ডিজিটাল অর্থের ব্যবহার যত বাড়বে, খরচও তত কমবে

দেশের সবচেয়ে বড় মোবাইল আর্থিক সেবা প্রতিষ্ঠান বিকাশ এক দশক পূর্ণ করল গত ২১ জুলাই। এই ১০ বছরের অগ্রযাত্রা, অভিজ্ঞতা, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাসহ নানা বিষয় নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন বিকাশের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা কামাল কাদীর। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন শওকত হোসেন।

কামাল কাদীরছবি: সাবিনা ইয়াসমিন
প্রশ্ন:

প্রথম আলো: বিকাশের এক দশক। ১০ বছরের যাত্রাটি কেমন ছিল?

কামাল কাদীর: আমাদের লক্ষ্য ছিল সাধারণ মানুষের আর্থিক লেনদেনকে সহজ করা, তাদের কষ্টগুলোকে কমিয়ে আনা। অর্থাৎ সাধারণ মানুষকে আর্থিক অন্তর্ভুক্তির মধ্যে নিয়ে আসতে হবে এবং এ থেকে কখনো বিচ্যুত হওয়া যাবে না। সরকারের দিক থেকেও কিন্তু আর্থিক অন্তর্ভুক্তির একটি লক্ষ্য ছিল এবং রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ছিল সবকিছু ডিজিটাল পদ্ধতির মধ্যে আনা। বিনিয়োগকারীসহ সবাই স্থির করেছিলাম যে আমরা এ কাজই ঠিকমতো করব। এই যে আমরা সবাই মিলে বিষয়টি স্থির করলাম, সেটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

যেহেতু নতুন একটি উদ্যোগ, তাই শুরুতে নিয়ন্ত্রণমূলক কাজে কিছু চ্যালেঞ্জ ছিল, যেগুলো পরবর্তী সময়ে দূর হয়েছে। এর ফলে নিয়ন্ত্রকদের নিয়ন্ত্রণও যেমন আরও দক্ষ ও শক্তিশালী হয়েছে, আমরাও এর দ্বারা উপকৃত হয়েছি। আমাদের প্রথম গ্রাহকেরা ছিলেন এমন সব মানুষ, যাঁরা ব্যাংকসেবার বাইরে ছিলেন। সহজ লেনদেনের উপায় হিসেবে গ্রাহকদের মধ্যে নিজের নামে একটি হিসাব বা অ্যাকাউন্ট খোলার বিষয়টিও পরে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এজেন্টের কাছে না গিয়ে নিজের হিসাবে টাকা লেনদেন করার পদ্ধতির ওপর আমরা জোর দিতে শুরু করি। আবার লেনদেনে ব্যাংককে কীভাবে যুক্ত করা যায়, সেটিও ঠিক করতে হয়েছে। বলা যায়, এভাবেই ধাপে ধাপে এগিয়েছে বিকাশ।

তবে আমার নিজের এবং আমাদের পরিচালনা পর্ষদের কাছে একটা বিষয় খুব স্পষ্ট ছিল যে সেবার মান ও গভর্ন্যান্স বা পরিচালনার ক্ষেত্রে কোনো আপস করা যাবে না। দেশে যে আইন ও বিধিমালা আছে, তা পরিপূর্ণভাবে পালন করতে হবে। আমাদের কাছে কখনো কোনো কিছু অস্পষ্ট মনে হলে তা আমরা নিয়ন্ত্রকের কাছে নিয়ে গেছি, কথা বলেছি। আমাদের প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল সবাই মিলে একটি ভালো প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা। এভাবেই আসলে ১০ বছর পার হয়ে গেছে।

ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন
প্রশ্ন:

