কেমন বাজেট চাই না


অর্থমন্ত্রী হিসেবে আ হ ম মুস্তফা কামাল তৃতীয় বাজেট পেশ করবেন আজ। অসুস্থ থাকায় প্রথম বাজেটটি ঠিকমতো উপস্থাপন করতে পারেননি তিনি। দ্বিতীয় বাজেট দিতে হয়েছে করোনাভাইরাসের মধ্যে। আকাঙ্ক্ষা ছিল, পরের অর্থবছরের বাজেটটি দেওয়া যাবে স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে। কিন্তু তৃতীয় বাজেটও দিতে হচ্ছে তথাকথিত ‘কঠোর’ লকডাউনের মধ্যে, সরকারের ভাষায়, বিধিনিষেধের মধ্যে। নতুন বাজেটের আরেকটি বিশেষত্ব হচ্ছে, এটি হবে বাংলাদেশের ৫০তম বাজেট।

বাংলাদেশের বাজেটের একটি গতানুগতিক চেহারা আছে। অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতাটি খুবই গতানুগতিক, অনাবশ্যকভাবে দীর্ঘ এবং ক্লান্তিকর। বাজেট তৈরির প্রক্রিয়াটিও গতানুগতিক। এই বাজেটে জনপ্রতিনিধিদেরও কোনো সম্পৃক্ততা থাকে না। নতুন বাজেট নিয়ে কিছু ব্যক্তি ও গ্রুপের সঙ্গে আলোচনা করেন অর্থমন্ত্রী ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। আর বাজেটের পরে জাতীয় সংসদে আলোচনার পরে বাজেট পাস। পাসের আগে প্রধানমন্ত্রীর কিছু নির্দেশ, কিছু সংশোধন এবং বাজেট পাস।

আরও পড়ুন

কেমন বাজেট চাই—এটি হচ্ছে বাজেটের আগের সবচেয়ে আলোচিত বিষয়। প্রত্যেকেই যাঁর যাঁর জায়গা থেকে বাজেট নিয়ে বেশ কিছু প্রত্যাশার কথা বলেন। তবে এবারের পরিস্থিতি ভিন্ন। বিশ্ব অর্থনীতি সংকটে। জীবন ও জীবিকা—দুটোই একসঙ্গে রক্ষা করা অনেক দেশের জন্যই কঠিন হয়ে পড়ছে। ফলে বিভিন্ন দেশ গতানুগতিক ধারা থেকে বের হয়ে নতুন নতুন পথ বের করছে। এ রকম এক সময়ে কেমন বাজেট চাই—এ কথা না বলে একটু উল্টো করে বলা প্রয়োজন—কেমন বাজেট চাই না। তাহলে দেখি, কী কী চাই না।

একটি উদাহরণ

করোনাভাইরাসের ভারতীয় ধরন নিয়েই এখন যত আলোচনা ও উৎকণ্ঠা। তাহলে ভারতীয় বাজেট নিয়েও আলোচনা করা যেতে পারে। দেশটির অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমণ গত ১ ফেব্রুয়ারি ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেট দিয়েছিলেন। পুরো বক্তৃতা ৬৫ পৃষ্ঠার, এর মধ্যে মূল বক্তৃতা ৩৯ পৃষ্ঠা পর্যন্ত। বাকিটা পরিশিষ্ট। শুরুতেই তিনি জানান যে তাঁর বাজেটের পিলার বা স্তম্ভ ৬টি। যেমন: ১. স্বাস্থ্য ও ভালো থাকা, ২. ভৌত ও আর্থিক পুঁজি এবং অবকাঠামো, ৩. উন্নয়নে আগ্রহী ভারতের সার্বিক বিকাশ, ৪. মানবসম্পদের ক্ষেত্রে প্রাণসঞ্চার, ৫. উদ্ভাবন তথা গবেষণা ও উন্নয়ন এবং ৬. ন্যূনতম সরকার, সর্বাধিক প্রশাসন (মিনিমাম গভর্নমেন্ট, ম্যাক্সিমাম গভর্নেন্স)।

অর্থমন্ত্রীর পুরো বক্তৃতাই এই ছয়টি বিষয়ের ওপর করা। এর মধ্যে স্বাস্থ্য ও ভালো থাকা খাতে বাজেট রেখেছেন আগের অর্থবছরের তুলনায় ১৩৭ শতাংশ বেশি। বাজেটের মোট আকার, আয় ও ব্যয়ের কোনো পরিসংখ্যান পুরো বক্তৃতার কোথাও উল্লেখ নেই। নেই কঠিন এই সময়ে মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি অর্জনের কোনো ধরনের তথ্য। তবে আছে রাজস্ব পরিস্থিতি ও ঘাটতি অর্থায়ন নিয়ে বড় আলোচনা।

ভারতে প্রথমবারের মতো ‘পেপারলেস বাজেট’ পেশ করেছেন অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন।
ছবি: এএফপি

