ব্যাংকে আগেও মাফিয়া ছিল, এখন বেড়েছে

খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ।
খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ।
>

ব্যাংক খাত আছে নাজুক অবস্থায়। কেন এ অবস্থা, উত্তরণের পথ কী, বাজেটে কী নেই-এসব নিয়ে লিখেছেন ব্যাংক খাতের একজন বিশেষজ্ঞ।

ব্যাংক খাত এক নাজুক পরিস্থিতিতে পড়েছে। তবে এটা স্বাভাবিক পরিণতি ছিল না। বেশ কিছুদিন ধরে, বিশেষ করে বর্তমান অর্থমন্ত্রী দায়িত্ব নেওয়ার পর সংস্কারের নামে যেসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, তার সবই ছিল ‘কুসংস্কার’। একটি বিশেষ গোষ্ঠীকে ব্যাংক থেকে সুবিধা দেওয়ার জন্য এসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এ কারণে আজকের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। ব্যাংকগুলো বেতন কমানো, চাকরি ছাঁটাইয়ের মতো উদ্যোগ নিচ্ছে। আর্থিক অবস্থাও খারাপ হয়ে পড়েছে।

তবে আগের অর্থমন্ত্রীর সময়েও ব্যাংক খাতের অবস্থা যে খুব ভালো ছিল, তা বলা যাবে না। আগের অর্থমন্ত্রী অনিয়মে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতেন না, কিন্তু নিজেও তাঁদের থেকে কোনো সুবিধা নিতেন না। এখন অর্থ মন্ত্রণালয়কে কেন্দ্র করে একটা চক্র গড়ে উঠেছে, যাঁরা পুরো খাতটিকে ঝুঁকিতে ফেলে দিয়েছেন। এতে আমানতকারীদের অর্থও ঝুঁকিতে পড়েছে। এ বিষয়ে কেউ মনোযোগ দিচ্ছে না। সরকারের কেউ মুখ খুলছে না, আর বাংলাদেশ ব্যাংক তো সাহসই করবে না।

সরকারি ব্যাংকগুলো আগে থেকেই খারাপ ছিল। এখন বেসরকারি ব্যাংকগুলোর অবস্থাও কিছুটা সরকারি ব্যাংকের মতো। বেসরকারি ব্যাংকের এই অবস্থা এক দিনেই হয়নি। বিএনপি সরকারের সময় শুরু হয়েছে। আর বর্তমান সরকারের সময়ে তা চূড়ান্ত রকম খারাপ হয়ে পড়েছে। দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকায় একই ব্যক্তিরা লুটপাট করছেন। তাঁরা নানান কায়দায় ব্যাংক থেকে টাকা বের করেছেন। সব সময় সরকারের কাছের কিছু ব্যক্তি ব্যাংক থেকে লুটপাট করে। এখনো তাই চলছে।

ক্ষমতাসীন ব্যক্তিদের আশপাশে থাকা ব্যক্তিরাই বিভিন্ন নামে লুটপাট করছেন। এভাবে ব্যাংকগুলো দুর্বল করে ফেলা হচ্ছে। এ জন্য একটা জোট গড়ে উঠেছে, এতে সহায়তা দিচ্ছে সরকার। আর ব্যাংকের মালিক দাবি করা কিছু পরিচালক এসব সুবিধা আদায় করে নিচ্ছেন। তাঁরা তো ব্যাংকের আসল মালিক নন। ব্যাংকের আসল মালিক আমানতকারীরা। এর মাধ্যমে চার-পাঁচটি পরিবারের সঙ্গে সরকারের ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়েছে। তারা মালিক সমিতির নামে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে চাঁদা তুলে সরকারকে দিচ্ছে। সরকারও তাদের ব্যবহার করছে। বিনিময়ে তারা সরকারের কাছে আইনকানুন ও বিভিন্ন নীতিমালা শিথিল করে নিচ্ছে।

