মিথ্যা ঘোষণায় সিরিশ কাগজ আমদানি

বিশ্ববাজারে প্রতি কেজির গড় দাম ৮ থেকে ১০ মার্কিন ডলার। অথচ আমদানিকারকেরা ২০২৩ সালেও শুল্কায়ন করেছে ১ দশমিক ৫ ডলারে।

সিরিশ কাগজ

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চোখের সামনে মিথ্যা ঘোষণায় সিরিশ কাগজ আমদানি হচ্ছে দেশে। এ পণ্য আমদানিতে ন্যূনতম ঘোষিত কোনো মূল্য নেই। আর সেই সুযোগটিই নিচ্ছেন একশ্রেণির বাণিজ্যিক আমদানিকারক। এর মাধ্যমে আমদানিকারকেরা একদিকে ফাঁকি দিচ্ছেন বিপুল পরিমাণ শুল্ক ও মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট)। অন্যদিকে দেশীয় কাগজ উৎপাদনকারী একমাত্র প্রতিষ্ঠান গ্রাইন্ড টেক লিমিটেড প্রতিষ্ঠান টিকিয়ে রাখতে হিমশিম খাচ্ছে। গ্রাইন্ড টেক শেলটেক গ্রুপের একটি সহযোগী প্রতিষ্ঠান।

বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন (বিটিটিসি) বিষয়টি নিয়ে সম্প্রতি একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে। সেখানে ন্যূনতম শুল্কায়ন মূল্য বেঁধে দেওয়ার সুপারিশ করে বিটিটিসি বলেছে, আমদানিকারকেরা যে দামে সিরিশ কাগজ আমদানি করছেন এবং স্থানীয় বাজারে যে দামে বিক্রি করছেন, তাতে প্রমাণিত হয় তাঁরা অতিমাত্রায় মুনাফা করছেন। আমদানি মূল্যের তুলনায় কম মূল্যে এসব সিরিশ কাগজের শুল্কায়ন করা হচ্ছে। শুল্কায়নবহির্ভূত মূল্য অন্য মাধ্যমে পরিশোধ করছেন তাঁরা। বিটিটিসির চেয়ারম্যান আহমেদ মুনিরুছ সালেহীনের সভাপতিত্বে গতকাল সোমবারও সিরিশ কাগজ আমদানিতে শুল্ক ও ভ্যাট ফাঁকি রোধে করণীয় নির্ধারণে বৈঠক হয়েছে।

এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার ও এনবিআরের সদস্য মাসুদ সাদিকের কাছে আলাদা আবেদন করে গ্রাইন্ড টেক লিমিটেড এসব কথা জানিয়েছে। গ্রাইন্ড টেক প্রতি কেজি সিরিশ কাগজের আমদানি মূল্য ন্যূনতম ৮ ডলার নির্ধারণের দাবি জানিয়েছে। তারা বলছে, সেটি হলে স্থানীয় শিল্পকে অসম প্রতিযোগিতার হাত থেকে বাঁচানো সম্ভব হবে।

এনবিআর সদস্য মাসুদ সাদিক প্রথম আলোকে বলেন, ‘সিরিশ কাগজ আমদানিতে কম মূল্য দেখানো হচ্ছে কি না, ‘আমরা পরীক্ষা করছি। খতিয়ে দেখছি গ্রাইন্ড টেকের অভিযোগও।’

 বাজারসংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দেশের প্রায় ৩০০ কোটি টাকার সিরিশ কাগজের পুরো বাজারই আমদানিনির্ভর। সিঙ্গাপুর, চীন ও থাইল্যান্ড থেকে এসব সামগ্রী আমদানি করা হয়। বাজারের নিয়ন্ত্রণ হাতে গোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের হাতে। এর মধ্যে ইউনিক করপোরেশন, ইউনাইটেড করপোরেশন, কে এল এস লজিস্টিকস এবং ক্যাপিটাল করপোরেশন—এ চার প্রতিষ্ঠান জার্মানির ব্র্যান্ড ক্লিংস্পোর সিরিশ কাগজ আমদানি করে থাকে প্রধানত সিঙ্গাপুর থেকে।

ক্লিংস্পোরের ঢাকায়ও একটি কার্যালয় রয়েছে, যে কার্যালয় আমদানিকারকদের কারিগরি সহায়তা দেয়। ক্লিংস্পোর ঢাকা কার্যালয়ের প্রধান জাহাঙ্গীর আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাংলাদেশের অনেকেই ক্লিংস্পোরের পণ্য আমদানি করে। তবে আমদানির কোনো বিষয়ই আমরা দেখি না।’

আমদানিকারক চার প্রতিষ্ঠানই এক পরিবারের, যার প্রকৃত মালিক মো. আশরাফুজ্জামান। শুল্ক বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে আনা সিরিশ কাগজের ঘোষিত মূল্য প্রতি কেজি ১ দশমিক ৫ ডলার। চারটি প্রতিষ্ঠান ২০২২ সালে ৪০ কনটেইনার সিরিশ কাগজ আমদানি করে। প্রতি কনটেইনারে পণ্য ছিল ৩০ টন করে। সে হিসাবে আমদানি হয়েছে ১ হাজার ২০০ টন সিরিশ কাগজ।

আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিক মো. আশরাফুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আগে ১ দশমিক ৫ ডলার করে শুল্কায়ন হলেও এখন হচ্ছে ২ দশমিক ৫ ডলার দাম ধরে। আমরা অপেক্ষায় আছি এনবিআর এখন কী পদক্ষেপ নেয়।’

আরব ইলেকট্রনিকসও অন্যতম সিরিশ কাগজ আমদানিকারক। ২০১২ সালে থাইল্যান্ড থেকে প্রতি কেজি সিরিশ কাগজ আমদানি করত ৪ দশমিক ২২ ডলারে এবং ২০১৩ সালে করত ৩ দশমিক ৩১ ডলারে। ১০ বছর পর একই প্রতিষ্ঠান ২০২২ সালে প্রতি কেজি সিরিশ কাগজের মূল্য শুল্ক বিভাগের কাছে ঘোষণা করেছে ১ দশমিক ৫ ডলার করে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে আরব ইলেকট্রনিকসের স্বত্বাধিকারী আজিজুল হক প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলতে রাজি হননি।

বিশ্ববাজারে গত ১০ বছরে সিরিশ কাগজের দাম ৫ গুণ বেড়েছে। অথচ আরিস্তা বাংলাদেশ, আহনাফ ট্রেডিং, অ্যাব্রেসিভ সলিউশন, খাজা ট্রেডার্স, এআরজেড ট্রেডার্স, মাসউদ অ্যান্ড ব্রাদার্স, এশা ট্রেডিংসহ আরও প্রতিষ্ঠান মিথ্যা ঘোষণায় সিরিশ কাগজ আনছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মজিদ বলেন, বেশি রাজস্ব আদায়ের স্বার্থে এনবিআরের উচিত হবে বিটিটিসির সুপারিশ আমলে নেওয়া। নিজেরাও তদন্ত করে ব্যবস্থা নিতে পারে এনবিআর।