১০০ টাকার নোট অচল করার সেই গল্প

১৯৭৫-এর ৬ এপ্রিল। সন্ধ্যা ছয়টায় হঠাৎ করে রেডিও-টেলিভিশনে অর্থমন্ত্রী আজিজুর রহমান (এ আর) মল্লিকের ঘোষণা। ঠিক তখন থেকেই ১০০ টাকার নোট অচল ঘোষণা করা হয়। বাংলাদেশের ইতিহাসে সেটাই ছিল কালোটাকা প্রতিহত করার প্রথম ও সবচেয়ে জোরালো পদক্ষেপ। আর বাংলাদেশের ইতিহাসে সেটাই ছিল নোট অচল করার একমাত্র ঘটনা।

পরের দিন দৈনিক ইত্তেফাকের প্রধান শিরোনাম ছিল ‘একশত টাকার নোট অচল ঘোষণা’। সরকার এরপর তিন দিন—অর্থাৎ ৭, ৮ ও ৯ এপ্রিল ১০০ টাকার নোট জমা দেওয়ার সময় বেঁধে দেয়। বলা ছিল, এই তিন দিন ট্রেজারি ও ব্যাংক আর কোনো কাজ করবে না, কেবল ১০০ টাকার নোট জমা নেবে। এমনকি এ সময় ভারতের সঙ্গে সীমান্ত বন্ধ করে দেওয়া হয়। কোনো ট্রেন সীমান্তবর্তী এলাকার স্টেশনে থামবে না বলেও নির্দেশ দেওয়া হয়। এর পরের নির্দেশনা ছিল, ১২ এপ্রিল শনিবার জমা করা ১০০ টাকার নোটের পরিবর্তে সর্বোচ্চ ৩০০ টাকা ফেরত দেওয়া হবে। এমনকি ৫০০ টাকা পর্যন্ত যাঁরা অর্থ জমা দিয়েছেন, তাঁদেরও ৩০০ টাকা ফেরত দেওয়া হবে। পরে ফেরত দেওয়া অর্থের পরিমাণ বাড়িয়ে ৮০০ টাকা করা হয়।

১৯৭৫ এর ৭ এপ্রিলের পত্রিকা
সৌজন্যে: সংগ্রামের নোটবুক

কেন নোট অচল

নোট অচল করার পর ইত্তেফাকের সম্পাদকীয়র শিরোনাম ছিল, ‘উদ্দেশ্য যেন সফল হয়’। সেখানে বলা হয়, ‘এক শ টাকার নোট বাতিল ঘোষণার ফলে পর্বত সমতটে পরিণত না হোক, কালো টাকার পাহাড় কিছুটা নত হইবেই। আর তা হইবে দেশের অর্থনীতির পক্ষে কল্যাণকর।’

অর্থমন্ত্রী এ আর মল্লিক ১৯৭৫ সালের ২৩ জুন ১৯৭৫-৭৬ অর্থবছরের যে বাজেট দেন, সেখানে ১০০ টাকার নোট অচল করার ব্যাখ্যা দেন। তিনি বলেছিলেন, ‘মুদ্রাস্ফীতির চাপ প্রশমিত করা ও অর্থনীতিতে কালো ও বাড়তি টাকার অশুভ প্রভাব দূর করিবার জন্য সরকার বিগত ৬ই এপ্রিল ১০০ টাকার নোট অচল বলিয়া ঘোষণা করেন। জনগণ তাঁহাদের সাময়িক অসুবিধা সত্ত্বেও, সরকারের এই প্রচেষ্টার সাফল্যের জন্য স্বতঃস্ফূর্তভাবে যে সাড়া দিয়াছেন, তাহার জন্য আমি কৃতজ্ঞ। জনগণের এই সহযোগিতার ফলে চোরাকারবারী ও কালোবাজারী বহু লোকের অসদুপায়ে অর্জিত টাকা আটকা পড়িয়াছে। সরকার অবগত আছেন যে, এই টাকা বাতিল ঘোষণার ফলে কিছু কিছু সৎ ও নিরীহ জনসাধারণ অসুবিধার সম্মুখীন হইয়াছেন। কিন্তু জাতির বৃহত্তর স্বার্থের খাতিরে সরকারের এই ব্যবস্থা গ্রহণ করা ছাড়া গত্যন্তর ছিল না। জনসাধারণের সুবিধার জন্য সরকার ৮০০ টাকা পর্যন্ত জমাদানকারীকে আংশিক নগদ ও অবশিষ্ট পাঁচ হইতে সাত বৎসর মেয়াদি শতকরা বার্ষিক ৮ ভাগ সুদসহ ঋণপত্রের মাধ্যমে পরিশোধ করিবার কার্যক্রম ঘোষণা করিয়াছেন। অবশ্য পরবর্তী পর্যায়ে অর্থনৈতিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সরকার এই ঋণের মেয়াদ উত্তীর্ণ হইবার পূর্বেও পরিশোধ করিবার বিষয় পুনর্বিবেচনা করিতে পারেন। সরকারের এই সুচিন্তিত ব্যবস্থার ফলে মুদ্রা সরবরাহ হ্রাস পাইয়াছে ও জিনিসপত্রের মূল্যের ওপর ইহার কিছুটা শুভ প্রভাব পরিলক্ষিত হইতেছে।’

