দাম বাড়ে কি শুধু সিন্ডিকেটের জন্য, ভোক্তার কী ভূমিকা

বাজারফাইল ছবি: প্রথম আলো

বাজারমূল্যের চেয়ে কম দামে পণ্য বিক্রি করেও যে মুনাফা করা যায়, তার নজির গড়েছে রাজধানীর শাহজাহানপুরের খলিল গোস্ত বিতান। বাজারমূল্যের চেয়ে অন্তত ১০০ টাকা কম দরে গরুর মাংস বিক্রি করছে তারা। বেচাকেনা বেড়ে যাওয়ায় এই দামে বিক্রি করেও পুষিয়ে নিতে পারছে তারা।

তবে দাম বাড়লে কিছু জিনিসের চাহিদা অনেক সময় কমে না, বরং বেড়ে যায় এ কারণে যে অতিরিক্ত দামের কারণে সেই পণ্যের একধরনের ‘অরা’ বা অলৌকিক আভা তৈরি হয়। দেখা গেছে, কিছু কিছু অতি দামি ব্র্যান্ডের পণ্যের দাম এত বেশি রাখা হয় বলেই ওই সব পণ্যের চাহিদা বেশি, যা অর্থনীতির চাহিদা তত্ত্বের (দাম বাড়লে চাহিদা কমে) ঠিক উল্টো।

সুইজারল্যান্ডের পাটেক ফিলিপ ব্র্যান্ডের সবচেয়ে কম দামের হাতঘড়ির দামও ১২ হাজার মার্কিন ডলারের বেশি; যদিও ১০০ ডলারের একটি জাপানি সিটিজেন বা ক্যাসিও ব্র্যান্ডের ঘড়ি দিয়েও একই কাজ সারা যায়। বিষয়টি হলো একশ্রেণির মানুষ বিপুল অর্থের মালিক হলে তাঁরা তখন নিজেদের আলাদা শ্রেণি হিসেবে জাহির করার চেষ্টা করেন; সেই প্রবণতা থেকেই এ ধরনের অতি দামি ব্র্যান্ডের পণ্যের চাহিদা তৈরি হয়। সে কারণে লুইস ভুইটন ব্র্যান্ডের হাতব্যাগের দাম প্রায় এক হাজার থেকে পঞ্চাশ হাজার ডলার পর্যন্ত হতে পারে, যদিও তার সঙ্গে কম দামি ব্র্যান্ডের ব্যাগের ইতরবিশেষ নেই।

এই যে গরুর মাংস ও খাসির মাংসের দাম এতটা বেড়েছে, তার সঙ্গে উঠতি মধ্যবিত্তের মাত্রাতিরিক্ত চাহিদার যোগ আছে ধারণা করা যায়। সঙ্গে চাঁদাবাজি, কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধি—এসব বিষয় তো আছেই।

এই উভয় প্রকারের মাংস শরীরের জন্য খারাপ—এটা জানা থাকা সত্ত্বেও এগুলোর প্রতি আকর্ষণের কমতি নেই। দাম যতই হোক না কেন, একশ্রেণির মানুষ তা কিনবেনই। ফলে বাজারের কারসাজিকারীরা দাম যতই বৃদ্ধি করুন না কেন, গরু ও খাসির মাংসের বিক্রি থেমে নেই। পরিণামে সীমিত ও নিম্ন আয়ের মানুষের পক্ষে এসব খাওয়া এখন বিলাসিতার পর্যায়ে চলে গেছে।

আমাদের দেশের সাধারণ ধারণা হলো কিছু ব্যবসায়ী রমজান এলেই সিন্ডিকেট করে দ্রব্যমূল্য বাড়িয়ে দেন। বাজারে চাহিদার যে একটি বিষয় আছে, সেটিও খেয়াল রাখা দরকার। ব্যবসায়ীরা কখনো কখনো অন্যায্যভাবে বাজারের চাহিদার সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করেন বা নেন। কিন্তু ক্রয়ক্ষমতা আছে বলেই বিত্তবান মানুষ দামের দিকে না তাকিয়ে যত খুশি কিনবেন, সেটা কি দায়িত্বশীল ভোক্তার আচরণ? তাঁরা কেনাকাটায় সংযমী হলে ব্যবসায়ীদের দাম বাড়ানোর সুযোগ কমে যায় এবং সীমিত সরবরাহের বিপরীতে বেশি চাহিদার খাদ্যপণ্যগুলো প্রকারান্তরে সবাই মিলে ভাগ করে নিতে পারেন।

তবে ব্যবসায়ীরা যে অন্যায্যভাবে বাড়তি চাহিদার সুযোগ নেন, সে জন্য তাঁদের শাস্তির আওতায় আনা জরুরি। এ ছাড়া কোন কারণে দাম কতটা বাড়ে, তা নিয়ে অর্থনীতিবিদেরা গবেষণা করতে পারেন।