যেমন অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমণ প্রকৃত বাজেটে হিসাব অনুযায়ী ৩০.৪২ লাখ কোটি টাকা ব্যয়ের পরিবর্তে সংশোধিত বাজেটে ৩৪.৫ লাখ কোটি টাকা ব্যয়ের প্রস্তাব দিয়েছেন। আর ২০২১-২২ অর্থবছরে বাজেট হিসেবে রাজস্ব ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়াবে জিডিপির ৬.৮ শতাংশ, ২০২০-২১-এর সংশোধিত বাজেটে এই ঘাটতি জিডিপির ৯.৫ শতাংশ। এই ঘাটতি পূরণে বাজার থেকে মোট ঋণ সংগ্রহের পরিমাণ দাঁড়াবে প্রায় ১২ লাখ কোটি টাকা। তবে অর্থমন্ত্রী জানিয়েছেন, ২০২৫-২৬-এর মধ্যে রাজস্ব ঘাটতি জিডিপির সাড়ে ৪ শতাংশে নামিয়ে আনা হবে।

বাজেটে সুখবরও দিয়েছিলেন অর্থমন্ত্রী। তিনি বলেছেন, করপোরেট করহার কমিয়ে বিশ্বের অন্যতম সর্বনিম্ন করা হয়েছে। আর সুবিধা বাড়িয়ে ছোট করদাতাদের রেহাই দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া বাজেটে উদ্যোক্তা, নারী, বয়স্ক জনগোষ্ঠীসহ কোন শ্রেণির জন্য কী কী সুবিধা রাখা হয়েছে, তারই বিবরণ রয়েছে।

জিডিপির আলোচনা দূরে থাকুক

বিগত বছরের ১১ জুন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল যে বাজেটটি দিয়েছিলেন, সেখানে শুরুতেই অর্থনীতিতে দেশের সেরা জিডিপি প্রবৃদ্ধি উপহার না দিতে পারার জন্য আক্ষেপের কথা ছিল। ১১০ পাতার বাজেট বক্তৃতায় তিনি বেশ কয়েকবার এই জিডিপির কথা উল্লেখ করেছেন।

নতুন বাজেটে জিডিপির আলোচনা থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দিয়েছেন বেশ কয়েকজন অর্থনীতিবিদ। কারণ, সময়টা জিডিপি প্রবৃদ্ধির নয়, বরং টিকে থাকার। সুতরাং প্রবৃদ্ধিমুখী বাজেটের কথা তুলে বাজেট আলোচনা অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। তা ছাড়া মানুষ আছে সীমাহীন কষ্টে। এ সময় প্রবৃদ্ধি আর মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির তথ্য অনেকের কাছেই পরিসংখ্যানের অসারতা প্রমাণ করবে।

বক্তৃতা ছোট হোক


সময়ের দিক থেকে ভারতের ইতিহাসে দীর্ঘতম বক্তৃতা দিয়েছিলেন বর্তমান অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমণ। ২০০০ সালে তিনি ২ ঘণ্টা ৪০ মিনিট বক্তব্য দিয়েছিলেন। তবে শব্দসংখ্যা বিচারে সবচেয়ে বড় বক্তব্যটি দিয়েছিলেন মনমোহন সিং, ১৯৯১ সালে। তাঁর বক্তৃতায় শব্দসংখ্যা ছিল ১৮ হাজার ৬৫০। তবে ব্যাপক সংস্কার শুরুর ব্যাপক পরিকল্পনার কথা এই বাজেটেই উল্লেখ ছিল। এ কারণেই এটি ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছে। আর নির্মলা সীতারমণের বক্তৃতায় শব্দসংখ্যা ছিল ১৩ হাজার ২৭৫। এবার অবশ্য নির্মলা সীতারমণ বক্তৃতার আকার কমিয়েছেন।

বাংলাদেশে চলতি অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতা ছিল ১৩০ পৃষ্ঠার। এর মধ্যে ১১০ পাতাজুড়েই অর্থমন্ত্রীর বক্তৃতা। বাজেট বক্তৃতা অনুযায়ী এর বড় অংশই হচ্ছে সরকারের কর্মপরিকল্পনা ও সম্পদ সঞ্চালনের দীর্ঘ বিবরণ। এই বিবরণের বড় অংশই ক্লান্তিকর। বেশির ভাগই জানা তথ্য, কেবল বিবরণ আর বিবরণ। অন্য কোনো দেশের বাজেট বক্তৃতায় এ ধরনের বিবরণ চোখে পড়ে না। অথচ ছোট এবং প্রয়োজনীয় তথ্যের বিবরণ থাকলেই বরং বাজেট নিয়ে সাধারণ মানুষের আগ্রহ বাড়বে।