এটা একটা অদ্ভুত ব্যাপার, আগে শুধু সহায়তা দিত। এখন তারা আইনকানুন, নীতিমালা পরিবর্তন করে নিচ্ছে। এটা একধরনের লেনদেনের মতো হয়ে গেছে। ব্যাংক কিন্তু এই কথিত মালিকদের টাকায় চলে না। তাদের টাকার পরিমাণ ১০ শতাংশও নয়, বাকি টাকা আমানতকারীদের। আমানতকারীদের পক্ষে থাকার কথা ছিল সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের।

এই কথিত মালিকেরা ব্যাংকগুলোকে নিজেদের আয়ত্তে রাখতে একই পরিবার থেকে চারজন পরিচালক ও টানা তিন মেয়াদে পদে থাকা দাবি জানান। বাংলাদেশ ব্যাংক কিন্তু প্রথমে এতে আপত্তি জানিয়েছিল। এরপরও সরকার তাঁদের কথামতো আইন পরিবর্তন করে দেয়। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, একটি পরিবারের পাঁচ সদস্য প্রথম প্রজন্মের একটি ব্যাংকের পরিচালক পদে রয়ে গেছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকও তাঁদের কিছু বলছে না, সরকার তো বলবেই না। তাই মনে হচ্ছে কিছু পরিবারের কাছে সরকার একধরনের জিম্মি। তাঁদের চাওয়ামতো সবকিছু করতে হচ্ছে সরকারকে।

আমি যখন ডেপুটি গভর্নর ছিলাম, তখনো ব্যাংক খাতে এমন মাফিয়া ছিল। এখন তা কয়েক গুণ বেড়েছে, আরও বেপরোয়া হয়ে পড়েছে। তবে আমরা (গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনসহ) যখন দায়িত্বে ছিলাম, তখন আমানতকারীদের বিরুদ্ধে কিছু হলে আমরা উদ্যোগ নিতাম। প্রকাশ্যে কিছু বলতাম না, তবে চেষ্টা করতাম সরকারের নজরে আনার। এতে সরকারও আমানতকারীদের পক্ষে সিদ্ধান্ত নিত।

এখন পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংককে সরকার করায়ত্ত করে ফেলেছে। অথচ বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডার-১৯৭২ অনুযায়ী, আইনিভাবে সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো বৈঠক হওয়ার সুযোগ নেই। যা হবে তা সমন্বয় বা কো–অর্ডিনেশন কমিটির মাধ্যমে হতে হবে। আগে আইন লঙ্ঘন হতো না, এখন প্রতিনিয়ত হচ্ছে। অর্থমন্ত্রী তো গভর্নরের সঙ্গে প্রতিনিয়ত কথা বলতে পারেন না। সমস্যার উৎপত্তি এখানেই।

গভর্নর যদি স্বাধীনচেতা না হন, তাহলে আমাদের মতো দেশে এখন যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করা কঠিন। ভারতের গভর্নর তো পদত্যাগই করেছেন। তাই কাকে গভর্নর বানানো হচ্ছে, এটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের গভর্নরকে তো মালিকেরা হোটেলে ডেকে নিয়ে সুবিধা আদায় করে নিয়েছেন। শুধু সুবিধা নয়, এটা এমন সুবিধা, যা কেন্দ্রীয় ব্যাংক নানা গবেষণা করে কমিয়ে বা বাড়িয়ে থাকে। এটা শুধু গভর্নরের জন্য অপমানজনক নয়, একটা নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে টেনে নিচে নামানোর মতো।

গভর্নর যেহেতু স্বাধীনচেতা নন, তাই সরকারকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে কোনো হস্তক্ষেপ না করার বিষয়ে। শুধু তাই নয়, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর নিয়োগেও স্বচ্ছতা আনতে হবে। এখন তো ব্যবসায়ীরা ঠিক করছেন, কে ডেপুটি গভর্নর হবেন। তাই পুরো প্রতিষ্ঠানটি তাঁদের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। এ জন্য স্বচ্ছ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যোগ্যদের নিয়োগ দেওয়া উচিত।

পরিস্থিতি দেখে মনে হয়, সরকারকে ব্যাংকমালিকেরা করায়ত্ত করে ফেলেছে। এ কারণে একটি ব্যাংকের মালিকেরা অন্য আরেকটি ব্যাংকের পরিচালকদের গুলি করে, জিম্মি করে নির্যাতনের মতো ঘটনা ঘটে। ব্যাংকের সব মালিক কিন্তু এমন খারাপ নয়। পাঁচ-সাতটি পরিবার আছে, যারা সরকারকে জিম্মি করে ফেলেছে।

