ভোগ্যপণ্যের ব্যবসায় নেই ৬৩০ প্রতিষ্ঠান

২০১০ সাল। চাল আমদানিতে তখন ভালো মুনাফা। খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ী নুরুল আলমও কয়েকটি চালানে তুলে নেন পাঁচ কোটি টাকা মুনাফা। এরপর ব্যাংক গম, ডাল, চিনির পাশাপাশি চাল আমদানির জন্য আরও অর্থায়ন করে তাঁর প্রতিষ্ঠানকে। তবে দেশে আনার পর দর পড়ে যায় এসব পণ্যের। ওই বছর তাঁর মোট লোকসান হয় ৬৫ কোটি টাকা।
ভোগ্যপণ্যের ব্যবসা থেকে সরে আসার কাহিনি বর্ণনা করে প্রথম আলোকে নুরুল আলম বলেন, ‘১৯৮৪ সালে ব্যবসা শুরু করেছিলাম। লাভ-লোকসান ছিলই। তবে ২০১০ সালে ধাক্কা খাওয়ার পর আরও দুই বছর ব্যবসা চালু রেখেছিলাম। ২০১২-১৩ অর্থবছরের পর আর চালানো যায়নি।’
বন্দর ও কাস্টমসের নথিপত্রে দেখা যায়, এ জামান অ্যান্ড ব্রাদার্স, এ আর ট্রেডিং ও গ্রেস ট্রেডিং—এই তিনটি প্রতিষ্ঠানের নামে পণ্য আমদানি করেছিলেন নুরুল আলম। এই তিন প্রতিষ্ঠানের নামে ২০১০-১১ অর্থবছরে সর্বোচ্চ ২৮৭ কোটি টাকা মূল্যের প্রায় ৮০ হাজার মেট্রিক টন চাল, ডাল, চিনি ও গুঁড়া দুধ আমদানি হয়।
চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে গত এক দশকে প্রায় ৪৫ হাজার আমদানি চালানের নয় ধরনের সাধারণ তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এ তিন প্রতিষ্ঠানের মতো ২০০৫-০৬ থেকে ২০১৫-১৬ অর্থবছর পর্যন্ত ১০ বছরের ব্যবধানে সয়াবিন ও পাম তেল, গম, চিনি, মটর, মসুর ও ছোলা—এই সাতটি পণ্য আমদানি থেকে ব্যবসা গুটিয়েছে ৬৩০টি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে একই শিল্প গ্রুপের একাধিক প্রতিষ্ঠানও রয়েছে। প্রতিবছর ভোগ্যপণ্য আমদানিতে যেমন নতুন প্রতিষ্ঠান যুক্ত হচ্ছে, তেমনি ছিটকে পড়ছে পুরোনো অনেক প্রতিষ্ঠানও।
আমদানি তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০০৫-০৬ অর্থবছরের পর গত এক দশকে ভোগ্যপণ্য আমদানি বাড়লেও প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা কমেছে। ২০০৫-০৬ অর্থবছরে ১৬৪টি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান (একই শিল্পগোষ্ঠীর একাধিক অঙ্গপ্রতিষ্ঠান একটি ধরে) ৩৩ লাখ ৬৪ হাজার টন পণ্য আমদানি করে। গত অর্থবছর ১২৭টি প্রতিষ্ঠান আমদানি করেছে ৮৫ লাখ ২০ হাজার টন পণ্য। এ সময়ের মধ্যে আমদানিকারকের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি ছিল ২০০৭-০৮ ও ২০০৯-১০ অর্থবছরে। মোট ২৪০টি প্রতিষ্ঠান ছিল আমদানিতে। আবার এক দশক আগে শীর্ষ পাঁচ আমদানিকারকের হাতে ছিল মোট আমদানি পণ্যের ৫৯ শতাংশ। এই অংশীদার প্রতিনিয়ত বাড়ছে। গত অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৭১ শতাংশ। আমদানিকারকের সংখ্যা যত কমছে, শীর্ষ আমদানিকারকদের বাজার অংশীদারিও তত বাড়ছে।
অর্থনীতিবিদ ও ইস্ট ডেল্টা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মুহাম্মদ সিকান্দার খান প্রথম আলোকে বলেন, ভোগ্যপণ্য আমদানিতে বিশেষ করে অভিজ্ঞ ব্যবসায়ীদের না থাকাটা বাজারের জন্য ভালো নয়। কারণ, এতে ভোক্তারা সুফল পাবে না। তবে যাঁরা দীর্ঘদিন ধরে এ ব্যবসায় আছেন, তাঁরা নিশ্চয় সাহসী। সরবরাহকারী ও ব্যাংকের বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করতে পেরেছে বলে তাঁরা বাজারে আছেন। ব্যবসায়ীরা যাতে বাজার ছেড়ে না যান, সে জন্য এ ব্যবসার অনুকূল পরিবেশ থাকতে হবে।
প্রসঙ্গত, বেসরকারি খাতে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে এই সাতটি ভোগ্যপণ্যের ৯৫ শতাংশের বেশি আমদানি হয়। সরকারি খাতে কার্যত গম আমদানি হয়, যা গত অর্থবছর মোট আমদানির প্রায় ১০ শতাংশ ছিল। সাতটি আমদানিপণ্যের মধ্যে সয়াবিন ও পাম তেল প্রায় আমদানিনির্ভর, চিনি ও ডাল উৎপাদিত হলেও দেশের চাহিদার তুলনায় কম।
ব্যবসায়ীরা জানান, ঋণপত্র খোলার পর থেকে দেশে পণ্য আনতে দেশভেদে ১৫ দিন থেকে দেড় মাস সময় লেগে যায়। ভোগ্যপণ্যের দর প্রতি ঘণ্টায় বা প্রতিদিন ওঠা-নামা হয়। দীর্ঘ সময় লাগার কারণে ব্যবসায়ীরা ঠিকমতো পূর্বাভাস করতে না পারলে বাজারে টিকে থাকাও কঠিন হয়ে পড়ে।
ব্যবসায়ীদের দাবি অনুযায়ী, ভোগ্যপণ্য সবচেয়ে বড় ধাক্কা আসে ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে। তখন বিশ্ববাজার ছিল অস্থির। ব্যাংক কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ীদের সূত্র জানায়, ২০০৮ থেকে ২০১০ সালে যাঁরা বড় ধরনের লোকসানে পড়েছেন, তাঁরা তা পুষিয়ে নিতে ভিন্ন কৌশল নেন। অনেকে পণ্য বিক্রি করে ব্যাংকের ঋণ শোধ না করে জমি, শেয়ারবাজারসহ অন্য খাতে টাকা বিনিয়োগ করেছেন। অনেকে লোকসানে পড়ে ব্যাংকের কর্মকর্তাদের যোগসাজশে পণ্য বিক্রি করে কোনো টাকাই ফেরত দেননি। উল্টো আমদানি কার্যক্রম বন্ধ করে দেন। আবার গুটি কয়েক শিল্পগোষ্ঠীর অনেকে এ ব্যবসা থেকে সরে এলেও অন্যদিকে ব্যবসা সম্প্রসারণ করেছে।
কমছে আমদানিকারকের সংখ্যা
ছিটকে পড়া প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ছোট ও মাঝারি প্রতিষ্ঠানই বেশি। এদের বেশির ভাগই চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জকেন্দ্রিক। এর বাইরে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, রাজশাহী ও বগুড়ার প্রতিষ্ঠান রয়েছে।
ছোট ও মাঝারি পুঁজির প্রতিষ্ঠানগুলো বাজার থেকে সরে আসার কারণ ব্যাখ্যা করে পণ্য আমদানির দ্বিতীয় শীর্ষ অবস্থানে থাকা মেঘনা গ্রুপের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোস্তফা কামাল বলেন, ‘বড় পরিমাণে ভোগ্যপণ্য আমদানিতে খরচ কম পড়ে, পরিমাণ কম হলে খরচ পড়ে বেশি। খরচ বেশি হওয়ায় ছোট আমদানিকারকেরা স্বাভাবিকভাবেই বাজারে টিকতে পারে না। এটি বিশ্বজুড়ে হচ্ছে। এখন বড় বিনিয়োগ ছাড়া ভোগ্যপণ্য ব্যবসায় টিকে থাকা কঠিন।’
পিএইচপি গ্রুপ ২০০৬-০৭ অর্থবছরে ভোগ্যপণ্যের বাজারে আসে। ভোগ্যপণ্যের বাজারে মাত্র তিন বছর স্থায়িত্ব ছিল এই গোষ্ঠীটির। এ তিন বছরে ৬৮৩ কোটি টাকার ২ লাখ ৬৫ হাজার টন চিনি, গম, মটর, ছোলা ও মসুর ডাল আমদানি করেছিল বড় এই শিল্পগোষ্ঠী। টিকতে না পেরে নিজেরাই সরে পড়ে। অবশ্য এই শিল্পগোষ্ঠীর বহুমুখী শিল্পকারখানা রয়েছে।
