দেশের অনেক শিল্পগোষ্ঠীর বড় হয়ে ওঠার সঙ্গে আপনার সম্পৃক্ততা রয়েছে। অর্থনীতিতে এসব গোষ্ঠীর অবদান অনেক। বর্তমান পরিস্থিতিতে এসব শিল্পগোষ্ঠী কেমন করছে?
শেখ মোহাম্মদ মারুফ: ২০ বছর আগে বাংলাদেশে এমন কোনো প্রতিষ্ঠান খুঁজে পাওয়া যেত না, যার বার্ষিক লেনদেন ছিল ৫০ কোটি মার্কিন ডলার। এখন আমরা এমন অনেক প্রতিষ্ঠান দেখতে পাই, যেগুলোর বার্ষিক লেনদেন ৩ বিলিয়ন বা ৩০০ কোটি ডলারের বেশি। দেশের অর্থনীতির আকার গত দুই দশকে অনেক বড় হয়েছে, মানুষের ক্রয়ক্ষমতাও বেড়েছে। বড় শিল্পগোষ্ঠীগুলোর একটি বড় অংশ খাদ্যপণ্য ও মৌলিক ভোগ্যপণ্য উৎপাদনে যুক্ত, যা অর্থনীতির ওঠানামার সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত। সময়ের সঙ্গে এসব প্রতিষ্ঠান আরও সক্ষম হয়েছে, নতুন নতুন ব্যবসায়ে প্রবেশ করছে।
এখন অনেক ভালো কোম্পানি গড়ে উঠেছে, যেগুলো বিদেশে ব্যবসা সম্প্রসারণ করতে পারে; এমনকি আন্তর্জাতিক শেয়ারবাজারেও তালিকাভুক্ত হতে পারে। ভারতের অনেক প্রতিষ্ঠান বৈশ্বিক বাজারে নিজেদের অবস্থান পোক্ত করেছে, আমাদেরও সেই সম্ভাবনা রয়েছে। তাতে এসব প্রতিষ্ঠানের হিসাব আরও স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক হবে।
বর্তমান সময়ে মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের সঞ্চয় কমেছে, যার প্রভাব পড়েছে শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর বিক্রির ওপর। তবে বড় বড় শিল্পগোষ্ঠীর ঋণের মানের ওপর এর প্রভাব এখন পর্যন্ত কোনো বিরূপ প্রভাব পরিলক্ষিত হয়নি ।
বিনিয়োগ বাড়াতে ২০২০ সালে সুদহার ৯ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছিল। এতে কি বিনিয়োগ বেড়েছে, নাকি কিছু নির্দিষ্ট গোষ্ঠী
বেশি সুবিধা পেয়েছে? কেউ কেউ বলছেন, নির্দিষ্ট সুদহার অর্থনৈতিক সংকটের একটি কারণ। আপনার কী মতামত?