চাই প্রয়োজনীয় তথ্য

করোনার বিপুলসংখ্যক মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জরিপ বলছে, আয় হারিয়েছে ৬০ শতাংশ মানুষ। কাজ হারিয়েছেন অনেকে। নতুন করে দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে বহু মানুষ। সরকার প্রণোদনা তহবিল থেকে ঋণ দিয়েছে। এই ঋণের বড় অংশ বড়রা বেশি পেলেও ছোটরা পেয়েছে কম।

চলতি বাজেটে সব শ্রেণির মানুষের জন্য যেসব উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল তার ফল কী হয়েছে, সরকারের কী মূল্যায়ন, কতটা বাস্তবায়িত হয়েছে, কার কতটা লাভ হয়েছে, কারা পিছিয়ে আছে—এসবেরই বিবরণ মানুষ জানতে চাইবে বাজেটে। বর্তমান সংকটের সময় বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের যত কাজ, সবকিছুর বিবরণ বাজেট বক্তৃতায় না দিয়ে বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের তথ্য দেওয়াটাই বেশি জরুরি।

বাংলাদেশের বাজেটের একটি গতানুগতিক চেহারা আছে। অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতাটি খুবই গতানুগতিক, অনাবশ্যকভাবে দীর্ঘ এবং ক্লান্তিকর। বাজেট তৈরির প্রক্রিয়াটিও গতানুগতিক।

স্বাস্থ্য কি অগ্রাধিকার?

মুখে মুখে স্বাস্থ্য খাতকে অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা বলা হয় ঠিকই, কিন্তু বাজেটে বরাদ্দ রাখা হয় প্রায় আগের মতোই। অগ্রাধিকারের কথা বললে, বরাদ্দে এর প্রতিফলন থাকা চাই। গত এক বছরে স্বাস্থ্য খাত নিয়ে যা যা করা হয়েছে, তার একটি মূল্যায়ন থাকা দরকার নতুন বাজেটে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কেন বাজেট ব্যয়ে পিছিয়ে, তারও কারণ জানানো চাই। গবেষণায় বরাদ্দ অর্থ ব্যবহার করতে না পারার কারণও জানতে চাইবে সাধারণ মানুষ। সুতরাং এ খাত নিয়ে গতানুগতিক বিবরণে আগ্রহ থাকবে না কারোই। বরং টিকার একটি রোডম্যাপ থাকা উচিত বলেই মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

পরিসংখ্যান দূরে থাকুক

ভারতসহ অন্য দেশের বাজেট বক্তৃতা পড়ে কত টাকার বাজেট তা জানার কোনো উপায় নেই। কিন্তু বাংলাদেশে থাকে এর বিস্তারিত বিবরণ। কেননা, ৬ লাখ কোটি টাকার বাজেট ঘোষণার মধ্যে অর্থমন্ত্রীর আত্মতৃপ্তি থাকে ঠিকই, কিন্তু তাতে সাধারণ মানুষের কিছু যায় আসে না। অন্যান্য দেশের বাজেট মূলত কার জন্য কী আছে সেই বিবরণই থাকে, বাজেটের পরিসংখ্যান সেখানে গুরুত্বপূর্ণ নয়। কারণ, ৬ লাখ কোটি টাকা মাথাপিছু বিতরণ করা হবে না। বরং সরকার যে অর্থ ব্যয় করবে, তার প্রভাব ও ফলটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

আলোচনা হোক ঘাটতি নিয়ে

অর্থনীতির স্বার্থেই বাজেট ঘাটতি জিডিপির ৫ শতাংশের মধ্যে সীমিত রাখার অলিখিত একটি নিয়ম রয়েছে। মনে করা হয়, এ পর্যন্ত ঘাটতি রাখা যেতে পারে। তবে ঘাটতির হার নয়, এখানে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ঘাটতি অর্থায়ন। যদি সহজ শর্তে ঋণ নিয়ে ঘাটতি পূরণ করা হয়, তাহলে আশঙ্কা কম। কিন্তু বেশি সুদের ঋণ নিলেই তা ভবিষ্যতে সংকট তৈরি করবে। যেমন সরকারি ব্যয়ে সবচেয়ে বড় খাত এখন সুদ পরিশোধ। বেশি সুদে ঋণ নিয়ে দায় যেমন বাড়ে, তেমনি বাড়ে মাথাপিছু ঋণের পরিমাণ। অর্থাৎ শেষ বিচারে তা সাধারণ মানুষের কাঁধেই পড়ছে।

ধরেই নেওয়া যায় এবার বাজেট ঘাটতি বাড়বে। এই ঘাটতি অর্থায়নের পরিষ্কার ব্যাখ্যা, এ প্রভাব ও ভবিষ্যতে কমিয়ে আনার পরিকল্পনার কথা অর্থমন্ত্রী সুস্পষ্টভাবে জানাবেন—এই সবার প্রত্যাশা।