প্রথম আলো: বিকাশের শুরুটা জানতে চাই।

কামাল কাদীর: আমি নিজেকে একজন উদ্যোক্তা মনে করি। আর নিয়মনীতির মধ্যে থেকেই কাজ করায় বিশ্বাসী। বিকাশ প্রতিষ্ঠার আগে ‘সেলবাজার’ নামে আমার পণ্য কেনাবেচার একটি ই-কমার্স সাইট ছিল। সেখানে কী পণ্য বিক্রি করা যাবে, আর কী কেনা যাবে—সেই তথ্য গ্রাহক পাচ্ছিলেন। কিন্তু কেনাবেচায় লেনদেনের কোনো ব্যবস্থা ছিল না। তবে মানুষের হাতে তখন মুঠোফোন ছিল। সহজ করে বলি, সে সময়ে একটি নকিয়া ফিচার ফোনের যে প্রসেসিং পাওয়ার ছিল, ১৯৬৯ সালে মানুষ যখন চাঁদে যায়, সে সময় নাসার কম্পিউটারের একই প্রসেসিং পাওয়ার ছিল। সুতরাং প্রশ্নটা ছিল, এই ক্ষমতাসম্পন্ন প্রযুক্তিটি কীভাবে ব্যবহার করা যায়। ইতিমধ্যে কেনিয়াতে মোবাইল মানি শুরু হয়ে গেছে। ২০০৮ ও ২০০৯ সালে আমি সেখানে অনেকটা সময় কাটালাম।

আতিউর রহমান বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হয়ে আসার পরে তিনি গরিব মানুষের জন্য কাজ করার কথা বললেন। এরপর আর্থিক অন্তর্ভুক্তির জন্য নীতিমালা করা হলো। আমিও তখন এ নিয়ে কাজ করা শুরু করলাম। এর আগে ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা স্যার ফজলে হাসান আবেদের সঙ্গে কথা বলেছি। তিনি উৎসাহ দিয়ে ব্র্যাককে প্ল্যাটফর্ম হিসেবে ব্যবহার করতে বললেন। কেনিয়ার অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, সেখানকার নিয়ন্ত্রণ বিধিমালার মধ্যে কিছু সমস্যা আছে। সেদিক থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের নীতিমালায় দুটো জিনিস পরিষ্কার করে রাখল। যেমন গ্রাহকের অর্থের নিরাপত্তা এবং অর্থের প্রবাহের ওপর তাদের পরিষ্কার ও দৃশ্যমান নিয়ন্ত্রণ থাকা। এ দুটি বিষয় ঠিক হওয়ার পর বাংলাদেশ ব্যাংক বলল একটি ব্যাংককে সহযোগী কোম্পানি হিসেবে রাখতে হবে। এরপর মানি ইন মোশন এলএলসি একটি প্রতিষ্ঠান ও ব্র্যাক ব্যাংক মিলে বিকাশ নামের কোম্পানি তৈরি করে লাইসেন্সের জন্য আবেদন করে ২০১০ সালে। এই বছরের ১২ এপ্রিল আমরা লাইসেন্স পাই। এর এক বছর দুই মাস পরে, ২০১১ সালের ২১ জুলাই যাত্রা শুরু করি। এরপর পর্যায়ক্রমে বিশ্বব্যাংক গ্রুপের প্রতিষ্ঠান আইএফসি বিকাশের অংশীদার হয় ২০১৩ সালে, পরের বছর বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন এবং ২০১৮ সালে আলিবাবা গ্রুপের অ্যান্ট ফাইন্যান্সিয়াল বিকাশের অংশীদার হয়।

টেলিফোন নেটওয়ার্কে প্রবেশাধিকার পাওয়া ও সব ব্যাংকের সঙ্গে কাজ করতে পারা ছিল আমাদের জন্য বড় অগ্রগতি।
কামাল কাদীর
ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর আতিউর রহমান জানতেন যে আমি কখনো কোনো সংক্ষিপ্ত রাস্তা ধরব না, কাজটির মধ্যে যেসব চ্যালেঞ্জ রয়েছে তা মোকাবিলায় নিয়ন্ত্রকের সঙ্গে আলোচনা করে সমাধানের পথ বের করব, কিন্তু কোনো চালাকি করব না।
প্রশ্ন:

প্রথম আলো: এই ১০ বছরের যাত্রায় কাদের কথা বলবেন, যাঁদের সহযোগিতা বা উৎসাহ ছাড়া এত দূর আসতে পারতেন না?