এ আর মল্লিক, সাবেক অর্থমন্ত্রী

অর্থমন্ত্রীর স্মৃতিকথা থেকে

এ আর মল্লিক ‘আমার জীবনকথা ও বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম’ নামে একটি জীবনস্মৃতিমূলক গ্রন্থ প্রকাশ করেছিলেন ১৯৯৫ সালে। তিনি লিখেছেন, ‘এ সময় এক শ টাকার নোট অচল করা একটি বড় ধরনের ঘটনা ছিল। বঙ্গবন্ধুকে বললাম, এক শ টাকার নোট ব্যাপকভাবে চোরাচালান হচ্ছে, ট্যাক্স ফাঁকি দিয়ে টাকা জমা করছে। আমি এক শ টাকার নোট অচল করতে চাই, যারা ট্যাক্স ফাঁকি দিচ্ছে তাদের ধরতে চাই।’
বিষয়টি মন্ত্রিসভার বৈঠকে উপস্থাপনের পরামর্শ দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। কিন্তু জানাজানি হওয়ার আশঙ্কার কথা বলা হলে বঙ্গবন্ধু সেটা মেনে নিয়েছিলেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর নাজির আহমেদ, অর্থসচিব কফিলউদ্দিন মাহমুদ এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মুস্তাফিজুর রহমানকে নিয়ে পুরো প্রক্রিয়ার প্রস্তুতি নেওয়া শুরু হয়। এর মধ্যে বঙ্গবন্ধুর বাবা মারা গেলে অচল ঘোষণার তারিখ এক দফা পিছিয়ে দেওয়া হয়। অবশেষে তারিখ নির্দিষ্ট করা হয় ৬ এপ্রিল। তবে বঙ্গবন্ধু জানান যে ঘোষণার আগে দুজনকে জানানো হবে, উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং প্রধানমন্ত্রী ক্যাপ্টেন মনসুর আলী।

এ নিয়ে সাবেক অর্থমন্ত্রী এ আর মল্লিক লিখেছেন, ‘আমি বললাম, ঠিক আছে, তাঁদের আপনি সকাল সাড়ে আটটার দিকে ডাকেন। আমার লোকজন আটটার মধ্যে চলে আসবে। কিন্তু ভাই, আপনি কিছু মনে করবেন না—আই উইল কীপ দেম। সন্ধ্যার আগে বেরোতে দেব না। বঙ্গবন্ধু বললেন, ঠিক আছে, আপনি যা পারেন, করেন। তারপরই তিনি বললেন, তাহলে এক কাজ করেন বিছানাপত্র আনিয়ে নিই। তিনি তিনটা বিছানা আনালেন, খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা এখানে হবে সে খবরও বাসাতে পাঠালেন।’ সে অনুযায়ীই ব্যবস্থা নেওয়া হয়। বিকেল নাগাদ সব কাগজপত্র তৈরি হয়ে যায়, তিন বাহিনীর প্রধানদের ডাকা হয়, ডাক বিভাগ, রেডিও, টেলিভিশন সবাইকে ডাকা হলো। তাদের জানানো হয়, সন্ধ্যার সময় ১০০ টাকার নোট অচল ঘোষণা দেওয়া হবে। আর ছয়টি হেলিকপ্টার প্রয়োজন হবে পরদিন সকালে সর্বত্র কাগজপত্র পাঠানোর জন্য। প্রত্যেক ব্যাংক, পোস্ট অফিসে এসব কাগজপত্র যাবে।

