ভারতে ধনীদের ওপর সম্পদ করারোপের প্রস্তাব শীর্ষস্থানীয় অর্থনীতিবিদদের

ভারতের জাতীয় পতাকাছবি: এএফপি

বিশ্বজুড়ে অসমতা বাড়ছে। অসমতার রাশ টানতে সম্পদ করারোপের কথা বলেন অনেক অর্থনীতিবিদ। এবার ফরাসি অর্থনীতিবিদ টমাস পিকেটিসহ আরও কয়েকজন অর্থনীতিবিদ ভারতে বৈষম্য কমাতে অতি ধনীদের ওপর সম্পদ করারোপের কথা বলেছেন।

এক গবেষণাপত্রে অর্থনীতিবিদেরা বলেন, ১০ কোটি রুপির বেশি নিট সম্পদে বাড়তি ২ শতাংশ সম্পদকর এবং উত্তরাধিকার সূত্রে এই অঙ্কের বেশি অর্থ প্রাপ্তির ক্ষেত্রে ৩৩ শতাংশ করারোপ করা হোক। এই প্রক্রিয়ায় জিডিপির প্রায় ২ দশমিক ৭৩ শতাংশ সমপরিমাণ রাজস্ব বাড়তে পারে, যা ব্যবহৃত হতে পারে সামাজিক কল্যাণে। একই সঙ্গে তাঁর মত, এই করারোপের কারণে ৯৯ দশমিক ৯৬ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্কের জীবনে আলাদা প্রভাব পড়বে না। খবর টাইমস অব ইন্ডিয়ার।

ওয়ার্ল্ড ইনইকুয়ালিটি ল্যাবের সদস্য ও হার্ভার্ড কেনেডি স্কুলের অর্থনীতিবিদ লুকাস স্যঁসেল, নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির নীতীন কুমার ভারতী ও প্যারিস স্কুল অব ইকোনমিকসের আনমোল সোমাঞ্চির সঙ্গে যৌথভাবে এই গবেষণাপত্র তৈরি করেছেন প্যারিস স্কুল অব ইকোনমিকসের অধ্যাপক পিকেটি। এই ‘প্রপোজালস ফর আ ওয়েলথ ট্যাক্স প্যাকেজ টু ট্যাকল এক্সট্রিম ইনইকুয়ালিটিজ ইন ইন্ডিয়া’ বা ‘ভারতের চরম অসমতা মোকাবিলায় সম্পদকরের প্রস্তাব’ শীর্ষক গবেষণাপত্রে ভারতের ক্রমবর্ধমান অসমতার বিষয়টি আমলে নেওয়া হয়েছে।

প্রতিবেদনে গবেষকেরা বলেছেন, ২০০০-এর প্রথম দশক থেকে ভারতে অসমতা মাত্রাছাড়া হতে শুরু করে। তখন থেকেই দেশটির শীর্ষ ১ শতাংশ ধনীর আয় ও সম্পদ বাড়ছে। বাস্তবতা হচ্ছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ভারতের এই শীর্ষ ১ শতাংশ ধনীর হাতে মোট জাতীয় আয়ের ২২ দশমিক ৬ শতাংশ ও সম্পদের ৪০ দশমিক ১ শতাংশ কেন্দ্রীভূত হয়েছে।

গবেষণাপত্রে আরও বলা হয়েছে, শীর্ষ ধনীদের হাতে সম্পদ কেন্দ্রীভূত হওয়ার হার ২০১৪-১৫ অর্থবছর থেকে আরও বেড়েছে। ভারতে শীর্ষ ১ শতাংশ ধনীর হাতে সম্পদ কেন্দ্রীভূত হওয়ার হার বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় বেশি; যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল ও দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দেশগুলোর তুলনায় বেশি।

গবেষণায় বলা হয়েছে, শুধু অতি ধনীদের ওপরে করারোপ করলেই হবে না; বৈষম্য দূর করতে হলে এর সঙ্গে দরিদ্র, মধ্যবিত্ত ও পিছিয়ে পড়া শ্রেণির মানুষকে সহায়তা করার প্রয়োজনীয় নীতি থাকা প্রয়োজন।