কামাল কাদীর: অবশ্যই আমি আমার বেশ কয়েকজন সহকর্মীর কথা বলব, যাঁদের ছাড়া এই পর্যন্ত আসা যেত না। স্যার ফজলে হাসান আবেদের কথা বলতে হবে। তিনি একবার বলেছিলেন, ‘কামাল তোমার বিকাশ দিয়ে যেদিন গরু-ছাগল কেনা হবে, সেদিন বুঝবে তুমি সফল হয়েছ।’ সেটিই কিন্তু এখন হচ্ছে। তবে তাতে আমাদের কাজ কিন্তু শেষ হয়ে যায়নি। আরও অনেক কিছু করতে হবে। আমার ভাই, ইকবাল কাদীরেরও একটি বড় ভূমিকা আছে, প্রভাব আছে। আমি অবশ্যই আমার মায়ের কথা বলব।

আমার যখন মাত্র ১৬ মাস বয়স, তখন আমি বাবাকে হারাই। তিনি একজন সক্রিয় ও রাজনীতি সচেতন মানুষ ছিলেন। ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু গ্রেপ্তার হলে তাঁর জামিনের জন্য যে আইনজীবীরা দাঁড়িয়েছিলেন, আমার বাবাও তাঁদের একজন ছিলেন। তিনি মারা যান ১৯৭২ সালে। তবে মৌলিক কিছু মূল্যবোধ নিয়ে মা আমাদের বড় করেছেন। সাতচল্লিশের দেশভাগ, বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, ৬ দফার ভূমিকা, দেশ কীভাবে স্বাধীন হলো—আমার মা ইতিহাসের এসব ঘটনা পরিষ্কারভাবে আমাদের মনে গেঁথে দিতে পেরেছেন, যার ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে আমার জীবন ও সমাজবোধ। আমার জীবনে তাঁর বিশাল ভূমিকা আছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর আতিউর রহমান জানতেন যে আমি কখনো কোনো সংক্ষিপ্ত রাস্তা ধরব না, কাজটির মধ্যে যেসব চ্যালেঞ্জ রয়েছে তা মোকাবিলায় নিয়ন্ত্রকের সঙ্গে আলোচনা করে সমাধানের পথ বের করব, কিন্তু কোনো চালাকি করব না।

আরও দুজনের কথা বলব। গ্রামীণ ব্যাংকের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক এম খালিদ শামস্ এবং গ্রামীণ ব্যাংকের সাবেক মহাব্যবস্থাপক, পরবর্তী সময়ে চেয়ারম্যান খন্দকার মোজাম্মেল হক। তৃণমূল মানুষের সঙ্গে কাজ করার একটা সার্বক্ষণিক তাড়না এই দুজন আমার মাঝে জন্ম দিয়েছিলেন।

ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন
প্রশ্ন:

প্রথম আলো: আপনাদের জন্য টার্নিং পয়েন্ট কোনটি ছিল?

কামাল কাদীর: আসলে আলাদা করে কোনো টার্নিং পয়েন্ট ছিল না। প্রতিদিন, প্রতিটা কাজই ছিল টার্নিং পয়েন্ট। তারপরও বলব, টেলিফোন নেটওয়ার্কে প্রবেশাধিকার পাওয়া ও সব ব্যাংকের সঙ্গে কাজ করতে পারা ছিল আমাদের জন্য বড় অগ্রগতি। আগে আমাদের একটা ব্যাংকে টাকা জমা রাখতে হতো। এ ক্ষেত্রে কিছু সমস্যা হচ্ছিল। কেননা, যে পরিমাণ টাকা জমা রাখতে হতো, তাতে এক ব্যাংক নীতি ঠিক বাস্তবসম্মত ছিল না। এর সঙ্গে অবশ্যই নিরাপত্তা ও দক্ষতার বিষয়টিও জড়িত ছিল। যখন আমরা বিষয়টি উপলব্ধি করলাম, তখন আমরা তা নীতিনির্ধারকদের কাছে বিস্তারিত তুলে ধরলাম। এরপর নীতিমালায় বদল হয়। এরপর আসব অ্যাপে যাওয়ার কথা। আমরা সব সময় গ্রাহকের চাওয়া ও তাঁদের নিরাপত্তার বিষয়ে সচেষ্ট থেকেছি। যেহেতু আমাদের অনেক গ্রাহকের ভাষাগত সীমাবদ্ধতা আছে, সুতরাং মাতৃভাষা ব্যবহার করে কোনো কিছু করা হলে তা গ্রাহকের জন্য সুবিধাজনক হয়। এ ছাড়া চোখে দেখার একটি গুরুত্ব আছে। অ্যাপ থাকায় এই দুই ক্ষেত্রেই অনেক সুবিধা হয়েছে। তবে শুরু থেকেই যদি আমরা অ্যাপের ওপর বেশি মনোযোগ দিতাম, তাহলে হয়তো মূল উদ্দেশ্য থেকে সরে যেতাম। সুতরাং শুরুতে কষ্ট করে, পরে যখন ধাপে ধাপে অ্যাপে এসেছি, তখন এর বড় প্রভাব পড়েছে। এরপরেও কিন্তু বিকাশ ব্যবহারকারীর দুই-তৃতীয়াংশ কিন্তু এখনো বেসিক ফোন ব্যবহার করছে।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: বিকাশ নামটা কোথা থেকে এসেছিল? এ রকম একটি বাংলা নাম রাখার গল্পটা শুনতে চাই।

