নিলুফা খাতুনের মাথাপিছু আয় বাড়ার গল্প

নিলুফা খাতুন ঢাকা শহরের গৃহকর্মীর কাজ ছেড়ে বাড়ি চলে গিয়েছিলেন গত বছরের ডিসেম্বরে। নিলুফার বাড়ি নাটোরের পাঙ্গাসিয়া গ্রামে। বৃদ্ধ মা-বাবা আছেন, তিন ভাই ও দুই বোনের সংসার। গ্রামে থাকতেই দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে করোনা। পোশাক কারখানার কাজ হারিয়ে গ্রামে ফিরে আসেন ভাইয়েরাও। মাথা গোঁজার জন্য ছোট্ট একটা ঘর ছাড়া কিছুই নেই তাদের। কাজ নেই, আয় নেই, তার ওপর ছিল বন্যা। পুরোটা সময় কেটেছে ধারকর্জ করে। গ্রামীণ ব্যাংক, স্থানীয় সমবায় সমিতি ও ব্যক্তি—এই তিন উৎস থেকে গত এক বছরে পুরো পরিবার ধার করেছে প্রায় দেড় লাখ টাকা। এখন সুদসহ আসল ফেরত দেওয়ার সময় এসেছে। এ কারণেই নিলুফা খাতুন আবার ঢাকায় ফিরে এসেছে গৃহকর্মীর কাজ নিয়ে।

করোনার সময়ে কোনো সরকারি সহায়তা পান নি নিলুফারা। তিনি নিজে শারীরিক প্রতিবন্ধী। প্রতিবন্ধী ভাতার তালিকায় তাঁর নাম আছে। ছয় মাস ঘুরে নানা জায়গা থেকে তদবির করে সরকারি ভাতার কিছু অংশ পেয়েছেন। তাও তদবির করার জন্য শুনতে হয়েছে ভর্ৎসনা। নিলুফাদের ঠকানো অবশ্য খুব সহজ। তারা জানেই না কত টাকা তার প্রাপ্য, আর হিসাবটাই বা কী। সরকারি কাগজে কলমে কিন্তু আছে আমাদের সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি অত্যন্ত সুফল। ভুলত্রুটি কিছু থাকলেও তা সামান্য।

হঠাৎ আয় বাড়ল যেভাবে

পুরো পরিবার নিয়ে নিলুফা খাতুন জীবনসংগ্রামে ব্যস্ত, পুরো পরিবার যখন উচ্চসুদের ঋণে ডুবে আছে, ঠিক তখনই হঠাৎ করে তার আয় বেড়ে গেছে ১৫৫ ডলার বা ১৩ হাজার ১৭৫ টাকা। এই হিসাবে পরিবারের ৭ সদস্যের আয় বেড়েছে ৯২ হাজার ২২৫ টাকা। এই অর্থ দিয়ে ঋণের বড় অংশ অনায়াসে পরিশোধ করতে পারত নিলুফা খাতুনেরা। আগস্ট মাসে আয় বাড়ার এই তথ্য জানতে পারলে নভেম্বরে হয়তো ঢাকায় ফিরে আসতে হতো না তাকে।

আরও পড়ুন

সমস্যা হচ্ছে, আয় যে বেড়েছে এটা নিলুফা খাতুন জানতেই পারেন নি। আয় বাড়ার এই তথ্য জানে কেবল সরকার। যেমন করোনাভাইরাসের কারণে অর্থনীতি প্রায় তিন মাস কার্যত অচল থাকলেও সরকারের কাগজ অনুযায়ী এ সময় বাংলাদেশের মানুষের বার্ষিক মাথাপিছু গড় আয় ২০০০ ডলার ছাড়িয়ে গেছে। অর্থাৎ ২০১৯-২০ অর্থবছর শেষে দেশের মানুষের মাথাপিছু গড় আয় দাঁড়ায় ২ হাজার ৬৪ ডলার, আগের অর্থবছরে যা ছিল ১ হাজার ৯০৯ ডলার। এর মানে হচ্ছে, মাথাপিছু গড় আয় এক বছরের ব্যবধানে ১৫৫ ডলার বেড়েছে। বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশি মুদ্রায় মানুষের মাথাপিছু আয় বছরে দাঁড়াচ্ছে গড়ে ১ লাখ ৭৫ হাজার টাকা। অর্থাৎ, মাসে গড় আয় প্রায় ১৪ হাজার ৬০০ টাকার মতো।

