সাক্ষাৎকার: আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী

বিনিয়োগকারীদের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য অপেক্ষা করতে হবে

আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য। ২০০১ থেকে ২০০৪ সালের মার্চ পর্যন্ত বিএনপির নেতৃত্বাধীন সরকারে বাণিজ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার উদ্যোগ, দেশের অর্থনীতি ও ব্যবসা–বাণিজ্য, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এবং বিএনপি ক্ষমতায় গেলে কী করতে চায়—এসব নিয়ে তিনি খোলামেলা কথা বলেছেন প্রথম আলোর সঙ্গে। গত বৃহস্পতিবার রাজধানীর একটি হোটেলে তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি সেলিম জাহিদফখরুল ইসলাম। এটি সেই সাক্ষাৎকারের অর্থনৈতিক অংশ।

প্রথম আলো:

বিগত সরকারের আমলে অর্থনীতি দুর্দশার দিকে যাচ্ছিল। বর্তমান সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার আট মাসের মাথায় এখনকার পরিস্থিতি নিয়ে আপনার মূল্যায়ন কী?

আমীর খসরু: সামষ্টিক অর্থনীতিকে আমরা স্থিতিশীলতার দিকে নিয়ে এসেছিলাম। মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির হার ভালো পর্যায়ে ছিল। শিল্প খাতের পাশাপাশি শেয়ারবাজারের রাজনীতিকরণ হয়নি। বিশেষ সুবিধা দিয়ে আলাদা গোষ্ঠী আমরা তৈরি করিনি। কিন্তু পরে আওয়ামী লীগ এসে ব্যাংক খাত ও শেয়ারবাজার লুটপাট করেছে। বড় ধরনের দুর্নীতি হয়েছে। অনেকে ফুলেফেঁপে উঠেছে। এমনকি দুর্নীতির মাধ্যমে লুট করা অর্থ বিদেশ পাচার করা হয়েছে। এত কিছুর পর বাংলাদেশ একটা কঠিন সময়ে এসে দাঁড়িয়েছে। কী বলব, ব্যাংকগুলো তো এখন আমানতকারীদের টাকাই দিতে পারছে না।

প্রথম আলো:

আট মাসে আপনি কী দেখছেন?

আমীর খসরু: এটা তো অন্তর্বর্তী সরকার। স্বৈরাচারের পতনের পর একটা নির্বাচন দিয়ে এ সরকার চলে যাবে, তার জন্যই তো আমরা লড়েছি। এটাই তাদের মূল দায়িত্ব ছিল। এর বাইরেও তারা উদ্যোগ নিয়েছে, আমরাও স্বাগত জানাই। কিন্তু একটা নির্বাচিত সরকার না থাকলে যথাযথ নীতি–পদক্ষেপ নেওয়া যায় না। দেশের ভবিষ্যৎ বিনিয়োগ নীতি কী হবে, অলিগার্ক (মুষ্টিমেয় কিছু ধনী ও প্রভাবশালী ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর হাতে ক্ষমতা কুক্ষিগত হওয়া) মডেলের বদলে সঠিক মডেল কী হবে—এসব গুরুত্বপূর্ণ। শুধু রাজনীতির গণতন্ত্রায়ণ হলে হবে না, অর্থনীতিরও গণতন্ত্রায়ণ দরকার। এই বিষয়গুলোর জন্য সবাই নির্বাচিত সরকারের জন্য অপেক্ষা করছে। স্বাভাবিক কারণেই আমার খুব বেশি প্রত্যাশা নেই। বিএনপি নির্বাচিত হলে ভবিষ্যতের বিনিয়োগকারীদের প্রতি আমাদের মনোভাব ইতিমধ্যে আমরা জানিয়ে দিয়েছি।

আরও পড়ুন
প্রথম আলো:

কিছুদিন আগে একটা বিনিয়োগ সম্মেলন হয়ে গেল। সম্মেলনের আয়োজন ও উপস্থাপনা নিয়ে অনেকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রশংসা করেছেন। অনেকে এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তাকে বাধা হিসেবে দেখছেন। আপনি কী মনে করেন?

আমীর খসরু: শুনুন, বিনিয়োগের প্রথম শর্তই হচ্ছে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। তারপর হচ্ছে ব্যবসায়ের পরিবেশ আছে কি না। এগুলোর সম্মিলন না হলে বিনিয়োগকারীরা সিদ্ধান্ত নেবেন কেন। তাই বিনিয়োগকারীদের জানিয়ে দিয়েছি, আমরা ক্ষমতায় এলে তাঁদের জন্য কী করা হবে।

প্রথম আলো:

আপনি বাণিজ্যমন্ত্রী ছিলেন। জানেন, দেশে মূল্যস্ফীতির হার এখন ৯ শতাংশের বেশি। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বর্তমান সরকার যেসব উদ্যোগ নিয়েছে, সেগুলোকে আপনি যথেষ্ট মনে করেন?

