অতিমারির বাস্তবতা উঠে আসেনি

এবারের বাজেটে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের প্রতিফলন ঘটেনি। অন্য কথায়, দ্বিতীয় ঢেউ বিবেচনায় নিয়ে এই বাজেট করা হয়নি। পুরো বাজেট বক্তৃতায় মাত্র একবার দ্বিতীয় ঢেউ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু তার তাৎপর্য, পরিণতি, অভিঘাত—এসব নিয়ে বাক্য ব্যয় করা হয়নি। মনে হয়, বাজেট বক্তৃতা এর আগেই করা হয়েছে। এ ছাড়া তৃতীয় ঢেউয়ের আশঙ্কা নিয়েও কথা বলা হয়নি। পুরো ব্যাপারের মধ্যে অতিমারির বাস্তবতা উঠে আসেনি। তার স্বীকৃতি নেই। তাই এই বাজেটের মূল তাৎপর্য ক্ষুণ্ন হয়ে গেছে।

এ ছাড়া এই অতিমারি সম্পর্কে গভীর অনুধাবন ও অভিব্যক্তি নেই। ফলে যেসব পর্যালোচনা করা হয়েছে, সেগুলো কেবল বাস্তবতাবর্জিতই নয়, বরং কল্পনাপ্রসূত মনে হবে। যেমন দারিদ্র্যের কথা বলা যায়। অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় বলা হয়েছে, ২০২১ সালে দারিদ্র্যের হার দাঁড়াবে ২৩ শতাংশ। ২০২৪ সালে তা দাঁড়াবে ১৭ শতাংশ। কিন্তু বাজেট বক্তৃতায় বলা হলো, ওই সময় দারিদ্র্য ১২ দশমিক ৩ শতাংশে নামিয়ে আনা যাবে। অথচ সব জরিপেই দেখা যাচ্ছে, ২০২১ সালে দারিদ্র্যের হার ন্যূনতম ৩০ থেকে সর্বোচ্চ ৪০ শতাংশ পর্যন্ত উঠতে পারে। দেখা যাচ্ছে, অর্থমন্ত্রী সরকারি প্রক্ষেপণই উল্টে দিচ্ছেন। চরম দারিদ্র্যের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য।

এবারের বাজেটে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের প্রতিফলন ঘটেনি। অন্য কথায়, দ্বিতীয় ঢেউ বিবেচনায় নিয়ে এই বাজেট করা হয়নি। পুরো বাজেট বক্তৃতায় মাত্র একবার দ্বিতীয় ঢেউ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু তার তাৎপর্য, পরিণতি, অভিঘাত—এসব নিয়ে বাক্য ব্যয় করা হয়নি।

ফলে দেখা যাচ্ছে, কয়েক বছরের পুরোনো তথ্য-উপাত্ত ব্যবহার করা হয়েছে। তা-ও খুব শিথিলভাবে। এগুলোর ভিত্তি, উৎস, কাল কিছুই উল্লেখ করা হয়নি। অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা, বাজেট বক্তৃতার তথ্য ও মধ্যমেয়াদি সামষ্টিক অর্থনৈতিক প্রক্ষেপণ—এই তিনটির মধ্যে মিল নেই।

এই সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সূচক হচ্ছে দারিদ্র্য, কর্মসংস্থান ও আয়। অথচ এই তিন ক্ষেত্রেই যা বলা হয়েছে তার মধ্যে অমনোযোগের ছাপ আছে। বলা হয়েছে, তিন বছরে বিদেশে ৭ লাখ করে মোট ২১ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হবে। কিন্তু অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় বলা হয়েছে, ৬ লাখ করে কর্মসংস্থান হবে। যুব প্রশিক্ষণের কথা আছে, কিন্তু কর্মসংস্থানের কথা নেই।

সাম্প্রতিককালের দুর্বলতম অর্থবছর পার করলাম আমরা। গত অর্থবছরে রাষ্ট্রীয় ব্যয় ১৫ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে, যদিও বাজেটের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৮ শতাংশ। এডিপির ব্যয় পাঁচ বছরের মধ্যে সবচেয়ে চেয়ে কম হয়েছে গত অর্থবছরে। এর মধ্যে সবচেয়ে কম হয়েছে স্বাস্থ্য খাতে। অর্থাৎ ব্যয়ের দিক থেকে দুর্বলতম বছর পার করলাম আমরা। আয়ের ক্ষেত্রে তুলনামূলকভাবে আমরা ভালো করেছি। এনবিআর ও করবহির্ভূত রাজস্ব বেড়েছে।