নিলুফা খাতুন যখন করোনাকালে তাদের জীবনযুদ্ধের এই কাহিনি বলছিলেন, তখন তাকে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ও মাথাপিছু আয়ের কাহিনি শুনিয়ে দিতে পারলে বেশ হতে। পরে মনে হলো, জটিল এসব তত্ত্বকথা বলে আসলে লাভ নেই। তার নিজের পকেটে কত টাকা এল, সেটাই আসল বিষয়। জিডিপি ৮ শতাংশ না ৫ শতাংশ, সেই বিতর্ক বোদ্ধা মহলেই কেবল টিকে থাকুক। তা ছাড়া চাণক্য তো বলেই গেছেন, ‘সর্বশূন্যা দরিদ্রতা’। অর্থাৎ যে দরিদ্র, তার সবকিছুই শূন্য। সুতরাং তাদের এত কিছু বোঝার দরকার কী। সরকারি খাতায় মাথাপিছু আয় বেড়েছে এটাই যথেষ্ট।

জিডিপি ও মাথাপিছু আয় কী

তত্ত্ব অনুযায়ী একটি হচ্ছে মোট জাতীয় উৎপাদন বা জিএনপি। অন্যটি হচ্ছে মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি। কোনো নির্দিষ্ট সময়ে সাধারণত এক বছরে কোনো দেশের জনগণ মোট যে পরিমাণ চূড়ান্ত দ্রব্য বা সেবা উৎপাদন করে, তার অর্থমূল্যকে মোট জাতীয় উৎপাদন বলে। জাতীয় উৎপাদনের মধ্যে দেশের অভ্যন্তরে বসবাসকারী ও কর্মরত বিদেশি ব্যক্তি ও সংস্থার উৎপাদন বা আয় অন্তর্ভুক্ত হবে না। তবে বিদেশে বসবাসকারী ও কর্মরত দেশি নাগরিক, সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন বা আয় অন্তর্ভুক্ত হবে।

অর্থনীতি সচল হয়েছে। জিডিপিও বাড়বে। যেমন ধরেন, করোনার সময় গণপরিবহনে চড়বেন না বলে অথবা ড্রাইভার ছেড়ে দিয়েছিলেন বলে দুই কিলোমিটার হেঁটে যেতেন। হাঁটা তো স্বাস্থ্যে জন্যও ভালো। কিন্তু তাতে জিডিপির কোনো লাভ নেই।

আর জিডিপি হচ্ছে কোনো নির্দিষ্ট সময়ে, সাধারণত এক বছরে কোনো দেশের অভ্যন্তরে বা ভৌগোলিক সীমানার ভেতর বসবাসকারী সব জনগণ কর্তৃক উৎপাদিত চূড়ান্ত পর্যায়ের দ্রব্যসামগ্রী ও সেবাকর্মের অর্থমূল্যের সমষ্টি। অর্থাৎ ভৌগোলিক সীমানার মধ্যে বসবাসকারী দেশের সব নাগরিক ও বিদেশি ব্যক্তি, সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের উৎপাদিত চূড়ান্ত পর্যায়ের দ্রব্যসামগ্রী ও সেবাকর্মের মূল্য অন্তর্ভুক্ত হবে। তবে বিদেশে অবস্থানকারী ও কর্মরত দেশের নাগরিক, সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের আয় অন্তর্ভুক্ত হবে না।
আর একটি দেশের মোট আয়কে জনসংখ্যা দিয়ে অর্থাৎ মাথাপিছু ভাগ করে দেওয়া হয়। একেই বলে মাথাপিছু আয়। মাথাপিছু গড় আয় কোনো ব্যক্তির ব্যক্তিগত আয় নয়।

আরও পড়ুন

যেমন ধরা যাক, ধরা পড়ার আগে মোহাম্মদ শাহেদ করোনা পরীক্ষার জাল সার্টিফিকেট দিয়ে ২ কোটি টাকা মুনাফা করেছেন। আবার নিলুফা খাতুনের পাশের জমির মালিক আয় হারিয়ে জমি বিক্রি করে অন্ন-বস্ত্রের সংস্থান করেছেন। জমি নিবন্ধন যে বেড়েছে সে সংবাদ তো প্রকাশ হয়েছেই। আবার স্বাস্থ্য সুরক্ষার ১০০ টাকার পণ্য ১০০০ টাকায় বিক্রি করা মানেই তো অর্থ লেনদেন বৃদ্ধি। এখন সবার আয় গড় করলে মাথাপিছু আয় তো বাড়বেই। যদিও জিডিপির হিসাব নিয়ে প্রবল সংশয় সব মহলেরই আছে। গন্ডগোল আসলে গড় নিয়েই।