আমীর খসরু: একটা উদাহরণ দিই। পোশাক খাতে একধরনের অস্থিরতা আছে। তা নিয়ন্ত্রণের জন্য সেনাবাহিনী, পুলিশ বাহিনীসহ সবাই চেষ্টা করেও পারেনি। আমরা যখন ক্ষমতায় ছিলাম, তখন এসব ক্ষেত্রে রাজনৈতিক শক্তিগুলোকে কাজে লাগিয়েছি। গণতান্ত্রিক সরকারের এটাই হচ্ছে বড় শক্তি। রাজনৈতিক শক্তি ছাড়া শুধু সেনাবাহিনী ও পুলিশ বাহিনী দিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা কঠিন। সিদ্ধান্ত নিলেই হবে না, তা যদি বাস্তবায়ন করা না যায়, লাভ নেই। বাস্তবায়নের জন্যই দরকার সবার অংশগ্রহণ। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কথা যদি বলেন, শুধু টিসিবি দিয়ে তা হবে না। পুরো বিষয়টা সরবরাহব্যবস্থার সঙ্গে সম্পর্কিত এবং এটা একটা চলমান প্রক্রিয়া, সরকারের দিক থেকে সার্বক্ষণিক নজরদারি করার বিষয়।

প্রথম আলো:

বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৮২ শতাংশে নেমেছে গত ফেব্রুয়ারিতে। এটি ২১ বছরের মধ্যে রেকর্ড। এই প্রবৃদ্ধির হার বেগবান করার উপায় কী?

আমীর খসরু: বিনিয়োগকারীদের অপেক্ষা করতে হবে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য। স্থিতিশীলতা না এলে বিনিয়োগ আসবে না, তা সরকারের পক্ষ থেকে যত ধরনের পদক্ষেপই নেওয়া হোক না কেন।

প্রথম আলো:

টিসিবিকে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার হিসেবে ভাবা হয়। অথচ আপনি বাণিজ্যমন্ত্রী থাকার সময় সংস্থাটিকে দুর্বল করেছিলেন। বর্তমান বাস্তবতায় আপনি কি টিসিবিকে আরও শক্তিশালী করার পক্ষে?

আমীর খসরু: টিসিবি হস্তক্ষেপ করার মতো সংস্থা। এটা সব সময় ব্যবহার করা যায় না। সেটা হলে বাজার বিচ্যুত হয়ে যাবে। মুক্তবাজার অর্থনীতির কথা বললে চাহিদা ও সরবরাহের ভিত্তিতেই মূল্য ঠিক হবে। যখন সরবরাহের ঘাটতি হবে, তখন টিসিবিকে ব্যবহার করতে হবে। টিসিবিকে সব সময় ব্যবহার করলে যারা সারা বছর ব্যবসা করছে, তারা অসুবিধায় পড়ে যাবে। তারা তখন ব্যবসা করতে নিরুৎসাহিত হবে। তবে বেসরকারি খাত যেন সরবরাহব্যবস্থা ঠিক রাখে, তা নিশ্চিত করতে সরকারের নজরদারি থাকা চাই।

প্রথম আলো:

এক কোটি পরিবারের জন্য বছরব্যাপী কয়েকটি নিত্যপণ্য সাশ্রয়ী দামে বিক্রি করে আসছে টিসিবি, তা করবে না?

আমীর খসরু: এটা চলবে, চলুক। এটা হচ্ছে বিতরণ। বিতরণের কাজটি টিসিবির করছে। নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য টিসিবির মতো একটা সংস্থা থাকতেই হবে। তবে বিতরণের কাজটি টিসিবি করতে পারে, অন্য সংস্থাও পারে। একসময় যেমন রেশনব্যবস্থা ছিল। সারা বছর ব্যবসা করার কাজ টিসিবির করার দরকার নেই। বিএনপির পক্ষ থেকে আমরা চাচ্ছি, নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য বছরব্যাপী রেশনের স্থায়ী ব্যবস্থা। এখন যেমন বাড়িঘর ছেড়ে ট্রাকের পেছনে দুই ঘণ্টা ধরে লাইনে থেকে কেউ পেলেন, কেউ পেলেন না, এমনটা আমরা চাই না।

প্রথম আলো:

বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের বড় অংশীদার ভারত। ব্যবসায়ীরা কেন পণ্য আমদানির জন্য ভারতকে বেছে নেন? বিকল্প উৎস ভাবার সুযোগ আছে?