অর্থাৎ সেই করের অর্থ ব্যবহারের নীতি। উদাহরণ হিসেবে বলা হয়েছে, গত ১৫ বছরে ভারতের শিক্ষা খাতে জিডিপির মাত্র ২ দশমিক ৯ শতাংশ অর্থ ব্যয়ের কথা বলা হয়েছে। যদিও ২০২০ সালের জাতীয় শিক্ষানীতিতে জিডিপির ৬ শতাংশ ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল।

এ ছাড়া ধনীদের ওপর করারোপের প্রস্তাব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা জরুরি বলেও মনে করেন এই তিন অর্থনীতিবিদ। তাঁদের মত, সম্পদ পুনর্বণ্টন ও কর–ন্যায্যতা নিশ্চিত করতে গণতান্ত্রিক পরিসরে আলাপ-আলোচনা দরকার। কারণ হিসেবে তাঁরা বলেন, বৈষম্য ও তার সঙ্গে সামাজিক অবিচারের সম্পর্ক এখন আর উপেক্ষা করার জায়গায় নেই।

আনমোল সোমাঞ্চির মতে, ধনীদের ওপর সম্পদ করারোপ করা হলে ভারতের নিম্ন ও মধ্যবিত্ত মানুষ উপকৃত হবে। উন্নত ও বৈষম্যহীন ভারতের ভিত্তি হতে পারে এই কর। তবে এই অর্থ পুনর্বণ্টন অর্থাৎ সামাজিক খাতে বিনিয়োগ করতে হবে।

অর্থনীতিবিদের অভিযোগ, মহামারির পর ভারতে যে প্রবৃদ্ধি হচ্ছে, তা অনেকটা ইংরেজি ‘কে’ অক্ষরের মতো। যেখানে ধনীরা আরও ধনী হচ্ছেন, দরিদ্ররা আরও গরিব। বিরোধী দলগুলোও তাই মোদি সরকারের বিরুদ্ধে উচ্চকণ্ঠ। তাঁদের বক্তব্য, এই অসমতার জেরে প্রবৃদ্ধির সুফল সবার ঘরে যাচ্ছে না।

টমাস পিকেটি অর্থনীতির বেস্টসেলার লেখকদের একজন। অসমতা নিয়ে তিনি অনেক কাজ করেছেন।

তাঁর সর্বশেষ বই অবশ্য সাম্যের ইতিহাস নিয়ে। সেখানে তিনি লিখেছেন, সম্পত্তি, আয়, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, গণতান্ত্রিক শাসনে নাগরিকের অধিকার—এসব ক্ষেত্রে ২০০-২৫০ বছরের তুলনায় এখন অসাম্য কম; কিন্তু এই পরিবর্তনের গতি মসৃণ হয়নি।

সন্তুষ্টির বিন্দুমাত্র কারণ নেই বলে মনে করেন টমাস পিকেটি। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, বৈষম্য এখনো অনেক বেশি। সাম্যের ইতিহাস বইয়ে তিনি বলেন, ২০ শতকের শুরুতে ইউরোপের সবচেয়ে ধনী ১০ শতাংশ মানুষের হাতে মোট সম্পত্তির প্রায় ৯০ শতাংশ কেন্দ্রীভূত ছিল; ২০২০ সালে যা ৫০ শতাংশের কিছু বেশি। দ্বিতীয়ত, গত চার দশকে বৈষম্য আবার কিছুটা বেড়েছে। তুলনামূলকভাবে ইউরোপে বৈষম্য কম হলেও যুক্তরাষ্ট্রে বেশ দ্রুতগতিতে তা বাড়ছে। ১৯৮০-এর দশকের মাঝামাঝি সময় ১০ শতাংশ ধনীর হাতে ছিল প্রায় ৬০ শতাংশ সম্পদ; এখন যা ৭০ শতাংশে উন্নীত হয়েছে।