গড় নিয়ে গড়বড়

একবার পাঞ্চ পত্রিকায় লেখা হয়েছিল, ‘সরকারি পরিসংখ্যান থেকে জানতে পারলুম, এ দেশের প্রত্যেকটি পূর্ণবয়স্কা স্ত্রীলোকের গড়পড়তা ২ দশমিক ২টি করে সন্তান আছে। আমরা বলি কি, ওই দশমিক ভগ্নাংশ বাচ্চা নিয়ে মেয়েদের নিশ্চয়ই ভারি অসুবিধে হচ্ছে, সরকার থেকে সাহায্য-টাহায্য দিয়ে আরও দশমিক ৮ সন্তান প্রসব করার জন্য উৎসাহ দেওয়া উচিত, যাতে করে প্রত্যেকটি মায়ের ছেলেপুলের সংখ্যা ভাঙাচোরা না থেকে গোটা গোট হতে পারে।’

গড়ের গন্ডগোল বুঝতে আরও সহজ এক গল্প বলা যায়। ধরা যাক, এক লোক ১০০ ডিগ্রি গরম ওভেনে মাথা ঢুকিয়ে রাখল। আর পা দুটি থাকল জিরো ডিগ্রি ঠান্ডায় এক ফ্রিজারে। তাহলে গড় ডিগ্রি কত? সহজ উত্তর: ৫০।
প্রতীকী ছবি

গড়ের গন্ডগোল বুঝতে আরও সহজ এক গল্প বলা যায়। ধরা যাক, এক লোক ১০০ ডিগ্রি গরম ওভেনে মাথা ঢুকিয়ে রাখল। আর পা দুটি থাকল জিরো ডিগ্রি ঠান্ডায় এক ফ্রিজারে। তাহলে গড় ডিগ্রি কত? সহজ উত্তর -৫০। সুতরাং রিজেন্টের সাহেদদের ২ কোটি টাকা আয় বৃদ্ধি ও নিলুফা খাতুনের না খেয়ে থাকার গড় করলে কিন্তু বড়সড় একটা ভালো প্রবৃদ্ধির হিসাব মিলবে।

এই গড় নিয়ে গড়বড়ের জন্যই করোনার নয় শতাংশীয় পয়েন্ট দারিদ্র্য হার বেড়ে গেলেও মাথাপিছু আয় ঠিকই বেড়ে যায়। তবে সব দোষ গড়কে দিলে অবশ্য হবে না। আসলে গন্ডগোলটা গোড়ায়। আর সেটা হলো প্রবৃদ্ধির নেশা। অর্থনীতির মধ্যে সবচেয়ে বড় নেশা হচ্ছে জিডিপির নেশা। সমস্যা হচ্ছে, অর্থনীতিবিদেরা এই নেশায় মোটেই নেশাগ্রস্ত নন, যতটা নেশাগ্রস্ত ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতিকেরা।

অর্থনীতি সচল হয়েছে। জিডিপিও বাড়বে। যেমন ধরেন, করোনার সময় গণপরিবহনে চড়বেন না বলে অথবা ড্রাইভার ছেড়ে দিয়েছিলেন বলে দুই কিলোমিটার হেঁটে যেতেন। হাঁটা তো স্বাস্থ্যের জন্যও ভালো। কিন্তু তাতে জিডিপির কোনো লাভ নেই। এখন গাড়িতে চড়ছেন, ড্রাইভার আছে, জ্যামে বা মেট্রো রেলের কারণে রাস্তায় বাড়তি বসে থাকতে হচ্ছে। এতে জ্বালানি খরচও বাড়ছে। বাড়বে জিডিপি। সুতরাং সামনে আসছে নিলুফা খাতুনদের জন্য সুখবর। অর্থমন্ত্রীর কাঙ্ক্ষিত ৮ শতাংশের বেশি জিডিপি প্রবৃদ্ধি হলে তো কথাই নেই। আবারও বাড়বে নিলুফা খাতুনের মাথাপিছু আয়। যদিও আগামী দুই বছরের আয়ের সবটাই তাকে দিয়ে দিতে হবে করোনার সময় করা ধারদেনা মেটাতে।
তাতে কী। সরকারি হিসাব বলে কথা।

আরও পড়ুন