কামাল কাদীর: আমি একটা বাংলা নাম দিতে চেয়েছিলাম। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর ও উপদেষ্টা আল্লাহ মালিক কাজেমী ‘ক্যাশ’ ও ‘টাকা’—এই দুই শব্দ ব্যবহার না করার উপদেশ দিলেন। তখন একটা সুন্দর নাম খুঁজতে লাগলাম। কোন কোন নাম নিবন্ধন করতে পারব, তা–ও নজরে আনলাম। দেখলাম, ইংরেজি অক্ষর ‘কে’ দিয়ে বিকাশ লিখলে তা নিবন্ধন করা যাবে। সুতরাং ‘প্রসপারিটি’, ‘প্রোগ্রেস’—এ রকম কিছু ইতিবাচক কথার বাংলা অর্থ ধরেই বিকাশ নামটা ঠিক করি। নামটি আমারই দেওয়া।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: একটি ব্যাংকের সহযোগী হতে হবে—এই নিয়মের গুরুত্ব আসলে কতখানি?

কামাল কাদীর: যেহেতু কেন্দ্রীয় ব্যাংক আমাদের নিয়ন্ত্রক সংস্থা, সেহেতু একটি ব্যাংকের সঙ্গে থাকাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে ব্যাংকের ৫১ শতাংশ মালিকানা থাকার বিষয়টি শুরুতে ঠিক ছিল। কিন্তু আজকের পরিস্থিতি ভিন্ন। এখন কিন্তু বিকাশ বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্ট ইউনিটের (বিআইএফইউ) কাছে সরাসরি রিপোর্ট করছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পেমেন্ট সিস্টেম বিভাগের (পিএসডি) দ্বারাও নিয়ন্ত্রিত।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখন বিকাশের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম হচ্ছে গ্রাহকের রাখা টাকার ন্যূনতম ২৫ শতাংশ ট্রেজারি বিলে রাখতে হবে; আমাদের এর চেয়ে বেশিই রাখা আছে। আর বাকি অর্থ কোনো একটি ব্যাংকে না রাখার লক্ষ্যে আমাদের পর্ষদ একটি ট্রেজারি পলিসিও তৈরি করে দিয়েছে। আমানত-ঋণের অনুপাতের ভিত্তিতে কোন ব্যাংকে কী পরিমাণ অর্থ রাখতে পারব, সেটাই এই নীতিমালার উদ্দেশ্য। এসব করা হয়েছে যাতে গ্রাহকের টাকা কোনো ধরনের ঝুঁকির মধ্যে না থাকে। আমরা এখন গ্রাহকের টাকা ১৬টা ব্যাংকে রাখছি। সুতরাং আমার মনে হয় ৫১ শতাংশ মালিকানা রাখার যে বাধ্যবাধকতা আছে, তা এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক পুনর্বিবেচনা করে দেখতে পারে। তবে আমি অবশ্যই মনে করি, এই খাত কেন্দ্রীয় ব্যাংক দ্বারাই পূর্ণ নিয়ন্ত্রিত হতে হবে।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: বিকাশের মালিকানায় বিশ্বের বড় বড় প্রতিষ্ঠান রয়েছে। তারা কি কেবল অংশীদার, না অন্য কোনো ভূমিকা আছে?