শেখ মোহাম্মদ মারুফ: কম সুদে ঋণ পাওয়া ব্যবসার জন্য সহায়ক। ১৪-১৫ শতাংশ সুদ এবং অন্যান্য খরচ যোগ করলে ব্যবসায়ে লাভজনক থাকা কঠিন হয়ে যায়। আমাদের মতো দেশে প্রতিবছর একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা জরুরি, যা কম সুদহারের মাধ্যমে সহজতর হয়। তবে সুদহার অবশ্যই মুদ্রানীতির মাধ্যমে নির্ধারণ করা উচিত, যা ২০২০ সালে হয়নি।
করোনার পর বিশ্বজুড়ে মূল্যস্ফীতি বেড়েছিল। আমার ২৭ বছরের ক্যারিয়ারে আমেরিকায় এত উচ্চ মূল্যস্ফীতি দেখিনি। তবে তারা ধাপে ধাপে সেটা কমিয়ে আনতে পেরেছে সঠিক মুদ্রানীতি ও বাজারব্যবস্থার মাধ্যমে। আমাদের দেশে সেটি হয়নি, কারণ দীর্ঘদিন সময়োপযোগী মুদ্রানীতি প্রণয়ন করা হয়নি। সুদহার কমানোর ফলে বিনিয়োগ ও ভোক্তাদের খরচ কমার কথা থাকলেও বাস্তবে অনেক কোম্পানি শুধু এই সুযোগে ভালো মুনাফা করেছেন প্রান্তিক ভোক্তারা এর সুফল কমই পেয়েছেন।
দেশের ও আমাদের গ্রাহকদের প্রয়োজন অনুযায়ী করপোরেট ঋণ আগের মতোই থাকবে। তবে এর পাশাপাশি খুচরা ঋণ, এসএমই, কৃষিঋণ ও ক্রেডিট কার্ড খাতে আরও মনোযোগ দেওয়া হবে। আমরা ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তাদেরও সহজ শর্তে ঋণ দিতে চাই।
২০২২ সাল থেকে ডলার–সংকট চলছে। এখন কিছুটা বাজারভিত্তিক ব্যবস্থা চালু হয়েছে, তবে এর পুরো সমাধান কীভাবে সম্ভব?
শেখ মোহাম্মদ মারুফ: ডলারের সংকট কিছুটা কমে এসেছে। রপ্তানি ও প্রবাসী আয়ের ইতিবাচক ধারা দেখা যাচ্ছে, যার ফলে চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত দেখা যাচ্ছে। আগে ব্যাংকগুলোর মধ্যে ডলারের দামে বড় পার্থক্য ছিল, যা এখন অনেকটাই কমে এসেছে। এর ফলে ডলারের প্রবাহ বেড়েছে।
এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রে নতুন সরকার আসার পর রপ্তানি আদেশেও ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে। বড় পোশাক কারখানাগুলো ইতিমধ্যেই আগামী এক-দুই মৌসুমের ক্রয়াদেশ পেয়ে গেছে। তবে দেশে রাজনৈতিক পরিবর্তনের কারণে অবকাঠামো খাতের বিনিয়োগে কিছুটা স্থবিরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে । বিনিয়োগ বাড়লে আমদানি বাড়বে, ফলে ডলারের চাহিদা আবার বাড়বে। এ জন্য ডলারের বিনিময় হার যত দ্রুত সম্ভব পুরোপুরি বাজারভিত্তিক করা দরকার।
এ ছাড়া আমাদের মুদ্রা ব্যাবস্থাপনা পুরোপুরি বাজারভিত্তিক না হওয়ার কারণে অনেক বিদেশি বিনিয়োগকারী বাংলাদেশের মুদ্রার মান অতিমূল্যায়িত মনে করে এখানকার শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ কমিয়ে দিয়েছে। বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে হলে আমলাতান্ত্রিক ও কর–সংক্রান্ত জটিলতা দূর ও মুদ্রার বাস্তবসম্মত মূল্যায়ন করা জরুরি।
আমানতের প্রবৃদ্ধি কমে ৭ দশমিক ৫ শতাংশে নেমেছে। ফলে ব্যাংকগুলোর ঋণ দেওয়ার সক্ষমতাও কমছে। বিনিয়োগ বাড়াতে আমানতের প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর উপায় কী?
