বাংলাদেশ দিল শাস্তি, ভারত দিল স্বস্তি

বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বেড়েছে। কিন্তু এ দর সাধারণ ভোক্তাদের ওপর না চাপিয়ে কর কমিয়ে দিল ভারত। এতে সেখানে দাম কমবে। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার লোকসান চাপাল সাধারণ মানুষের ওপরেই। মূলত বাংলাদেশ দিল শাস্তি, ভারত দিল স্বস্তি।

জীবন যাত্রায় সাধারণ মানুষকে কিছুটা স্বস্তি দেওয়ার কোনো পরিকল্পনা বা মনোভাব সরকারের মধ্যে নেই তা আবারও প্রমাণ হল। টেলিভিশনের সংবাদেই দেখলাম একজন ভোক্তা বললনে, ‘সরকার কি আমাদের কথা ভাবে?’

একথা বলছি জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোরে প্রেক্ষাপটে। দেশে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম একলাফে লিটারে ১৫ টাকা বাড়ানোর সংবাদ ইতিমধ্যে পাঠকেরা জেনে গেছেন। সরকারের পক্ষে জ্বালানি মন্ত্রণালয় গত বুধবার রাতে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে নতুন দামের কথা জানিয়ে দেয়। ওইদিন রাত ১২টা থেকেই নতুন দর কার্যকর করা হয়েছে। ফলে এখন থেকে ডিজেল ও কেরোসিন তেলের নতুন দর হবে প্রতি লিটার ৮০ টাকা, যা এত দিন ৬৫ টাকা ছিল। এর আগে ২০১৬ সালের ২৪ এপ্রিল প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে জ্বালানি তেলের দাম সর্বশেষ কমানো হয়েছিল।

মূলত ট্রাক, বাসসহ পরিবহনের জ্বালানি হিসেবেই ডিজেলের ব্যবহার বেশি। ফলে ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধি মানেই পরিবহন ভাড়া বেড়ে যাওয়ার শঙ্কা। আবার ট্রাকভাড়া বাড়লে সব পণ্যের পরিবহন খরচও বাড়বে। বাড়বে উৎপাদন খরচ।

কেন হঠাৎ করে এ দর বৃদ্ধি? জ্বালানি মন্ত্রণালয় বলেছে, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ছে। এ কারণে প্রতিবেশী দেশসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশে জ্বালানি তেলের দাম নিয়মিত সমন্বয় করা হচ্ছে। আর বর্তমানে যা দর, তাতে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) ডিজেল লিটারে ১৩ টাকা ১ পয়সা ও ফার্নেস তেল ৬ টাকা ২১ পয়সা করে কমে বিক্রি করছে। এতে প্রতিদিন প্রায় ২০ কোটি টাকা লোকসান দিতে হচ্ছে। গত অক্টোবরে বিপিসির লোকসান হয়েছে প্রায় ৭২৭ কোটি টাকা।

আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দর বৃদ্ধির কারণ ও প্রভাব এবং বিপিসির আগের লাভ-লোকসান নিয়ে আলোচনা করার আগে প্রতিবেশী একটি দেশের কথা বলা যাক। কারণ, জ্বালানি মন্ত্রণালয় নিজেই প্রতিবেশীসহ অন্যান্য দেশের তুলনা দিয়েছে।

ভারতে পেট্রলের আবগারি শুল্ক কমানো হয়েছে ৫ রুপি এবং ডিজেলে ১০ রুপি
ছবি: রয়টার্স

ভারত যেভাবে দাম কমাল

ভারতের কথাই বলা যাক। দেখা যাক তারা কী করেছে। বাংলাদেশ যেদিন ডিজেল ও কেরোসিন তেলের দাম বাড়াল, সেদিনই ভারত ডিজেল ও পেট্রলের ওপর আরোপিত আবগারি শুল্ক কমিয়েছে। আর এতে স্থানীয় পর্যায়ে পণ্য দুটির দাম কমে গেছে। মূলত জ্বালানি তেল কিনতে ভোক্তাপর্যায়ের করই কমিয়েছে ভারত সরকার। এতে সরকারের আয় কমবে, তবে ভোক্তারা লাভবান হবেন।

ভারত সরকার মনে করছে, ভোক্তাকে স্বস্তি দিতে হলে জ্বালানি তেলের দাম কমানো প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। কেননা দাম কমলে জ্বালানি তেলের চাহিদা বাড়বে, এতে অর্থনীতি লাভবান হবে। নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ভারতে পেট্রলের আবগারি শুল্ক কমানো হয়েছে ৫ রুপি এবং ডিজেলে ১০ রুপি। ভারত সরকার বলছে, দেশটিতে ডিজেল মূলত কৃষকেরাই বেশি ব্যবহার করেন। সুতরাং এতে কৃষি খাত বেশি লাভবান হবে। সামগ্রিকভাবেই দেশের অর্থনীতিতে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।

ভারত নিয়মিতভাবে জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয় করে। তবে এবার বিশ্ববাজারে দাম বাড়তে থাকায় দেশটির সরকার বিকল্প পথে জ্বালানি তেলের দাম কমানোর ব্যবস্থা করল। অর্থাৎ সরকার জ্বালানি তেল বিক্রি করে যে রাজস্ব পেত, সেখান থেকেই ছাড় দিল। এমনকি ভারত মানুষকে স্বস্তি দিতে ভোজ্য তেলের দামও কমানোর সিদ্ধান্ত নিচ্ছে বলে জানা গেছে।