আগের আওয়ামী লীগ সরকার আর এখনকার সরকারের মধ্যে বিস্তর ফারাক। মনে হবে, একে অপরের শত্রু। এর কারণ, জনগণের দ্বারা নির্বাচিত হওয়ার আলাদা একটা শক্তি আছে। সেই শক্তি বর্তমান সরকারের নেই। এ জন্য তারা এই ব্যাংকমালিকদের কাছেও জিম্মি হয়ে পড়ছে। ক্ষমতায় আসার জন্য আওয়ামী লীগ জনগণের ওপর নির্ভর করছে না। এ কারণে জনগণের প্রতি কোনো দায়বদ্ধতাও নেই। ফলে সাধারণ আমানতকারীরাও বিপদে। এখনকার সরকার খেলাপিবান্ধব। এ জন্য খেলাপিদের দফায় দফায় নানা সুযোগ দেওয়া হয়।

ব্যাংক খাতের সংস্কার নিয়ে সাবেক অর্থমন্ত্রী উদ্যোগ নিয়েছিলেন। বর্তমান অর্থমন্ত্রীও প্রথম বাজেটে বলেছিলেন। এবারের বাজেটে তা নেই। এর কারণ, এসব আলোচনা শুরু হলে কিছু কথাবার্তা আসবে। এসব শুনতেও রাজি নয় সরকার। এখন সরকার শুধু সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেবে, আর সবাই তা মেনে নেবে। বর্তমান অর্থমন্ত্রীর কাছে ব্যাংক সংস্কার নিয়ে কোনো উদ্যোগ আশা করি না। কারণ, এমন কিছু সিদ্ধান্ত তিনি নিয়েছেন, যা সংস্কারের পরিপন্থী। সুদহার নির্দিষ্ট করে দিয়ে তিনি বাজারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। যাঁরা অবৈধ টাকায় ধনী হয়েছেন, সরকার তাঁদের প্রতিনিধি। এ জন্য ঋণের সর্বোচ্চ সুদ ৯ শতাংশ বেঁধে দেওয়া হয়েছে, কিন্তু আমানতের সুদের সর্বনিম্ন কোনো হার বেঁধে দেওয়া হয়নি। তার মানে আমানতকারীরা গোল্লায় যাক, শুধু বেঁচে থাকুক ধনিকগোষ্ঠী।

সরকার যদি ব্যাংক খাত সংস্কার করতে চায়, তাহলে বর্তমান অর্থব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত সবাইকে সরিয়ে দিতে হবে। পেশাদার লোকদের নিয়োগ দিতে হবে। পরামর্শ নিতে হবে পেশাদারদের থেকে, তবে তাঁরা আওয়ামীপন্থী হবেন। নিশ্চয়ই আওয়ামীপন্থী অর্থনীতিবিদেরা সরকারকে ভুল পরামর্শ দেবেন না।

এবার যে বাজেট ঘোষণা হয়েছে তা সত্যনির্ভর নয়, কল্পনানির্ভর। অর্থমন্ত্রীকে এখন কবিই বলতে হয়। তাঁর মনোভাবে যা রচিত হয়েছে, উনি তাই বাজেটে তুলে দিয়েছেন। এই বাজেট আলোচনাযোগ্যও হয় না। তিনি আয় কোথা থেকে করবেন তা জানেন না, ব্যয় করতে থাকবেন। এভাবে চললে তো দেশ দেউলিয়া হয়ে যাবে। এতে দেশের ১৬ কোটি মানুষ দেউলিয়ার মধ্যে পড়ে যাবে। তাই বলতেই হয়, আমরা বড় দুর্দিনে আছি। এই দুষ্ট চক্রের হাত থেকে আমাদের রক্ষা করতে পারেন একমাত্র প্রধানমন্ত্রী। আমরা এখনো সেই অপেক্ষায়।

খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ: সাবেক ডেপুটি গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক