মধ্যবিত্তের গোপনে হাত পাতা যখন ইউএনওর কাছে দুষ্টুমি

ফরিদ আহমেদ কাঁদতে কাঁদতে সদরের ইউএনও আরিফা জহুরাকে বলছিলেন যে করোনায় তাঁর আর্থিক অবস্থা খারাপ হয়ে গেছে।
প্রথম আলো

করোনার এই কঠিন সময়ে সবচেয়ে বিপাকে আছেন মধ্যবিত্তরা। আয় কমে গেছে, অনেকের চাকরি নেই, চাকরি থাকলেও অনেকের বেতন নেই। মধ্যবিত্তরা হাত পাততে পারেন না, দাঁড়াতে পারেন না টিসিবির ট্রাকের লাইনে। তাঁদের কোনো সংগঠন নেই, নেই সরকারি কোনো সহায়তা প্যাকেজ।

২০০০ সালে বাংলাদেশে দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করত ৪৮ দশমিক ৯ শতাংশ মানুষ। ২০০৫ সালে তা নেমে এসেছিল ৪০ শতাংশে। এরপর ক্রমে দারিদ্র্যের হার কমেছে। যেমন কোভিডের আগে সরকারি হিসাবে দারিদ্র্যের হার ছিল ২০ দশমিক ৫ শতাংশ। কিন্তু মহামারিতে কত মানুষ নতুন করে দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে, এর কোনো জরিপ এখনো সরকার করেনি। তবে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সানেম জরিপ করে বলছে, ৪২ শতাংশ মানুষ এখন দরিদ্র। দেখা যাচ্ছে মধ্যবিত্তদের বড় অংশই নিম্নবিত্তের কাতারে চলে গেছেন।

আরও পড়ুন

নারায়ণগঞ্জের ফরিদ আহমেদের কথাই ধরা যাক। তিনি একটি হোসিয়ারি কারখানায় অল্প বেতনে কাজ করেন। এক ছেলে বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী এবং নিজেও একাধিকবার স্ট্রোক করেছেন। তিনি ৩৩৩ নম্বরে ফোন করে খাদ্যসহায়তা চেয়েছিলেন। আর এই অপরাধে তাঁকে হেনস্তা করা হলো চরমভাবে। আর কাজটি করেছেন স্থানীয় প্রশাসন, সরকারি কিছু কর্মকর্তা।

এ নিয়ে প্রথম আলোসহ বিভিন্ন গণমাধ্যম সংবাদ প্রকাশ করেছে। তবে নারায়ণগঞ্জের একজন বিশিষ্ট নাগরিক রফিউর রাব্বী ফেসবুকে যা লিখেছেন, তা তুলে ধরছি। তিনি লিখেছেন, ‘ফরিদ আহমেদ নারায়ণগঞ্জে এক হোসিয়ারিতে কাটিং মাস্টারের কাজ করতেন। বিগত কয়েক বছরে তার তিনবার ব্রেইন স্ট্রোক করায় দৃষ্টিশক্তি ও স্মৃতি দুটোই কমে গেলে আগের মতো আর তিনি কাজ করতে পারেন না। কিন্তু হোসিয়ারিতেই এখনো ৮ হাজার টাকা বেতনে শ্রমিকদের ওপর নজরদারি রাখার কাজ করে সংসার চালাচ্ছেন। এ টাকায়ই তার ওষুধ-পত্র খাবার ও সংসার। ফরিদ আহমেদের সাত ভাই-বোনদের একটা পৈতৃক বাড়ি আছে। সেখানে সবাই মিলে চারতলা তুলে নিজেরা থাকেন। ফরিদ আহমেদকে চার তলার ওপরে টিনশেড তুলে থাকতে দেওয়া হয়েছে। ফরিদ আহমেদ এফএম রেডিওতে শুনেছেন, ৩৩৩ নম্বরে ফোন করলে সরকার থেকে গোপনে খাদ্য পাঠানো হয়। অনেক ভেবে-চিন্তে ফরিদ আহমেদ ৩৩৩ নম্বরে ফোন দিলেন। শুরু হলো তার খোঁজ-খবর নেওয়া। নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আরিফা জহুরার লোকজন খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন ফরিদ আহমেদের চারতলা বাড়ি আছে, একটা হোসিয়ারি কারখানা আছে, তিনি একজন ধনী লোক। এত সম্পদের অধিকারী কেন ৩৩৩ নম্বরে ফোন দিয়ে রাজকার্যে বিঘ্ন সৃষ্টি করল, এ অপরাধে ফরিদ আহমেদের শাস্তি ঘোষণা করলেন ইউএনও আরিফা জহুরা। শাস্তি হচ্ছে, ফরিদ উদ্দিনকে ১০০ জনের ত্রাণ কিনে দিতে হবে, নয়তো তিন মাসের কারাদণ্ড। ত্রাণও নির্ধারিত (প্রতি প্যাকেটে ৫ কেজি চাল, ১ কেজি ডাল, সঙ্গে আলু, তেল, পেঁয়াজ ও লবণ)।’