আরেকটি বিষয় হলো মধ্যবিত্তের প্যানিক বায়িং বা আতঙ্কিত হয়ে কেনাকাটা করা। বাজারে নিত্যপণ্যের ঘাটতি আছে বা রোজার সময় নিত্যপণ্যের সরবরাহ ঘাটতি হবে, এমন খবর না থাকলেও মধ্যবিত্তদের এভাবে বাজারে হামলে পড়ার মানসিকতা বিস্ময়ের জন্ম দেয়। হঠাৎ করে এভাবে বাড়তি কেনাকাটার কারণেও ব্যবসায়ীরা কারসাজি করার সুযোগ পান। এক বছর ধরে মূল্যস্ফীতির হার ৯ শতাংশের ওপরে।

চলতি রোজায় যে হারে বিভিন্ন প্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বেড়েছে, তাতে এ মাসে মূল্যস্ফীতির সূচক কোথায় ওঠে, সেটাই এখন দেখার বিষয়। এ অবস্থায় খেটে খাওয়া বা নিম্ন ও সীমিত আয়ের মানুষের ভোগান্তি বাড়ে—বিপদ ঠিক এখানেই।

অন্যদিকে দাম কমলেই যে ব্যবসায়ীদের মুনাফা কমে যায় না, তার নজিরও ভূরি ভূরি আছে।

অর্থনীতিবিদ এন্ড্রু শিফ ও পিটার শিফের অর্থনৈতিক দর্শন অনুযায়ী, কম দামে গরুর মাংস বিক্রি করে তাই ক্ষতির মুখে পড়ছেন না খলিল, বরং আরও লাভবান হতে পারেন তাঁরা।

এই দুই অর্থনীতিবিদ দেখান, বিশ শতকের শুরুর দিকে হেনরি ফোর্ড তাঁর কোম্পানির গাড়ির মূল্য কমালে কোম্পানির ক্ষতি তো হয়ইনি, উল্টো অবস্থার উন্নতি হয়। ওই সময় কোম্পানির কর্মীরা সবচেয়ে বেশি বেতন পেতেন। সাম্প্রতিক ইতিহাসে কম্পিউটারের নজির দেওয়া যায়, প্রযুক্তির উন্নতি সত্ত্বেও এই বস্তুটির দাম ধারাবাহিকভাবে কমেছে (সম্প্রতি দাম যা বেড়েছে, তা মূলত ডলারের বিনিময় হার বৃদ্ধির কারণে)। কিন্তু কম্পিউটার উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলো সে কারণে ক্ষতির মুখে পড়েছে এমনটা হয়নি; বরং তারা বিপুল মুনাফা করছে। উন্নত ডিজাইন ও দক্ষতা বৃদ্ধির কারণে প্রতিবছর লাখ লাখ মানুষ কম খরচে ডিজিটাইজেশনের বিস্ময়কর অভিজ্ঞতা নিতে পারছে।

অর্থাৎ উৎপাদন প্রক্রিয়ার উন্নতি ঘটিয়ে পণ্যের দাম কমানো সম্ভব। অন্যদিকে বাজারের দিকেও নজর রাখা প্রয়োজন। কারণ, এর আগে দেখা গেছে, ভারত থেকে ডিম আমদানির খবর বাজারে আসামাত্র ডিমের দাম কমে গেছে। একই ঘটনা আলুর ক্ষেত্রেও দেখা গেছে। যদিও দেশের বাজারের চাহিদার তুলনায় আমদানির পরিমাণ ছিল নগণ্য।

বিষয়টি হলো পণ্যমূল্য সহনীয় পর্যায়ে থাকলে সব শ্রেণির মানুষের পক্ষে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসহ পছন্দের পণ্য কেনা সম্ভব হয়। এতে অর্থনীতির চাকা সচল থাকে। এখন যে অবস্থা, তাতে বিপুলসংখ্যক নিম্ন আয়ের মানুষের পক্ষে ব্যয় কমানো ছাড়া পথ নেই।

গত বছর মার্চ মাসে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেমের এক জরিপে দেখা গেছে, মূল্যস্ফীতির চাপে খাবারের খরচ মেটাতে মানুষ ব্যয় কাটছাঁট করছে। জরিপে অংশ নেওয়া ৯০ শতাংশ পরিবার জানায়, তাদের খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আনতে হয়েছে; ৯৬ শতাংশ পরিবার মাংস খাওয়া কমিয়েছে। যেমন ছয় মাস আগেও যেসব পরিবারে মাসে চারবার মুরগি খেত, এখন তারা দুবার মুরগি খায়। মাছ খাওয়া কমিয়েছে ৮৮ শতাংশ পরিবার। এ ছাড়া ৭৭ শতাংশ পরিবার ডিম এবং ৮১ শতাংশ পরিবার ভোজ্যতেল খাওয়া কমিয়েছে। এই জরিপের ফল প্রকাশিত হয় ২০২৩ সালের মার্চ মাসে; জরিপ করা হয়েছে তার আগের ছয় মাসে। এরপর থেকে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপরে; এই বাস্তবতায় দরিদ্র ও অরক্ষিত মানুষের পরিস্থিতির কতটা অবনতি হয়েছে, তা বলাই বাহুল্য।  

মনে রাখা দরকার, মানুষের ভোগ ব্যয় কমে গেলে উচ্চ হারে প্রবৃদ্ধি হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়।