কামাল কাদীর: অংশীদার বাছাই এবং তাদের কী ধরনের ভূমিকা থাকবে, এ নিয়ে বিকাশ কিন্তু প্রথম থেকেই বেশ সতর্ক। যেমন ব্র্যাক ব্যাংক মূলত ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পকে (এসএমই) কেন্দ্র করে কার্যক্রম চালায়, আবার আর্থিক অন্তর্ভুক্তিকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেয়। ফলে ব্র্যাক ব্যাংকের যুক্ততা থেকে কেবল যে একটি ভালো পরিচালন ব্যবস্থা পেয়েছি তা নয়, বরং অন্তর্ভুক্ত হওয়ার একটি সংস্কৃতিও তাদের কাছ থেকে পেয়েছি। মানি ইন মোশন এলএলসি এর শুরুর উদ্যোক্তা। কোম্পানিটি মোবাইল আর্থিক সেবার ব্যবসাটি বোঝে, এমন লোকগুলোকে জড়ো করেছে। এমনিতে মোবাইল কোম্পানির সঙ্গে একটি সম্পর্ক মানি ইন মোশনের আগেই ছিল। এ ছাড়া কেনিয়ার মোবাইল মানি কোম্পানি এম-পেসা যিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, সেই নিকোলাস হিউজকেও মানি ইন মোশন বিকাশের পরিচালক হিসেবে নিয়ে এসেছে। তিনি এখনো পর্ষদে আছেন। এবার আসি আইএফসি প্রসঙ্গে। তারা বিশ্বব্যাপী ভালো ও দক্ষ পরিচালনা ব্যবস্থার জন্য বিখ্যাত। আমার মনে আছে, আইএফসি আসার পরেই তারা একটি ভালো করপোরেট পরিচালন ব্যবস্থা গড়ে তোলার ওপর গুরুত্ব দিয়েছে।

বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন আর্থিক অন্তর্ভুক্তি নিয়ে গবেষণা এবং এর বিদ্যমান প্রবণতা বা ধারা বিশ্লেষণে সম্পৃক্ত। বিশ্বের কোথায় কী ধরনের সেবা চলছে এবং তার ফল কী—এ নিয়ে তারা প্রতিনিয়ত কাজ করছে।

আমাদের পরিচালনা পর্ষদে একসময় বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ জামিলুর রেজা চৌধুরী ছিলেন। দেশীয় পরিবেশে প্রযুক্তির ব্যবহার নিয়ে তাঁর যে জ্ঞান, তা আমাদের অনেক কাজে লেগেছে। আর আলিবাবা গ্রুপ সেরা প্রযুক্তি ব্যবহার করে থাকে। এখন হিসাব খোলার আগে নিবন্ধনের জন্য আমরা যে বায়োমেট্রিক ফেসিয়াল রিকগনিশন সিস্টেম ব্যবহার করছি, এটা তাদের। সব মিলিয়ে আমাদের বিনিয়োগকারীরা অনেক বেশি সম্পৃক্ত, তবে তাঁরা কাজে কোনো হস্তক্ষেপ করেন না। ভবিষ্যতেও হয়তো আমরা বিশ্বের সেরা বিনিয়োগকারীদেরই আমন্ত্রণ জানাব, তবে অবশ্যই আমাদের কাজের ধরনের সঙ্গে প্রাসঙ্গিক হতে হবে। অর্থাৎ কেবল অর্থ থাকলেই হবে না, অর্থের সঙ্গে জ্ঞানটাও আসতে হবে।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: শুরুতে ছিল কেবল টাকা পাঠানো। এখন সব ধরনের বিলও দেওয়া যাচ্ছে, কেনাকাটা করা যাচ্ছে। জীবন অনেক সহজ হয়েছে। কিন্তু এরপরে কী? বিকাশের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাটা কী?