নোট অচল করার প্রভাব নিয়ে সংবাদের শিরোনাম।
সৌজন্যে সংগ্রামের নোটবুক

সন্ধ্যা ছয়টায় ১০০ টাকার নোট অচল করার ঘোষণা দেওয়া হয়। এই সময়ের বর্ণনা দিয়েছেন এ আর মল্লিক। তিনি লিখেছেন, ‘প্রথমে আমি নিউ মার্কেটে গেলাম। সেখান থেকে বায়তুল মোকাররমে সোনার দোকান প্রত্যক্ষ করলাম, কেউ সোনা কিনছে কিনা। দেখলাম মার্কেট খুব নরমাল। তারপর নিশ্চিন্ত হয়ে অফিসে ফিরে গেলাম।... সন্ধ্যা সাতটায় ঘোষণা করার কথা ছিল। মিনিট বিশেক আগে আমরা বেরোলাম। বেরিয়ে প্রথমে সৈয়দ নজরুল ইসলামকে নামালাম। তারপর ক্যাপ্টেন মনসুরকে নামিয়ে আমি আমার বাসার দিকে রওনা হলাম।’

আগেই বলা হয়েছে, টাকা জমা দেওয়ার জন্য তিন দিনের সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছিল। এ নিয়ে এ আর মল্লিক আরও লিখলেন, ‘ইতিমধ্যে টাকা জমা দেওয়ার সময় পার হয়ে গেল। অনেক টাকা পুড়িয়ে ফেলা হলো। কলকাতায় আমাদের ডেপুটি হাইকমিশনারের অফিসের সামনে পার্ক সার্কাসে যারা টাকা নিয়ে আসতে পারল না তারা ওই টাকা আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিল প্রকাশ্যে। খবরটা খবরের কাগজে বেরোল আমরা দেখলাম। সীমান্ত বন্ধ করে দেওয়া হলো। এয়ারপোর্ট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল, যাতে টাকা নিয়ে কেউ না আসতে পারে। এর ফলে অনেক এক শ টাকার নোট জমা হতে পারল না। আর যা জমা হলো তার আবার হিসাব দিতে হবে। হিসাব দিয়ে টাকা নিতে হবে। এমন হলো সকলে নানা প্রতিষ্ঠানের নামে টাকা জমা দিতে লাগল। মাদ্রাসার নামে, স্কুলের নামে অনেক টাকা জমা পড়ল। চিন্তা করা যায় না এসব স্কুলের এত টাকা থাকতে পারে, এসব মাদ্রাসার এত টাকা থাকতে পারে। দাউদকান্দির যে মাদ্রাসা যেটি খোন্দকার মোশতাক সাহেবের গ্রামে সেই প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে বত্রিশ হাজার টাকা জমা হলো। খোন্দকার মোশতাক পরে চাইলেন। আমি না করে দিলাম। তিনি খুব রাগারাগি করলেন।’

সরকারি ঘোষণার সংবাদ
সৌজন্যে সংগ্রামের নোটবুক

বঙ্গবন্ধুর বাসায় কত টাকা ছিল

১০০ টাকার নোট অচল হবে, এ তথ্য অর্থমন্ত্রী ও কয়েকজন কর্মকর্তা ছাড়া জানতেন কেবল বঙ্গবন্ধু। কিন্তু সে তথ্য বঙ্গবন্ধু বাসায়ও জানাননি। নোট অচল করার পর একদিন ফোন করে অর্থমন্ত্রীকে গণভবনে ডেকে পাঠালেন বঙ্গবন্ধু। এ নিয়ে ড. এ আর মল্লিক লিখেছেন, ‘গণভবনের অফিসে গেলাম। দেখলাম তিনি বসে রয়েছেন। আমাকে দেখেই কতক্ষণ হা-হা করে হাসলেন। তারপর বললেন, “এখন প্রমাণিত হবে ডক্টর সাহেব, আমরা রাজনীতি করলেও বিশ্বাসঘাতকতা করি না। না রাষ্ট্রের সঙ্গে, না সরকারের সঙ্গে।” আমি একটু অপ্রস্তুত হয়ে বললাম, “আমি কি তা বলেছি?” বঙ্গবন্ধু বললেন, “তা বলেননি, কিন্তু আপনি ক্যাবিনেটে ডিসিশন নিতে দেন নাই। আপনি রাইট, সবাই তো সমান হয় না। তবে আমি যে সন্দেহের ঊর্ধ্বে তা এক্ষুনি প্রমাণিত হবে।” তিনি বললেন, ‘‘আপনার ভাবী যখন বললেন যে শাড়ির ভাঁজের মধ্যে টাকা আছে, তখন আপনি নিজেই সামনে ছিলেন। তিনি এখন টংগীবাড়ি থেকে ফিরে এসে বলছেন যে সিক্সটি ফাইভ থাউজেন্ড টাকা তাঁর কাছে আছে। এসব এক শ টাকার নোট। এই নোটগুলি তাঁকে বদলিয়ে দিতে হবে। আমি বলেছি, তোমার টাকা গেছে সত্য, তবে যে মানুষ অর্থমন্ত্রী যিনি ঘোষণা দিয়েছেন এখন কারও সাধ্য নেই টাকা ভাংগানো।”’ এই অর্থ বেগম মুজিব জমিয়েছিলেন। কিছু টাকা ছিল আত্মীয়স্বজনের দেওয়া। ছেলেমেয়ের বিয়ের জন্য এই অর্থ তিনি জমাচ্ছিলেন।

এরপর অর্থমন্ত্রী ফোন করলেন বেগম ফজিলাতুন্নেছাকে। এ আর মল্লিক এ নিয়ে লিখেছেন, ‘তিনি (বেগম মুজিব) বললেন, “সর্বনাশ করেছেন ভাই আপনি। আমার টাকা না দিলে আমি ছেলেমেয়েদের বিয়ে দেব কেমন করে?” আমি বললাম, “বিয়ের টাকা জোগাড় হবে। জোগাড় যদি না হয় তাহলে বিনা পয়সাতেই হবে। আপনার ওই টাকা গেছে। টাকা আর পাবেন না।” আরও বললাম, ‘‘আপনি রাষ্ট্রপতির স্ত্রী। এটা উদাহরণ হিসাবে থাকুক যে আপনার টাকাও আমি ফেরত দিই নি।”’ এরপর এ আর মল্লিক লিখলেন, ‘১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হবার পর ঐ পঁয়ষট্টি হাজার টাকা তাঁর বাসভবনে পাওয়া গিয়েছিল। যত দূর মনে পড়ছে একটা কাগজেও বেরিয়েছিল।’

খন্দকার মোশতাক আহমেদ

খোন্দকার মোশতাক যেভাবে টাকা ফেরত নিলেন

কুমিল্লার দাউদকান্দি খন্দকার মোশতাক আহমেদের নিজের এলাকা। এই গ্রামের এক মাদ্রাসা থেকে ৩২ হাজার টাকা জমা হয়েছিল। সে টাকা চেয়েছিলেন খোন্দকার মোশতাক, কিন্তু দেওয়া হয়নি সে সময়। কিন্তু বঙ্গবন্ধু হত্যার পরে সেই খন্দকার মোশতাক হলেন রাষ্ট্রপতি। আর মোশতাক সরকারের অর্থমন্ত্রী তখনো এ আর মল্লিক। এর পরের ঘটনার কথাও এভাবে লিখেছেন তিনি, ‘আমাকে বলা হলো যে, প্রেসিডেন্ট খবর দিয়েছেন সেক্রেটারি কফিলউদ্দিন মাহমুদকে সঙ্গে নিয়ে যেতে। ঠিক তারিখগুলো আমার মনে নেই। আমি কফিলদ্দিন মাহমুদকে নিয়ে গেলাম। সেখানে গিয়ে দেখি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর নাজির আহমেদ উপস্থিত। আমরা গিয়ে বসার পরই প্রেসিডেন্ট এসে বসলেন। বসার পরপরই বললেন, “মাহমুদ, ইউ হ্যাভ নট ক্যারিড আউট মাই অর্ডার।” মাহমুদ আমার দিকে তাকালেন। আমি বললাম, “কোন অর্ডার কেরি করেনি?” বললেন, “আমি বলেছিলাম যে, দাউদকান্দি স্কুলের দান বাক্সে যে সব একশত টাকার নোট আটক করা হয়েছে তা ছেড়ে দিতে।” আমি বললাম, “ছাড়তে আমিই ওঁকে না করেছি। টাকা আটকে রাখা হয়েছে অনেক স্কুল কলেজেরই; এক সঙ্গে ডিসিশন নেওয়া হবে। আমিই তাঁকে না করেছি। সুতরাং তাঁর কোনো অপরাধ নেই।”

