সরকারি বিনিয়োগ বাড়ানোর পরামর্শ

গ্রামীণ অবকাঠামো ও আমার গ্রাম আমার শহর প্রকল্পে বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাতের জন্য নতুন প্রণোদনার প্রস্তাব করেছে সংস্থাটি।

  • ২০১৯-২০ অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) ৭৬.৮ শতাংশ বাস্তবায়িত হয়েছে।

  • ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) এডিপির মাত্র ২৪.৩ শতাংশ ব্যয় হয়েছে।

অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার ত্বরান্বিত করতে মানুষের চাহিদা ও ভোগ বৃদ্ধির বিকল্প নেই। সে জন্য সরকারি ব্যয় বাড়ানো প্রয়োজন। কিন্তু এবার সরকারের বাজেট ব্যয়ের হার খুব কম। বরং একধরনের উদ্বৃত্ত বাজেট নীতিতে সরকার চলছে। আগামী কয়েক মাসে দেশে বেসরকারি বিনিয়োগ তেমন একটা বাড়বে না। এ পরিস্থিতিতে আগামী বাজেটে কর্মসংস্থানমূলক বা শ্রমঘন খাতে সরকারের বিনিয়োগ বৃদ্ধির পরামর্শ দিয়েছেন বক্তারা।

এ পরিস্থিতিতে নতুন প্রণোদনা প্যাকেজের প্রস্তাব দিয়েছে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। বাংলাদেশের উন্নয়নে স্বাধীন পর্যালোচনাবিষয়ক অনলাইন আলোচনায় গতকাল এসব কথা বলেছে সংস্থাটি। কর্মসংস্থান বৃদ্ধিতে সিপিডির পরামর্শ হলো গ্রামীণ অবকাঠামো ও আমার গ্রাম আমার শহর প্রকল্পে বিনিয়োগ বাড়ানো। এতে গ্রামাঞ্চল ও উপশহরে কাজের সুযোগ তৈরি হবে। মানুষের ভোগব্যয় বৃদ্ধি অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার করবে।

সিপিডি বলছে, এত দিন পর্যন্ত যে প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়ন করা হয়েছে, তাতে বড় শিল্পগোষ্ঠীগুলো লাভবান হলেও ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প লাভবান হয়নি। তাই ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পোদ্যোক্তাদের লক্ষ্য করে নতুন প্রণোদনা প্যাকেজ প্রণয়ন করা উচিত বলে মত দেন সংস্থাটির বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান। এ ছাড়া কর্মসংস্থানেও বিশেষ নজর থাকা উচিত বলে মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ।

করোনা মোকাবিলায় সরকার যে প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছিল, তা মূলত ব্যাংকনির্ভর। অথচ অন্যান্য দেশে সরাসরি নগদ সহায়তা দেওয়া হয়েছে। ব্যাংকনির্ভর প্রণোদনার কারণে ব্যাংকব্যবস্থার ওপর যেমন চাপ বেড়েছে, আর ব্যাংকের সঙ্গে যেসব ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাতের উদ্যোক্তাদের যোগাযোগ বা সম্পর্ক নেই, তারা প্রণোদনা সুবিধার বাইরে থেকে গেছে।

অনুষ্ঠানে সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত এমনিতেই নাজুক। গত কয়েক বছরে খেলাপি ঋণের বোঝা তৈরি হয়েছে। করোনার কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণ পরিশোধে শিথিলতার যে সুযোগ দিয়েছে, তাতে কাগজে-কলমে খেলাপি ঋণ কমেছে, কিন্তু বাস্তবে ব্যাংকব্যবস্থার ওপর চাপ অনেক বেড়ে গেছে। চলতি ঋণ পরিশোধে এভাবে দীর্ঘ সময় ধরে বিলম্ব করার সুযোগ দেওয়া হলে সমস্যা।

অনুষ্ঠানের শুরুতে সামষ্টিক অর্থনীতির হালচাল তুলে ধরেন সিপিডির জ্যেষ্ঠ গবেষণা ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান। মূল প্রবন্ধে তিনি বলেন, ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে মূল বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) ৭৬ দশমিক ৮ শতাংশ বাস্তবায়িত হয়েছে। এরপর ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) এডিপির মাত্র ২৪ দশমিক ৩ শতাংশ ব্যয় হয়েছে। যে স্বাস্থ্য খাত নিয়ে এত কথা হলো, সেই স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় হয়েছে সবচেয়ে কম, ১৪ দশমিক ৬ শতাংশ। এমনকি আগের অর্থবছরেও স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় এর চেয়ে বেশি ছিল।

প্রবন্ধে আরও বলা হয়, রপ্তানিমুখী শিল্পের জন্য যে ১০ হাজার ৫০০ কোটি টাকা প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছে, সেটি সবচেয়ে বেশি বাস্তবায়ন হয়েছে। কিন্তু কুটির, অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের (সিএমএসএমই) জন্য যে ২০ হাজার কোটি টাকা ঘোষণা করা হয়েছিল, তা সবচেয়ে কম বিতরণ হয়েছে। অথচ মহামারিতে এ খাতই সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছে। আর ২০২১ সালের জানুয়ারি মাস পর্যন্ত এ ঋণ তহবিলের মাত্র ৫৮ শতাংশ বিতরণ করা হয়েছে।

প্রশ্নোত্তর–পর্ব

সরকারের রাজস্ব আয় এমনিতেই কম। এ পরিস্থিতিতে ব্যয় বাড়াতে হলে ঋণ করতে হবে। সরকারের কোত্থেকে ঋণ করা উচিত, অভ্যন্তরীণ নাকি বিদেশি উৎস থেকে, এমন প্রশ্নের জবাবে মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, সরকার বিদেশি উৎস থেকে সহজ শর্তে ও অল্প সুদে ঋণ নিতে পারে।

প্রণোদনার কারণে অনেক দেশে মূল্যস্ফীতি বাড়ছে। দেশেও অনেকটা বাড়তির দিকে, এর পরিপ্রেক্ষিতে কীভাবে ভারসাম্য রক্ষা হবে, এমন প্রশ্নের জবাবে মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, মাথাপিছু হিসাব করলে একরকম, সিপিআই করলে আরেক রকম। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষের জীবনে প্রভাব ফেলে। কিন্তু ‘হেডলাইন’ মূল্যস্ফীতি সেই মানুষের জন্য অত প্রয়োজনীয় নয়। সে জন্য হিসাব দুভাবেই করা উচিত। সামষ্টিক অর্থনীতির সঙ্গে এর যোগ আছে।

সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, মূল্যস্ফীতি যে মুদ্রাস্ফীতির কারণে ঘটছে তা নয়। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, সরকারি ঋণ এখনো লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কম। বেসরকারি খাতের ঋণও লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কম। মূল্যস্ফীতির বড় একটি উৎস হলো খাদ্য। সে জন্য তাঁর পরামর্শ, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের শুল্ক আরোপ বা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত যেন তাৎক্ষণিকভাবে বাস্তবায়িত হয়। এসব সিদ্ধান্ত দুই-তিন মাস পরে বাস্তবায়িত হলে লাভ নেই।