কামাল কাদীর: সরকারের দেওয়া লাইসেন্স অনুযায়ী এ সব কটিই কিন্তু আমাদের করার কথা। কিন্তু সবকিছু করতে গেলে সহায়ক প্রতিবেশটাও দরকার। যেমন শুরুতে ছিল বাড়িতে টাকা পাঠানো। কিন্তু বিল বা কেনাকাটা করতে হলে উভয় দিকেরই প্রস্তুতি দরকার। যেমন বিদ্যুৎ বিল দেওয়ার পর বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষকেও তো তা বুঝে পাওয়ার ফিরতি বার্তা দিতে হবে।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা যদি বলি, ধরুন একজন রিকশাচালক। তাঁর রিকশা ভেঙে গেছে, ঠিক করতে ঋণ দরকার। কিন্তু ব্যাংকে যদি তাঁর হিসাব না থাকে, ‘নো ইয়োর কাস্টমার-কেওয়াইসি’ ঠিক করা না থাকে, তাহলে তো কোনো ব্যাংক তাঁকে ঋণ দেবে না। টাকা লেনদেনের বাইরে এ ধরনের সেবা দিতে হলে এই কেওয়াইসি ঠিক থাকাটা খুবই দরকার। বিকাশ যেহেতু গ্রাহকের তথ্য যাচাই–বাছাই করে তা সংরক্ষণের ওপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়, সুতরাং একটি ব্যাংকের সঙ্গে সম্পর্ক থাকার কারণে বিকাশের গ্রাহক একজন রিকশাওয়ালাকে ঋণ দেওয়া সহজ হচ্ছে। এই ঋণ দিচ্ছে ব্যাংক, কিন্তু ঋণটা পৌঁছে যাচ্ছে বিকাশের মাধ্যমে। এটাকে বলছি ন্যানো ঋণসেবা, যা বিকাশ শুরু করেছে। ভবিষ্যতে এ ধরনের সেরা আরও বাড়বে। আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইডিএলসির সঙ্গে আমানত সংগ্রহের আরেকটি সেবা শুরু হয়েছে। এর মাধ্যমে কোনো গ্রাহক যদি দূর কোনো এলাকায় থাকেন, তিনি কিন্তু এখন বিকাশের মাধ্যমে নিজের আমানত জমা দিতে পারবেন। এমন না যে সব কাজ বিকাশকে করতে হবে। তবে বিকাশ যদি একটি সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে গ্রাহককে কোনো একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত করে দিতে পারে, তবে সেটাই হবে অত্যন্ত কার্যকরী একটি ব্যবস্থা।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: লেনদেনের খরচ অনেক বেশি বলে একটি অভিযোগ আছে বিকাশের বিরুদ্ধে। খরচ কমানো নিয়ে কি ভাবছেন?