আমীর খসরু: একটা জিনিস মনে রাখতে হবে, এটা মুক্তবাজার অর্থনীতি। আবার এ–ও মনে রাখতে হবে, কোনো বিশেষ দেশের ওপর নির্ভরশীল থাকাও ভালো নয়। আমাদের সব সময় বহুপক্ষীয় ব্যবস্থার পক্ষে থাকতে হবে। আগের সরকার নির্দিষ্ট কিছু দেশভিত্তিক চিন্তা করেছিল। এটা তারা করেছিল বিভিন্ন কারণে, বিশেষ করে তাদের রাজনৈতিক ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য। আমাদের সময়ে তা করিনি। যেখান থেকে কমে পাওয়া যায়, সেখান থেকেই আমরা কিনব। বিকল্প উৎসেরও সন্ধান করব। ভারত যখন মাঝেমধ্যে কিছু পণ্যের রপ্তানি বন্ধ করে দেয়, তখন বিপদে পড়তে হয়। বন্ধ করার আগেই বিকল্প উৎস বের করে রাখতে হবে, যাতে সরবরাহব্যবস্থায় বিঘ্ন না ঘটে। এটা সরকারের দায়িত্ব। কোনো পণ্য আমদানির জন্য নির্দিষ্ট দেশের কাছে জিম্মি হওয়া যাবে না। জিম্মি হয়ে গেলে বিকল্প উৎসগুলো সামনে আসবে না।

আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী গত বৃহস্পতিবার প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেন
ছবি: সাজিদ হোসেন
প্রথম আলো:

কিন্তু বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা তো মূলত ভারতে যাচ্ছেন।

আমীর খসরু: একটা উদাহরণ দিই, ভারতের অনেক সুতা স্থলবন্দর দিয়ে আসছিল। এখন আসবে নৌপথে। এখানে অনেক বিষয় আছে। দেশে সুতা উৎপাদন উৎসাহিত করতে হবে। অনেক সুতার কারখানা দেশে হয়ে গেছে। শুরুতে হয়তো একটু দাম বেশি পড়বে, কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে ঠিক হয়ে যাবে। এ দেশে অনেক কিছু করা সম্ভব। আপনি বলছেন ভারতের কথা। আমি সামান্য সুতার জন্য নির্ভরশীল থাকি, তাহলে তো এটাই চলবে।

প্রথম আলো:

ভারত যে হঠাৎ তৃতীয় দেশে বাংলাদেশি পণ্য রপ্তানির জন্য ট্রান্সশিপমেন্ট বন্ধ করে দিল, সে বিষয়ে কিছু বলবেন?

আমীর খসরু: অন্য দেশ কী করছে, তা তো আপনার হাতে নেই। ভারতের পদক্ষেপের বিষয়ে নিশ্চয়ই সরকার দেখবে। বাংলাদেশ-ভারতের সম্পর্ক খারাপের কারণেই এটা হয়ে থাকতে পারে। ভারতের এ সিদ্ধান্ত উভয়ের সম্পর্ককে আরও খারাপের দিকে নিয়ে যাবে। ভারত যেটা করেছে, তা গ্রহণযোগ্য বলতে পারছি না। বিভিন্ন দেশের ওপর দিয়ে তৃতীয় দেশে পণ্য যাচ্ছে—এ যুগে দুনিয়া যেখানে উন্মুক্ত হচ্ছে, ভারত যেখানে বারবার কানেকটিভিটির কথা বলে আসছে, সেখানে ভারতই আবার বন্ধ করে দিচ্ছে। এ সিদ্ধান্ত দুই দেশের সম্পর্কোন্নয়নের জন্য ভালো কিছু ডেকে আনবে না।

প্রথম আলো:

যুক্তরাষ্ট্রের ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন যে অন্য দেশের মতো বাংলাদেশি পণ্যেও পাল্টা শুল্ক আরোপ করেছে। সরকার তিন মাস স্থগিতের জন্য চিঠি দিয়েছে। সবার জন্যই তা তিন মাস স্থগিত করা হয়েছে। পুরো বিষয়টি ঠেকাতে আর কী উদ্যোগ নিতে পারে বাংলাদেশ?

আমীর খসরু: ট্রাম্প তো এটা করেছে তার দেশের বাণিজ্যঘাটতি কমিয়ে আনতে। মাঝখানে আর কিছু নেই। সোজা কথা। যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমরা তুলা, সয়াবিন তেল, তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসসহ প্রযোজ্য ক্ষেত্রে আমদানি বাড়াতে পারি। তবে বাণিজ্যঘাটতি হিসাব করার ক্ষেত্রে সেবা খাতের দিকটি কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসন আনেনি। সেটা হিসাবের মধ্যে এনে দর-কষাকষির সুযোগ আছে। এটা আমাদের করতে হবে। পাশাপাশি আমাদের সক্ষমতাও বাড়াতে হবে। কমাতে হবে শুধু পোশাক রপ্তানির ওপর একক নির্ভরশীলতা। তাই বিএনপির পক্ষ থেকে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, পোশাক খাতে যে সুবিধা দেওয়া হচ্ছে, ক্ষমতায় এলে সম্ভাব্য আরও ১০ থেকে ১২টি খাতে একই ধরনের সুবিধা দেওয়া হবে।