এরপর এ আর মল্লিক লিখেছেন, ‘পরবর্তীতে তাঁর স্কুলের জন্য একতরফা অর্ডার-এর সঙ্গে আমিও অর্ডার দিলাম সমস্ত স্কুল কলেজের টাকা ছেড়ে দিতে। এক শ টাকার নোট মোট পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত ছেড়ে দেওয়ার কথা ছিল। পাঁচ হাজারের ঊর্ধ্বে হলেই টাকা আটক করার সিদ্ধান্ত ছিল। হিসাব পরীক্ষার পরই এবং তা যথাযথ হলেই টাকা ছেড়ে দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু প্রেসিডেন্ট খোন্দকার মোশতাক তা মানলেন না।’

নোট অচল করেও ভালো ফল পায়নি ভারত

কী ফল হয়েছিল

নোট অচল করার ফল নিয়ে বড় কোনো গবেষণা বা সমীক্ষার খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না, বিশেষ করে ৪৫ বছর পরে। তবে সাপ্তাহিক বিচিত্রা বঙ্গবন্ধু হত্যার পর তাঁর সরকারের অর্থনীতির একটি পর্যালোচনা করেছিল। ১৯৭৫ সালের ২ অক্টোবর সংখ্যায় লেখা হয়েছিল, মুদ্রাস্ফীতির হাত থেকে অর্থনীতিকে সচল করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক ১৯৭৫-এর এপ্রিলে এক বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নেয়। ১০০ টাকার নোট অচল ঘোষণা খুব একটা সহজ ছিল না। রাশিয়া বিপ্লবোত্তর সময় মুদ্রাস্ফীতিকে প্রশমিত করতে এ ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে। আরও অনেক দেশ এ ধরনের পদক্ষেপ নিলেও এর সার্থকতা খুব কম স্থানেই দেখা গেছে। তবু এ পদক্ষেপ নেওয়া হয় এবং জনগণ এ পদক্ষেপে স্বাগত জানায়। মুদ্রা সরবরাহ কমানো ছাড়াও চোরাকারবার বন্ধ করার প্রচেষ্টাও এর মধ্যে নিহিত ছিল। এ মাধ্যমে দেশীয় কালোটাকাকে ধ্বংস করাও সম্ভব হবে। তা ছাড়া সীমান্ত এলাকায় এক ধরনের নতুন উৎপাত চালু ছিল। কিছু বিদেশি ব্যবসায়ী বাংলাদেশি নোট কিনে নিয়ে জমা করছিলেন। এপ্রিল ও মের ধান পাকার সময় তখন তাঁরা বাংলাদেশি টাকা দিয়ে বাংলাদেশ থেকে ধান কিনে সীমান্তের ওপারে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন। অচল ঘোষণার প্রথম প্রতিক্রিয়া হয় শুভ। গুজব ছড়িয়ে পড়ে টাকা জমা দিলে তার হিসাব চাওয়া হবে। ফলে অনেক কালোটাকাওয়ালা প্রাণের ভয়ে লোকসানকে মেনে নিয়ে টাকা জমা দেওয়া থেকে বিরত হন। এতে মোটা অঙ্কের মুদ্রা সরবরাহ কমে যায়। ধীরে টাকা বদলি নীতির ফলে কয়েক মাস মুদ্রা সরবরাহ দারুণ কম থাকে। এর প্রতিক্রিয়া সামান্য হলেও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের ওপর পড়ে। মার্চে যেখানে মুদ্রা সরবরাহ ছিল ৮৮ হাজার ৯৬৩ কোটি টাকা, সেখানে মাত্র এক মাসেই মুদ্রা সরবরাহ কমে হয় ৭৪ হাজার ২৩৫ কোটি টাকা।

শেষ কথা

২০১৬ সালের নভেম্বরে ভারতে মোদি সরকার ৫০০ ও ১০০০ রুপির নোট বাতিল করেছিল। শেষ পর্যন্ত এতে খুব একটা লাভবান হতে পারেনি। তাহলে বাংলাদেশ কতটা লাভবান হয়েছিল? এত বছর পরও বড় প্রশ্ন হচ্ছে, ১০০ টাকার নোট অচল করার ফল কী হয়েছিল? এ কথা পরিষ্কার যে দেশে কালোটাকার প্রসার কমেনি, বরং বেড়েছে। তবে এটাও ঠিক যে চার মাস পর মোশতাক সরকার এসে আগের সরকারের কঠোর অবস্থান আর ধরে রাখেনি। বরং কালোটাকার মালিকদের সুযোগ দেওয়ার দিকেই বেশি নজর দিয়েছিল। এর পরের ৪৫ বছরের ইতিহাস হচ্ছে কালোটাকার প্রসার ও কালোটাকার মালিকদের সুযোগ দেওয়ার ইতিহাস।