কামাল কাদীর: যেখানেই সুযোগ পাচ্ছি, সেখানেই ক্যাশ আউট বা অর্থ তোলার ব্যয় কমানোর চেষ্টা করছি। এখন বিভিন্ন ব্যাংকের ১ হাজার ৫০০ এটিএম থেকে বিকাশের অর্থ তোলার ব্যবস্থা রয়েছে। এটিএম থেকে বিকাশ ব্যবহারের একটি সুযোগ করা হয়েছে। এতে খরচ পড়ছে প্রতি হাজারে ১৪ টাকা ৯০ পয়সা। এখন যদি কেউ বিকাশ অ্যাপ ব্যবহার করে, তাহলে কিন্তু টেলিফোন কোম্পানির খরচটা এড়াতে পারি, তখন অ্যাপে লেনদেনের খরচ পড়বে ১৭ টাকা ৫০ পয়সা। কিন্তু ডেটা বা ইউএসএসডিতে কল করে যখন লেনদেন করা হচ্ছে, তখন ব্যয় ১৮ টাকা ৫০ পয়সা। এটা আরও কমানোর জন্য কাজ করছি। তবে আমরা চাই গ্রাহক কোনো ক্যাশ আউট ফি না দিক। আর এটা করার মূল উপায় হচ্ছে অর্থটা ডিজিটালি ব্যবহার করা। যেমন কোনো বিল বা কেনাকাটার জন্য অর্থ পরিশোধ করলে কোনো খরচ নেই। কিন্তু যখনই ডিজিটাল মানি এজেন্টের কাছে গিয়ে তা নগদ অর্থে রূপান্তর করা হচ্ছে, তখনই খরচ লাগছে। এখন বিকাশের প্রায় তিন লাখ এজেন্ট আছে। অর্থ তুলে নেওয়া বা ক্যাশ আউটের ক্ষেত্রে যে আয় হয়, তার ৭৭ শতাংশই এজেন্ট ও পরিবেশককে দিয়ে দিচ্ছি। সাড়ে ৮ শতাংশ দিচ্ছি টেলিফোন অপারেটরকে। বাকি সাড়ে ১৪ শতাংশের ওপরই নির্ভর করছে আমাদের ব্যবসা পরিচালনা, বেতন-ভাতা, বিপণন, যোগাযোগ, এর প্রযুক্তি ব্যয়, লাভজনকতা, সবকিছু। তারপরেও আমরা চেষ্টা করছি গ্রাহকের খরচ কমানোর। এ জন্য প্রিয় নম্বর বলে একটি নতুন সেবা চালু করেছি, এতে একজন গ্রাহক ৫টি নম্বরে বিনা খরচে অর্থ পাঠাতে পারে। আমরা নিজেরাও গবেষণা করে দেখেছি, একজন গ্রাহক সাধারণত ৫টি নম্বরের বেশি টাকা তেমন পাঠায় না। প্রতি মাসে এই নম্বর আবার বদল করাও যাচ্ছে। অনেক গ্রাহকই এখন এটা ব্যবহার করছে। সুতরাং একজন গ্রাহক যত বেশি ডিজিটাল মানি ব্যবহার করবে, তার খরচও তত কমে আসবে।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: বাজারে বিকাশের অনেক প্রতিযোগী চলে এসেছে। প্রতিযোগী ও প্রতিযোগিতাকে আপনি কীভাবে দেখছেন?

কামাল কাদীর: প্রতিযোগিতা খুব ভালো একটি বিষয়, বিশেষ করে স্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতা। একে আমরা স্বাগত জানাই। সেবা চালুর ক্ষেত্রে বিকাশ বাংলাদেশে দ্বিতীয়। ডাচ্‌-বাংলা ব্যাংক বিকাশের আগে এই সেবা শুরু করেছিল। তবে মোবাইল আর্থিক সেবার ক্ষেত্রে বাজারে যত ধরনের সমস্যা আছে, তার সমাধানের ক্ষেত্রে বিকাশ মূল ভূমিকা নিয়েছে। এজেন্ট নিয়োগ, তাদের প্রশিক্ষণ, মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন নিয়ে এজেন্ট ও গ্রাহকদের ধারণা দেওয়া, লেনদেনে প্রতারণা প্রতিরোধ—সবই আমাদের করতে হয়েছে। যদিও প্রতারণা প্রতিরোধের কোনো ক্যাম্পেইন অন্য কোনো প্রতিযোগী প্রতিষ্ঠানকে এখনো করতে দেখিনি। কিন্তু প্রতারণা সব জায়গাতেই আছে। এ নিয়ে আমাদের কাজ করে যেতেই হবে। এমনকি আমরা প্রতারণা প্রতিরোধে একজন মনস্তত্ত্ববিদকেও নিয়োগ দিয়েছিলাম। তাঁর কাছ থেকেও আমরা অনেক কিছু শিখেছি। যেমন প্রতারকদের সঙ্গে কথা বলা চালিয়ে যাওয়া যাবে না, ফোনের লাইন কেটে দিতে হবে। কথা চালিয়ে গেলেই অনেকে কথার ফাঁদে আটকে যান। এ রকম একটি বিজ্ঞাপনও আমরা প্রচার করছি।

এই যে আমরা বিভিন্ন ধরনের কাজ করছি, আমাদের প্রত্যাশা অন্যরাও একইভাবে এগিয়ে আসবেন। আর কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই খাতটি নিয়ন্ত্রণে যে আইন ও বিধিমালা করেছে, শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত করেছে, বিএফআইইউও একটি নীতিমালা তৈরি করেছে, সব পক্ষ মিলে গঠিত টাস্কফোর্স ডিজিটাল কেওআইসির (নো ইয়োর কাস্টমার—নিজের গ্রাহককে জানো) গাইডলাইন তৈরি করে দিয়েছে—এগুলোকে যেন আমরা সম্মান করি। নইলে আস্তে আস্তে গড়ে তোলা একটি প্রাতিষ্ঠানিক চর্চা ও কাঠামো ঝুঁকির মধ্যে পড়বে।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: ১০ বছর তো হয়ে গেল। ১০ বছর পরে বিকাশকে কোথায় দেখতে চান, নিজেকেই–বা কোথায় দেখেন?