আরও পড়ুন

বিশ্ব পরিস্থিতি

প্রায় দুই বছরের করোনাকালে সরবরাহব্যবস্থা বিঘ্নিত হয়েছে। চাহিদা ছিল কম, উৎপাদনও কম। কিন্তু এখন অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে চেষ্টা করছে। তবে আগের সমস্যাগুলো রয়েছে, কিন্তু বেড়েছে চাহিদা। সবচেয়ে বেশি প্রভাব জ্বালানি তেলে। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দর এখন প্রতি ব্যারেল ৮৫ ডলার ছাড়িয়েছে। মূলত ২০১৪ সালের পরে প্রথম এ দাম ৮৫ ডলার ছাড়াল। অথচ গত বছরের এপ্রিল মাসেও জ্বালানি তেলের দাম প্রতি ব্যারেল ‘শূন্য’ ডলারের নিচে নেমে গিয়েছিল। আর এখনকার যে প্রবণতা, তাতে দর ১০০ ডলারের কাছাকাছি যেতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। মূলত প্রায় দেড় বছরের বেশি সময় কম দামে বিক্রির ক্ষতি পুষিয়ে নিতেই তেল উত্তোলনকারী দেশগুলো দাম বাড়ানোর কৌশল হিসেবে দৈনিক তেল উত্তোলন কমাচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে, তেল রপ্তানিকারক দেশগুলোর সংগঠন ওপেক কম উত্তোলনের এ ধারা আরও কিছুদিন অব্যাহত রাখবে।

দেশে সর্বশেষ জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়েছিল ২০১৩ সালে। তারপর থেকেই আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দর কমছিল। ফলে ২০১৬ সালে এসে দাম কমানো হয়। তখন অর্থমন্ত্রী ছিলেন আবুল মাল আবদুল মুহিত। কিন্তু তিনি আর দাম কমাননি। তাঁর যুক্তি ছিল বিপিসি এর আগে লোকসান দিয়েছে, সেই লোকসান তুলতে হবে।

বিপিসির লাভ কই গেল

দেশে সর্বশেষ জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়েছিল ২০১৩ সালে। তারপর থেকেই আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দর কমছিল। ফলে ২০১৬ সালে এসে দাম কমানো হয়। তখন অর্থমন্ত্রী ছিলেন আবুল মাল আবদুল মুহিত। কিন্তু তিনি আর দাম কমাননি। তাঁর যুক্তি ছিল বিপিসি এর আগে লোকসান দিয়েছে, সেই লোকসান তুলতে হবে। তখন থেকে বিপিসি টানা হাজার হাজার কোটি টাকা মুনাফা করেছে। বলা হচ্ছে লাভের পরিমাণ ছিল ৪০ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ সাধারণ ভোক্তা আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমার কোনো উপকার পায়নি। কিন্তু এখন যখন বিপিসি লোকসান দেওয়া মাত্র শুরু করেছে, সঙ্গে সঙ্গে দাম বাড়িয়ে দিল। আর লিটার প্রতি ১৫ টাকা বাড়ানোর কারণে এখন বিপিসির কিছুটা লাভই হবে।

বর্তমানে জ্বালানি তেল আমদানি থেকে সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব পায়। ডিজেল আমদানিতে সরকার সব মিলিয়ে কর পায় ৩৪ শতাংশ, কেরোসিনে ৩৪ শতাংশ এবং অপরিশোধিত তেলে ২৮ শতাংশ। সরকার তার করের পরিমাণ কমালেই সাধারণ মানুষ কিছুটা স্বস্তি পেত। এতে সরকারের আয় কিছুটা কমত, কিন্তু ভোক্তাদের ওপর দায় কিছুটা কমে যেত। ভারত সরকার ঠিক এ কাজটাই করেছে। অর্থাৎ দেশে সরকার লাভের অংশ নিতে প্রস্তুত, কিন্তু লোকসান সাধারণ মানুষের চাপিয়ে দিতেই বেশি স্বচ্ছন্দ। দেশে আসলেই সাধারণ মানুষের কথা ভাবার কে আছে? সাধারণ মানুষের তো এখন আর ভোটার হিসেবে কোনো মূল্যই নেই।

কী হবে এখন

ডিজেলের দাম বাড়ানোর প্রভাব এরই মধ্যে পড়তে শুরু করেছে। পরিবহন ভাড়া বাড়ানোর জন্য এরই মধ্যে বিভিন্ন পর্যায় থেকে চাপ দেওয়া শুরু হয়েছে। এসেছে বাস-ট্রাক বন্ধের ঘোষণা। এতে বাড়ছে মানুষের দুর্ভোগ। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি কেবল পরিবহন ভাড়াই বাড়াবে না, বাড়িয়ে দেবে উৎপাদন খরচও। এতে বাড়বে জীবনযাত্রার ব্যয়। এমনিতেই করোনার সময়ে মানুষের একটি বড় অংশের আয় কমে গেছে। এখন জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে গেলে সীমিত আয়ের মানুষের কষ্টের আর সীমা থাকবে না। কিন্তু সেদিকে সরকারের নজর বা পরিকল্পনা কোথায়?