকট্রনিক গেজেট তৃতীয় পক্ষের কাছ থেকে ভোক্তারা যাতে কম খরচে মেরামত করতে পারেন, এ আইনের উদ্দেশ্য সেটাই। প্রস্তাবিত আইনে উৎপাদনকারীরা বাধ্য থাকবেন পণ্য উৎপাদনপ্রক্রিয়ার সব তথ্য-উপাত্ত প্রকাশ করতে। ফলে উৎপাদক প্রতিষ্ঠান ও তৃতীয় পক্ষের মধ্যে ব্যবসার সম্প্রসারণ ঘটবে, যা মূলত ভোক্তাকে লাভবান করবে।
এ ছাড়া আইনটিতে মেয়াদোত্তীর্ণ ইলেকট্রনিক গেজেট মেরামত করে পুনরায় ব্যবহারের সুযোগ রাখা হয়েছে। বর্তমানে একটা নির্দিষ্ট সময় পর উৎপাদক কোম্পানিগুলো পুরোনো কোনো পণ্য মেরামত করে দিতে চায় না। বরং তারা নতুন পণ্য বাজারজাত করতে বেশি আগ্রহী। মেরামতের অধিকার দেওয়া হলে একই জিনিস মেরামত করে অনেক দিন পর্যন্ত ব্যবহার করা যাবে। ভারত এ আইন করলেও বাংলাদেশে এ–সংক্রান্ত আইনি কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। তাই খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এখনই এ ধরনের আইনের বিষয়ে বাংলাদেশও ভাবতে পারে।
মিরপুরের ১০ নম্বরের শাহ আলী প্লাজার মেকানিক মো. শাহজাহান হাওলাদার বলেন, গ্রাহকের অনুমতি ছাড়া কোনো ফোনের নিরাপত্তাবলয় ভাঙার আইনত অনুমতি নেই। আর কোনো যন্ত্রাংশ পরিবর্তনের তো প্রশ্নই আসে না। ফলে নষ্ট ফোন কিনে তার যন্ত্রাংশ পরিবর্তন করতে অনেক সমস্যায় পড়তে হয়।
শুধু যে আমাদের দেশেই মুঠোফোন মেরামতের বড় বাজার গড়ে উঠেছে, তা নয়। এটির আন্তর্জাতিক বাজারও বেশ বড়। ভারতভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ইউনিভ ড্যাটোস মার্কেট ইনসাইটসের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালে মুঠোফোন মেরামতের বাজার ছিল ১৮৫ বিলিয়ন বা সাড়ে ১৮ হাজার মার্কিন ডলারের। ২০২৭ সাল পর্যন্ত বছরে এ বাজার ৫ শতাংশ হারে বাড়বে বলে প্রতিষ্ঠানটির ধারণা।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সাম্প্রতিক এক জরিপ বলছে, দেশের ৫২ শতাংশ বাড়িতে স্মার্টফোনের ব্যবহার হয়। আর সাধারণ মুঠোফোন বিবেচনায় নিলে ফোনের ব্যবহার ৯৭ শতাংশের ওপর। সময়ের ব্যবধানে মুঠোফোনের ব্যবহার আরও বাড়বে বলেই ধারণা করা হচ্ছে। তাতে ফোন মেরামতের বাজারটিও দিনে দিনে বড় হবে।