শেখ মোহাম্মদ মারুফ: মূল্যস্ফীতির হার বিবেচনায় নিলে, প্রকৃত অর্থে আমানতের প্রবৃদ্ধি অনেকটা ঋণাত্মক হয়ে গেছে। মানুষ সঞ্চয়পত্র ভেঙে সংসার খরচের জন্য টাকার জোগান দিচ্ছে। এ পরিস্থিতি পরিবর্তন করতে হলে সঠিক মুদ্রানীতির প্রয়োগ প্রয়োজন।
মুদ্রানীতি শুধু প্রণয়ন করলেই হবে না, সেটির কার্যকর বাস্তবায়নও নিশ্চিত করতে হবে মুদ্রানীতির বিভিন্ন উপকরণ প্রয়োগের মাধ্যমে। একদিকে মুল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির কথা বলছি, অন্যদিকে ট্রেজারি বিলের সুদহার কমছে। ফলে নীতিগতভাবে একটি বিপরীতমুখী অবস্থা তৈরি হচ্ছে, যা বর্তমান মুদ্রানীতি বাস্তবায়নের জন্য অনুকূল নয়।
দুর্নীতি ও অনিয়মের কারণে অনেক ব্যাংক দুর্বল হয়ে পড়েছে। এসব ব্যাংক কি উদ্ধার করা সম্ভব?
শেখ মোহাম্মদ মারুফ: আগে যেসব ব্যাংক দুর্বল হয়ে পড়েছিল সেগুলোর অনিয়ম এখনকার মতো এত ব্যাপক ছিল না। তখন দুর্বল ব্যাংকগুলো সঠিক পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে পুনরুদ্ধারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল।
এখন কয়েকটি ব্যাংকের যে পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে, তা সঠিক পরিচালনা, কার্যকর ব্যবস্থাপনা ও সরকারি তারল্য–সহায়তার মাধ্যমে সামলানো সম্ভব। এটি করতে ৫ থেকে ১০ বছর বা আরও বেশি সময় লাগতে পারে। শোনা যায়, কোনো কোনো ব্যাংকের ৮০ শতাংশ ঋণ অনাদায়ী হয়ে পড়েছে। এ রকম ব্যাংক যথাযথ তারল্য–সহায়তা ও সুশাসন নিশ্চিতের মাধ্যমে ঘুরে দাঁড়াতে পারে। আশপাশের দেশগুলোর উদাহরণ দেখলে বোঝা যাবে, সুসংগঠিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ব্যাংকগুলোকে পুনরুজ্জীবিত করা সম্ভব।
ঢাকা ব্যাংকের ৩০ বছরের যাত্রায় ধারাবাহিক অগ্রগতি দেখা গেছে। আপনি সম্প্রতি দায়িত্ব নিয়েছেন। সামনের পরিকল্পনা কী?
শেখ মোহাম্মদ মারুফ: ঢাকা ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ খুবই দূরদর্শী। যার ফলে ব্যাংকটি ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। আমাদের জনবল দক্ষ, তবে অপ্রয়োজনীয় জনবল নেই। এখন পরবর্তী ধাপে যেতে হলে সঠিক দিকনির্দেশনা প্রয়োজন, যা আমরা পেয়েছি।
সময় বদলেছে, তাই আমরা ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে দেশের প্রান্তিক মানুষের কাছে পৌঁছাতে চাই। দেশের ও আমাদের গ্রাহকদের প্রয়োজন অনুযায়ী করপোরেট ঋণ আগের মতোই থাকবে। তবে এর পাশাপাশি খুচরা ঋণ, এসএমই, কৃষিঋণ ও ক্রেডিট কার্ড খাতে আরও মনোযোগ দেওয়া হবে। এসব ঋণের প্রবাহ ও বিতরণ যুগোপযোগী করা হবে। আমরা ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের সহজ শর্তে ঋণ দিতে চাই, যাতে কম খরচে বেশি মানুষের কাছে সেবা পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হয়।
পাশাপাশি রপ্তানি খাত, খাদ্য উৎপাদন, জনশক্তি উন্নয়নে এবং স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে অর্থায়ন করতে চাই, যা ভবিষ্যতে দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
আমরা শুধু মুনাফার দিকে তাকাচ্ছি না, মূলধন শক্তিশালী করার দিকেও নজর দিচ্ছি। আমরা দক্ষ জনবল নিয়ে একটি প্রতিষ্ঠান তৈরি করতে চাই, যা বর্তমান ও পরবর্তী প্রজন্মের আর্থিক চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম হবে।