২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রবৃদ্ধির সাময়িক হিসাব ৫ দশমিক ২ শতাংশ। এবার হবে ৬ দশমিক ২ শতাংশ। অথচ এবার আয়-ব্যয়ের দিক থেকে সরকার খুবই দুর্বল অবস্থানে আছে। আবার বলা হচ্ছে, বিনিয়োগ হয়েছে ২৪ শতাংশ, গত বছরের চেয়ে বেশি। ফলে কোনো হিসাবই মেলে না।

কিন্তু এর সঙ্গে বিনিয়োগ ও প্রবৃদ্ধির হিসাব মেলে না। ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রবৃদ্ধির সাময়িক হিসাব ৫ দশমিক ২ শতাংশ। এবার হবে ৬ দশমিক ২ শতাংশ। অথচ এবার আয়-ব্যয়ের দিক থেকে সরকার খুবই দুর্বল অবস্থানে আছে। আবার বলা হচ্ছে, বিনিয়োগ হয়েছে ২৪ শতাংশ, গত বছরের চেয়ে বেশি। ফলে কোনো হিসাবই মেলে না। ব্যাপারটা হলো, ব্যক্তি খাতের ঋণপ্রবাহ লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কম, মূলধনি যন্ত্রপাতির আমদানি ঋণাত্মক, উৎপাদনও কম, অর্থাৎ প্রবৃদ্ধি ও ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগের অনুমিতির সঙ্গে অন্য সূচকগুলো মিলছে না।

করের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ছাড় দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বর্ধিত কর কোথা থেকে আদায় হবে, তা বলা হয়নি। তবে এনবিআরকে ধন্যবাদ দিতে চাই। তারা কিছুটা মাথা খাটিয়েছে। তবে সরকারি ব্যয় কার্যকরভাবে বৃদ্ধি এবং তার গুণমান নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে সেটা করা হয়নি। অথচ সরকারি ব্যয় থেকে নিম্ন ও নিম্নমধ্যবিত্ত কিছুটা লাভবান হয়ে থাকে।

সামাজিক নিরাপত্তার আওতা বাড়ছে। নতুন প্রায় ১৪ লাখ মানুষ এর আওতায় আসছেন। কিন্তু এই অর্থের পরিমাণ জিডিপির মাত্র শূন্য দশমিক ২ শতাংশ। পুরা বাজেটের মাত্র ১ শতাংশ। দুস্থ মহিলারাই এর মূল সুবিধাভোগী। ৫০০ টাকা করে দেওয়া হচ্ছে। অথচ ন্যূনতম জীবনধারণের জন্য প্রয়োজন ১ হাজার ৮৬২ টাকা। আবার ভারতে এই ভাতার পরিমাণ বাংলাদেশি টাকায় ১২০০ টাকা। এখন আমরা যদি মাথাপিছু আয়ে ভারতের চেয়ে এগিয়ে থাকি, তাহলে আমরা অন্তত তাদের সমান ভাতা দিই না কেন।

করের ব্যাপারে দেখা যাচ্ছে, সংগঠিত প্রতিষ্ঠিত ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের কর ছাড় দেওয়া হয়েছে। ছোটরা ততটা পায়নি। ব্যক্তিশ্রেণির কর ছাড় দেওয়া হয়নি।
নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষকে ছাড় দেওয়া হয়নি। অপর দিকে তারা ব্যয়ের ক্ষেত্রেও সুবিধাও পেল না।

এখানে আমাদের অস্বীকৃতির মনোভাব পরিষ্কার হয়ে ওঠে। আর এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় যে উদ্ভাবনী দক্ষতার পরিচয় দেওয়া উচিত, তার ঘাটতিও দেখা গেল।
পরিশেষে বলব, বাজেটের আগে যে প্রামাণ্যচিত্র দেখানো হয়, তা ঠিক আন্তর্জাতিক সংসদীয় রীতিনীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। সে জন্য বিষয়টি পুনর্বিবেচনার অনুরোধ করব। বাজেটের ভাবগাম্ভীর্যের সঙ্গে এটা যায় না।