নারায়ণগঞ্জের ফরিদ আহমেদ ৩৩৩–এ কল করে ত্রাণ চেয়েছিলেন। পরে তাঁকে উল্টো ১০০ পরিবারের জন্য ত্রাণের ব্যবস্থা করার শাস্তি দেওয়া হয়। টাকা ধার করে জরিমানার ত্রাণের সামগ্রী সংগ্রহ করেন তিনি। সদরের ইউএনও আরিফা জহুরা সেই ত্রাণ দুঃস্থদের মাঝে বিতরণ করেন গত শনিবার বিকেলে
দিনার মাহমুদ

রফিউর রাব্বী আরও লিখেছেন, ‘ফরিদ আহমেদের ঘরে অবিবাহিত মেয়ে, জেল হলে মেয়ের বিয়ে হবে না। গোপনে সাহায্য চাইতে গিয়ে মহাসংকটে পড়েন ফরিদ আহমেদ। ফরিদ আহমেদের ভাই ও তাঁদের স্ত্রীরা জানান, গত শুক্রবার দুবার আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেন ফরিদ আহমেদ। পরে স্ত্রীর গয়না বন্ধক রেখে, সুদে ও ধার করে বিভিন্ন জনের কাছ থেকে ৭০ হাজার টাকা জোগাড় করে ১০০ জনের খাদ্যসামগ্রী কেনেন। শনিবার সে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করেন ইউএনও আরিফা জহুরাসহ সরকারের কর্মকর্তারা। ত্রাণ বিতরণের সময় ফরিদ আহমেদের পরিবারের লোকজন ইউএনওর সামনে কান্নায় আহাজারি করে বলতে থাকেন, ‘আমরা ধনী না গরিব, নিতান্ত গরিব, গরিব।’

এই হচ্ছে পরিস্থিতি। অথচ এর আগে ইউএনও আরিফা জহুরার কথার উদ্ধৃতি দিয়ে এই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে বলা হয়েছিল, ‘দুষ্টুমি করার জন্যই ওই নম্বরে কল করেন কাশীপুরের ওই ব্যক্তি।’ অর্থাৎ ভালোভাবে খোঁজখবর না নিয়েই ‘দুষ্টুমি’ করার জন্য ১০০ গরিবকে খাওয়ানোর ব্যবস্থা করে অনেকের দৃষ্টিতে ‘মহান’ একটি কাজ করেছিলেন ইউএনও। বেশ কিছু বাহবাও পেয়েছেন। অথচ এটা হচ্ছে তাঁর ক্ষমতার অপব্যবহার এবং অসংবেদনশীলতার চরম একটি উদাহরণ।

আরও পড়ুন

গত ২৫ এপ্রিল রোববার সচিবালয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মো. এনামুর রহমান এক সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছিলেন, করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউয়ের হানায় যাঁরা কাজ হারিয়েছেন, তাঁরা ৩৩৩ নম্বরে ফোন দিলেই পাবেন খাদ্যসহায়তা। তিনি সে সময় আরও বলেছিলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী একটি নির্দেশনা দিয়েছেন যে অনেকে এমনকি মধ্যবিত্তরাও দরিদ্রসীমার মধ্যে চলে আসবে এই করোনাভাইরাসের সময়। তারা হয়তো লজ্জায় বলতে পারবে না। সে জন্য ৩৩৩ নম্বরটি প্রচার করছি। যে কেউ খাদ্য কষ্টে থাকলে এই নম্বরে ফোন করলে তাকেও তালিকাভুক্ত করে খাদ্য সহায়তা দেওয়া হবে।’

সুতরাং দেখা যাচ্ছে ফরিদ আহমেদের মতো মানুষের জন্যই ৩৩৩ নম্বরটির সৃষ্টি। আর সরকারের ভালো কাজটি কতিপয় আমলা কীভাবে নষ্ট করে দিচ্ছেন তার উদাহরণ ওই নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। ঘটনা জানাজানি হলে, নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসন তৎপর হয়েছেন। প্রথম আলোতেই সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে, ঘটনার প্রকৃত কারণ খুঁজে বের করতে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ কারণে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে (ইউএনও) আজ রোববারের মধ্যে খাদ্যসামগ্রী বিতরণে ফরিদ যে টাকা খরচ করেছেন, তা ফেরত দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

টাকা না হয় ফেরত দেওয়া হবে, কিন্তু ফরিদ আহমেদের সম্মান কীভাবে ফেরত দেবে নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসন? আর ঘটনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের শাস্তিই বা কী হবে? সাধারণ মানুষের করের টাকায় বেতন পাওয়ার কথাটা তাঁরা যে কবে উপলব্ধি করতে পারবেন, সেটাই একটা প্রশ্ন।