কামাল কাদীর: আমি চাই দেশের সব সাধারণ মানুষের জন্য বিকাশ হোক লেনদেনের অপরিহার্য সমাধান। আমরা চাই সব নিয়মকানুন মেনেই লেনদেন আরও অনেক সহজ হবে। হয়তো দেখা যাবে, একজন গ্রাহক ফোনটা মুখের সামনে ধরলেন, আর লেনদেন সম্পন্ন হয়ে গেল। এতে হয়তো নিয়মকানুন মানা হলো কি না, তা দৃশ্যমান হবে না। কিন্তু এমন একটি ব্যবস্থা থাকবে, যাতে পেছনে আসলে সবকিছুই সম্পন্ন হয়ে যাবে। আমরা সরকারের কর-রাজস্বের একটি বড় উৎস হতে চাই। আমরা নিজেদের মধ্যে একটি ভালো কর্মপরিবেশও বজায় রাখতে চাই। নিয়েলসনের সমীক্ষা অনুযায়ী, নতুন পেশাজীবীদের কাজ করার জন্য বিকাশ এরই মধ্যে অন্যতম সেরা জায়গা বলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ভবিষ্যতেও কাজ করার জন্য তরুণদের কাছে বিকাশই থাকবে সবচেয়ে সেরা জায়গা হিসেবে। সামনে আমরা আরও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে নতুন নতুন সেবা নিয়ে কাজ করতে চাই।

আর বর্তমানে বিকাশের কাজেই এত ব্যস্ততা, আমার নিজের অন্য কিছু করার আসলে সুযোগই নেই। তবে একদিন তো আমি অবশ্যই এখান থেকে চলে যাব। এ ক্ষেত্রে আমার আগ্রহের জায়গা হচ্ছে পরিবেশ। পরিবেশের ওপর কী কী ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে, সে বিষয়ে কিন্তু আমরা পরিষ্কার। পরিবেশ বাঁচাতে আমাদের সামনে ভবিষ্যতে সৃজনশীলভাবে অনেক কিছু করার থাকবে। এসবই আমাকে আকৃষ্ট করে।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: আমার শেষ প্রশ্ন কোভিড নিয়ে। এই মহামারি থেকে আপনারা কী শিক্ষা নিলেন?

কামাল কাদীর: কত দ্রুত নতুন একটি বিষয়ের সঙ্গে আমরা খাপ খাইয়ে নিতে পারব—সেটাই ছিল এ সময়ের বড় শিক্ষা। আমরা পারব না, এটা নয়। বরং কত দ্রুত পারব, সেটাই ছিল বড় বিষয়। কোভিড এই মৌলিক দিকটিই শিখিয়েছে। আমরা অফিসে না এসেও কাজ করতে পারা শিখেছি। আর এ সময়ে প্রতিটি কোম্পানি, এমনকি আমাদের মতো প্রযুক্তিনির্ভর কোম্পানিকেও আরও উচ্চতর প্রযুক্তি গ্রহণ করতে হয়েছে। এসবই করোনার শিক্ষা।

আসলে জীবনের বড় শিক্ষা হলো, একটি লক্ষ্য স্থির করতে হয়। একবার লক্ষ্য স্থির করা গেলে তারপর সেখানে যাওয়ার পথ খুঁজতে হয়। যেমন কম্পাসের উত্তর দিক একটাই, আমাদের লক্ষ্যও তেমনই এবং আমরা কখনোই এ লক্ষ্য থেকে সরে যাইনি। আমরা লক্ষ্য স্থির করেছিলাম, তারপর সেখানে ধাপে ধাপে পৌঁছেছি। সেভাবেই এগিয়েছে বিকাশ।