আমদানি ব্যবসা থেকে সর্বশেষ সরে আসে নুরজাহান গ্রুপ। ২০১৫-১৬ অর্থবছর থেকে নুরজাহান গ্রুপ এক টনও পণ্য আমদানি করেনি। এর আগে ১০ বছরে প্রতিষ্ঠানটি ১৯ লাখ ৩৮ হাজার টনের ১০ হাজার ৩২১ কোটি টাকার পণ্য আমদানি করে। আটা, ময়দা ও তেলের পরিশোধন কারখানায় বড় বিনিয়োগ রয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। এখন স্থানীয় বাজারে তারা কোনোভাবে ব্যবসা টিকিয়ে রেখেছে। এমইবি ও মোস্তফা গ্রুপ কারখানা সচল রাখতে বছরে সামান্য পরিমাণে ভোজ্যতেল আমদানি করছে, বাজার অংশীদারির হিসাবে তা ১ শতাংশেরও কম।
নুরজাহান গ্রুপের পরিচালক মিজানুর রহমান বলেন, ‘লোকসানের কারণেই আমদানি থেকে সরে আসতে বাধ্য হয়েছে এ গ্রুপ। যারা শুধু ভোগ্যপণ্যে ব্যবসা কেন্দ্রীভূত করে রেখেছিল তারাই মূলত লোকসান কাটিয়ে উঠতে পারেনি। যারা টিকে আছে তাদের ভোগ্যপণ্যের পাশাপাশি অন্য খাতেও ব্যবসা ছিল।’
দেখা যায়, এক দশকের মধ্যে প্রতিবছরই আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান কমছে। সরে যাওয়া মোট ৬৩০টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে গত অর্থবছর ছিটকে পড়ে ৪৯টি। বড় আমদানিকারক নুরজাহান গ্রুপ ছাড়াও এই তালিকায় আছে ছোট আকারের একটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান খাতুনগঞ্জের এনটিটি এন্টারপ্রাইজ। প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার সঞ্জয় দেব প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভোগ্যপণ্যের বাজার বুঝে ওঠা কঠিন। এ কারণে আপাতত বিরত রয়েছি।’
পণ্যভিত্তিক আমদানি তথ্য অনুযায়ী, গত ১০ বছরে ভোজ্যতেলের আমদানি থেকে ব্যবসা গুটিয়েছে ১৬টি প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে রয়েছে নুরজাহান গ্রুপের ছয়টি প্রতিষ্ঠান, রুবাইয়া ভেজিটেবল অয়েল লিমিটেড, প্রাইম এডিবল অয়েল লিমিটেড, উত্তম অয়েল মিল, ইয়াকুব অয়েল মিল, কাজী এডিবল অয়েল লিমিটেড, আর এম অয়েল রিফাইনারি, এমএস রিফাইনারি, কনফিডেন্স এডিবল অয়েল লিমিটেড ইত্যাদি।
ভোজ্যতেলের মতো শোধিত চিনি আমদানির তালিকায় ছিল ৫১টি প্রতিষ্ঠান। চিনির পরিশোধন কারখানা গড়ে ওঠার পর এখন শোধিত চিনি আমদানি হয় না। ফলে ৫১টি প্রতিষ্ঠান চিনি আমদানির ব্যবসা থেকে সরে এসেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ঢাকা ট্রেডিং হাউস, ইস্টওয়েস্ট ট্রেডিং, মহিউদ্দিন করপোরেশন, মাসুদ অ্যান্ড ব্রাদার্স, পিএইচপি ওভারসিস লিমিটেড, ইয়াছির এন্টারপ্রাইজ।
এখন পরিশোধন কারখানা আছে এমন পাঁচটি প্রতিষ্ঠানেরই চিনির ব্যবসা আছে। এর মধ্যে দুটি পরিশোধন কারখানাও এখন আমদানিতে নেই। এ দুটি হলো পারটেক্স সুগার মিলস ও নিটল সুগার মিলস। একইভাবে গম, ছোলা, মটর, মসুর ডাল আমদানিতে প্রতিনিয়ত ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা কমছে।