সংবিধানে বাজেট নেই, আছে কোথায়?

দেশের ৫০তম বাজেট ঘোষিত হতে যাচ্ছে আগামী ৩ জুন। বাজারমূল্যে বাজেটের আকার ছয় লাখ কোটি টাকা ছাড়াচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশের সংবিধানে ‘বাজেট’ শব্দটিই নেই। সংবিধানের ৮৭(১) অনুচ্ছেদে বলা আছে ‘বার্ষিক আর্থিক বিবৃতি’। সংবিধানে বলা হয়েছে, ‘প্রত্যেক অর্থবছর সম্পর্কে উক্ত অর্থবছরের জন্য সরকারের অনুমিত আয় ও ব্যয়-সংবলিত একটি বিবৃতি সংসদে উপস্থাপিত হবে।’ এই বিবৃতিই আসলে বাজেট।

বাজেট তাহলে কোথায় আছে? সংবিধানে না থাকলেও বাজেট আছে সংসদের কার্যপ্রণালি বিধিতে। বিধির ১১১(১)-এ বার্ষিক আর্থিক বিবৃতিকে ‘বাজেট’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কার্যপ্রণালি বিধিতে সংসদে বাজেট উপস্থাপনের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে অর্থমন্ত্রীকে। বিধির ১১১(২)-এ বলা হয়েছে, ‘সংবিধানের বিধান সাপেক্ষে অর্থমন্ত্রী যেরূপ উপযোগী মনে করবেন, সেই আকারে বাজেট সংসদে পেশ করবেন।’

প্রতিবছর জুন মাসে সংসদে বাজেট পেশ করে আসছেন অর্থমন্ত্রীরা। দেশের জনগণের জন্য গ্রহণযোগ্য একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার উদ্দেশে বাজেট করা হচ্ছে না বলে নিজের লেখা সদ্য প্রকাশিত ‘বাংলাদেশে বাজেট: অর্থনীতি ও রাজনীতি’ শীর্ষক বইয়ে প্রশ্ন তুলে ধরেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা আকবর আলি খান। তাঁর মতে, অনেক ক্ষেত্রেই যথাযথ বিশ্লেষণ ছাড়া কাল্পনিক পূর্বানুমান নিয়ে বাজেট করা হচ্ছে। ব্যয়ের ক্ষেত্রে আগেরবারের তুলনায় ৫ দশমিক ৫ শতাংশ বাড়িয়ে পরেরবারের বাজেট করা হচ্ছে। আয়ের ক্ষেত্রেও করা হচ্ছে প্রায় একই জিনিস। যেমন রাজস্বের ক্ষেত্রে প্রতিবছর অতিরঞ্জিত প্রাক্কলন করা হচ্ছে।

এই বাজেট নিয়ে সংস্কারের কাজ শুরু হয় ১৯৯২ সালে। ওই বছর যুক্তরাজ্য সরকারের আর্থিক ও কারিগরি সহায়তায় একটি প্রকল্প নেওয়া হয়, যা শেষ হয় ২০০১ সালে। এই প্রকল্পের ফলেই অধিকাংশ মন্ত্রণালয়ের হিসাব কম্পিউটারের মাধ্যমে রাখার ব্যবস্থা করা হয়। যদিও এখনো অনেক দপ্তরেরই ব্যয় ও আয় কম্পিউটারের আওতায় আসেনি। যেমন প্রতিরক্ষা, খাদ্য, বৈদেশিক ঋণ, রেলওয়ে, ডাক, তার ও টেলিফোন ইত্যাদির তথ্য এখনো কম্পিউটারের আওতার বাইরে।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা আকবর আলি খানের সদ্য প্রকাশিত বই ‘বাংলাদেশে বাজেট: অর্থনীতি ও রাজনীতি’।

বইয়ে বলা আছে, নিম্ন আয়ের দেশগুলোর তুলনায় মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) রাজস্বের হার উদ্বেগজনকভাবে কম। বাজেট ব্যবস্থাপনাও অনেক দুর্বল। দেশ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার চলছে। দেশে আমদানি খাতে কর ফাঁকির পরিমাণ প্রবাদপ্রতিম। অন্যদিকে ২০১৬ সালের হিসাব অনুযায়ী ৪০ লাখ যোগ্য আয়করদাতার মধ্যে দিচ্ছেন মাত্র ৮ লাখ। রাজস্ব আদায়ের যেসব আইনকানুন আছে, সেগুলো পুরোপুরি বাস্তবায়নের ক্ষমতা নেই সরকারের। ১৯৯১ সালের মূল্য সংযোজন ও সম্পূরক করের আইন বদলে ২০১২ সালে যে এ বিষয়ে আইন করা হয়, এখনো সরকার ও ব্যবসায়ী মহল তাতে একমত হতে পারেনি।

এসব কথা উল্লেখ করে বাজেটে আয় সম্পর্কে দুটি প্রধান দুর্বলতা চিহ্নিত করেন আকবর আলি খান। একটি হচ্ছে, ব্যয়ের তুলনায় আয় কম হওয়া। অন্যটি আয় অনুমোদনের ক্ষেত্রে সব সময় সংসদের অনুমোদন না নেওয়া। সরকারের সব ব্যয়ের বিষয় বাজেটে প্রতিফলিত হয় না বলেও তাঁর পর্যবেক্ষণে উঠে আসে। তিনি উল্লেখ করেন, বাজেটের যেসব তথ্য দিতে অর্থমন্ত্রী উৎসাহী থাকেন না, সেসব তথ্য আর পাওয়াই যায় না।

কিংবদন্তি আমলা আকবর আলি খানের বাজেট নিয়ে বলা কথার সঙ্গে দ্বিমত করার তেমন কোনো সুযোগ নেই। আমি মনে করি, অপচয় রোধ, অর্থাৎ ব্যয়ের সক্ষমতা বৃদ্ধি একটা বিরাট চ্যালেঞ্জের বিষয়।
মাহবুব আহমেদ, সাবেক অর্থসচিব

বাজেট প্রণয়নের সঙ্গে যুক্ত থাকা সাবেক অর্থসচিব মাহবুব আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘কিংবদন্তি আমলা আকবর আলি খানের বাজেট নিয়ে বলা কথার সঙ্গে দ্বিমত করার তেমন কোনো সুযোগ নেই। আমি মনে করি, অপচয় রোধ, অর্থাৎ ব্যয়ের সক্ষমতা বৃদ্ধি একটা বিরাট চ্যালেঞ্জের বিষয়। আর এ জন্যই তাঁর “প্রতি পাঁচ বছরে একটি সরকারি ব্যয়সংক্রান্ত সমীক্ষা দরকার” বলে আমারও পরামর্শ।’

মাহবুব আহমেদ বলেন, ‘ব্যক্তি যেমন আয় অনুযায়ী ব্যয় করেন, রাষ্ট্রকে করতে হয় তার উল্টো। অর্থাৎ রাষ্ট্রকে আগে ব্যয় ঠিক করতে হয়, তারপর আয়ের অর্থ জোগাড় করতে হয়। ফলে কাল্পনিক পূর্বানুমান দিয়ে বাজেট করা ছাড়া উপায়ও নেই। যদিও যথাযথ বিশ্লেষণের সুযোগ রয়েছে এ ব্যাপারে।’

সংখ্যার খেলার বাজেট, প্রচারণা বেশি

বাজেটের সংখ্যা নিয়ে দেশে খেলা শুরু হয়েছে বলেও মনে করেন আকবর আলি খান। প্রতিবছর বাজেট এলেই বড় করে ঘোষণা করা হয়, বাজেটের আকার সর্বকালের রেকর্ড ছাড়িয়েছে। যুক্তির চেয়েও এতে প্রচারণা বেশি। এ সংখ্যায় অভিভূত হলে চলবে না। তথ্য এখানে সঠিক। কিন্তু তথ্যের ব্যাখ্যা একেবারেই ভুল।

আকবর আলি খানের বিশ্লেষণ হচ্ছে, ১৯৭২-৭৩ থেকে ২০২০-২১ অর্থবছরে বাজারমূল্যে বাজেট বেড়েছে ৭২২ দশমিক ৬ গুণ। এ যেন অনেকটা পুঁথিসাহিত্যের ‘লাখে লাখে সৈন্য মরে কাতারে কাতার, একুনে শুমার হলো চল্লিশ হাজার।’

তাঁর ব্যাখ্যাটি এ রকম—একটি পরিমাণের সঙ্গে আরেকটি পরিমাণের তুলনা করা হচ্ছে বাজারমূল্য দিয়ে। মূল্যস্ফীতিকে এখানে বিবেচনাতেই নেওয়া হচ্ছে না। অথচ বাজারমূল্যের সঙ্গে মূল্যস্ফীতির ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে এই সময়ে। বাজেটের পরিমাণের মূল্যায়ন ও তুলনা করতে হয় জিডিপির ভিত্তিতে।

স্বাধীনতার পর ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে দেশের প্রথম বাজেটের আকার ছিল ৭৮৬ কোটি টাকা। চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটের আকার ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা। আগামী ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেট ছয় লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

৪৯ বছরে জিডিপির এক শতাংশও বাড়েনি

আকবর আলি খানের বিশ্লেষণ হচ্ছে, ১৯৭২-৭৩ থেকে ২০২০-২১ অর্থবছরে বাজারমূল্যে বাজেট বেড়েছে ৭২২ দশমিক ৬ গুণ। এ যেন অনেকটা পুঁথিসাহিত্যের ‘লাখে লাখে সৈন্য মরে কাতারে কাতার, একুনে শুমার হলো চল্লিশ হাজার।’ বাস্তবে জিডিপির হিস্যার ভিত্তিতে বাজেট বেড়েছে ১০ গুণ।

অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের বক্তব্য বিবেচনায় নিলেও আকবর আলি খানের কথার সত্যতাই উঠে আসে। গত বছর অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামাল দাবি করেছিলেন, ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশের বাজেট জিডিপির ১৭ দশমিক ৯ শতাংশ। আকবর আলি খান বলেন, ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরেও বাজেট ছিল জিডিপির ১৭ দশমিক ৪ শতাংশ। অর্থাৎ জিডিপির বিবেচনায় ৪৯ বছরে বাজেট বেড়েছে শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ, এক শতাংশও নয়।

সময়মতো সংশোধিত বাজেট হয় না

সর্বশেষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাজেটের কার্যকর সংস্কারের অংশ হিসেবে সরকারি অর্থ ও বাজেট ব্যবস্থাপনা অধ্যাদেশ জারি করে। এটিই পরে সরকারি অর্থ ও বাজেট ব্যবস্থাপনা আইন আকারে পাস হয় ২০০৯ সালে। এ আইনে প্রথম মধ্যমেয়াদি বাজেট এবং সংশোধিত বাজেটকে আনা হয়। বলা হয়, প্রতিবছরের মার্চের মধ্যে সংশোধিত বাজেট পেশ করতে হবে। আকবর আলি খানের মতে, এখনো তা কার্যকর হয়নি।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, গত কয়েক বছরের মতো চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটও করা হয়েছে এপ্রিল মাসে।

আইনটিতে মধ্যমেয়াদি বাজেটে সরকারের নীতি ও উদ্দেশ্যের সঙ্গে অর্থ বরাদ্দ এবং অর্থ বরাদ্দের সঙ্গে মন্ত্রণালয় বা বিভাগগুলোর কর্ম-কৃতির যোগসূত্র থাকার কথা বলা হয়েছে। এটিও কার্যকর হচ্ছে না উল্লেখ করে আকবর আলি খান বলেন, ‘এর ফলে নামে মধ্যমেয়াদি বাজেট থাকলেও কাজে তার সুফল পাওয়া যাচ্ছে না।’

মক্কেলদের খুশির জন্য রাজনীতিবিদেরা

বইয়ে উল্লেখ রয়েছে, বাজেটে রাজনীতিবিদদের আগ্রহ বেশি ব্যয় বরাদ্দে। যত বেশি ব্যয় বাড়বে, তত বেশি রাজনীতিবিদদের মক্কেলদের খুশি করা যাবে। সরকারের যত ব্যয় বেশি হবে, তত রাজনীতিবিদদের জন্য অনুপার্জিত মুনাফা বা ঘুষের পরিমাণ বৃদ্ধির সুযোগ সৃষ্টি হবে।

আমরা দীর্ঘ বছর ধরে এ কথাগুলোই বলে আসছি। বাস্তবতার সঙ্গে সংগতি ছাড়াই জিডিপির প্রবৃদ্ধির মাত্রা দেখানো হয় দেশে। রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক স্বার্থে তা করা হয়।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, বিশেষ ফেলো , সিপিডি

তবে অর্থনীতিবিদেরা আয় ও ব্যয়—উভয় বিষয় নিয়েই উদ্বিগ্ন থাকেন। তাঁদের মতে, আয় ও ব্যয়ের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা না হলে অর্থনৈতিক সমস্যা দেখা দেবে।
বাজেটের পূর্ণাঙ্গ সংস্কার সম্ভব না হলেও অনেক ক্ষেত্রে পুরো জঞ্জাল ঝেড়ে-মুছে পরিষ্কারের পক্ষে আকবর আলি খান। তাঁর ভাষায়, ‘এই ঝাড়া-মোছার একটি উপায় হলো কমপক্ষে প্রতি পাঁচ বছরে একটি সরকারি ব্যয়সংক্রান্ত সমীক্ষা করা।’

অর্থনীতি ও বাজেট নিয়ে ২৫ বছর ধরে স্বাধীন পর্যালোচনা করে আসছে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। আকবর আলি খানের বিশ্লেষণ ও পর্যবেক্ষণের সঙ্গে একমত পোষণ করে সংস্থাটির বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘আমরা দীর্ঘ বছর ধরে এ কথাগুলোই বলে আসছি। বাস্তবতার সঙ্গে সংগতি ছাড়াই জিডিপির প্রবৃদ্ধির মাত্রা দেখানো হয় দেশে। রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক স্বার্থে তা করা হয়।’

দেবপ্রিয় আরও বলেন, অতীতে যেসব আলোকিত আমলা বাজেট প্রণয়নের মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিলেন, কী কী কারণে তাঁরা তখন অনেক কাজই করতে পারেননি, তা যদি তাঁদের স্মৃতিচারণায় উঠে আসত, তাহলে তাঁদের উত্তরসূরিদের জন্য সহায়ক হতো।