বাজারভিত্তিক বিনিময় হার, ডলারের দর বাড়বে না কমবে

মার্কিন ডলারছবি: রয়টার্স

বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর জানিয়েছেন, এখন থেকে মার্কিন ডলারের দাম ঠিক করবে ‘বাজার’। তিনি অবশ্য আশা করেছেন, ডলারের দাম এখনকার দামের আশপাশেই থাকবে। আসলেই কি তা–ই?

২০২২ সালের কথা। তখন ডলারের দর ছিল ৮৬ টাকা। সেই ডলারের দর এখন ১২২ টাকা। অর্থাৎ তিন বছরে টাকার অবমূল্যায়ন ঘটেছে ৪১ দশমিক ৮৬ শতাংশ। ডলারের দাম বেড়ে গেছে প্রায় ৪২ শতাংশ। অনেকেই সে সময় ডলার কিনে মজুত করেছিলেন। তাঁরা এখন বিপুল সম্পদের মালিক।

অনেকেই ভাবছেন, আবারও কি ডলারের দর লাফ দেবে। ডলার কিনে রাখলেই–বা কী লাভ। বাংলাদেশ কি শ্রীলঙ্কার মতো হবে, ২০২২ সালে যেখানে বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করার এক সপ্তাহের মধ্যে ডলারের দর বেড়ে গিয়েছিল প্রায় ৮০ শতাংশ। বাংলাদেশে কী হবে—এটাই বড় প্রশ্ন।

অর্থনীতির গতি এখন শ্লথ। বিনিয়োগে চরম মন্দা। দেশি বিনিয়োগ যেমন নেই, বিদেশি বিনিয়োগও আসছে না। আমদানিতে তেমন চাঞ্চল্য নেই। শঙ্কার মধ্যেও রপ্তানি আয়ে প্রবৃদ্ধি আছে। গত ১৫ বছরে বৈধ-অবৈধ পথে আয় করা বিপুল সম্পদ ইতিমধ্যে পাচার করেছেন, তাঁরা দেশও ছেড়েছেন।

নতুন করে যাঁরা অবৈধ আয় করছেন, তাঁরা এখনো পাচার করা শুরু করেননি। সে কারণে হুন্ডির চাহিদা আপাতত নেই। আপাতত ডলারের চাহিদাও তেমন একটা নেই। ফলে ধারণা করা হচ্ছে, বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করা হলেও ডলারের দাম এখন বড় লাফ দেবে না। সুতরাং মন্দা অর্থনীতির সুফল হয়তো এখন পাবে বাংলাদেশ।

এর আগেও বাংলাদেশ বিভিন্ন সময়ে বিনিময় হারের ক্ষেত্রে নানা ধরনের পরিবর্তন এনেছে। এর প্রভাবও ছিল নানা ধরনের। যেমন–

২২ জানুয়ারি ১৯৭২

১৯৭২ সালের ২২ জানুয়ারি সদ্য গঠিত কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর এ এন হামিদুল্লাহ এক বার্তা সংস্থাকে সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন। সেটাই ছিল বিনিময় হার নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের দেওয়া প্রথম বক্তব্য। তিনি বলছিলেন, ‘বাংলাদেশ স্টার্লিং এলাকায় যোগ দেবে। ১ পাউন্ডের সঙ্গে বিনিময়ের মাত্রা হবে ১৮ দশমিক ৯৬৭৭ টাকা। ভারত ও বাংলাদেশের মুদ্রার মান সমান হবে।’

পাকিস্তান আমলেও মধ্যবর্তী মুদ্রা ছিল ব্রিটিশ পাউন্ড স্টার্লিং। স্বাধীনতার পরে সেটা আর পরিবর্তন করা হয়নি। বিনিময় হার নির্ধারণ করা হয়েছিল প্রতিবেশী ভারতের মুদ্রার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে। যদিও পাউন্ডের দর ছিল পাকিস্তান আমলের তুলনায় ৩৩ শতাংশ বেশি। অর্থাৎ বাংলাদেশ শুরুতেই একলাফে টাকার অবমূল্যায়ন করেছিল ৩৩ শতাংশ।

তখন অবশ্য আন্তর্জাতিক অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ মুদ্রা ছিল ডলার। ১৯৭২ সালের ২৩ জানুয়ারি থেকে পাউন্ডের বিনিময় হার ডলারের সঙ্গে ভাসমান বা ফ্লোটিং করা হয়। তখন দেশে ডলারের বিনিময় হার ছিল ৭ দশমিক ২৭০২৭ টাকা। ব্রিটিশ মুদ্রা পাউন্ড স্টার্লিংয়ের সঙ্গে বিনিময় হারকে সম্পর্কিত করাকেই বলা হয় ‘পেগ’।

১৭ মে ১৯৭৫

দেশে বিনিময় হারে প্রথম বড় পরিবর্তন আনা হয়েছিল ১৯৭৫ সালের ১৭ মে। ওই দিন টাকার অবমূল্যায়ন করা হয় ৫৮ দশমিক ১৬ শতাংশ। ফলে পাউন্ডের দর দাঁড়ায় ৩০ টাকা, যা আগে ছিল ১৮ দশমিক ৯৬৭৭ টাকা। যদিও খোলাবাজারে পাউন্ডের দর ছিল প্রায় দ্বিগুণ। এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পরামর্শেই। বাংলাদেশের ইতিহাসে এখন পর্যন্ত এটাই সর্বোচ্চ অবমূল্যায়ন।

সে সময় আনুষ্ঠানিক মুদ্রা বিনিময় হারের পাশাপাশি বাজারভিত্তিক সেকেন্ডারি বিনিময় মুদ্রাবাজার চালুর অনুমতি দেওয়া হয়। এতে কার্ব মার্কেটের উদ্ভব ঘটে। সেই কার্ব মার্কেটে পাউন্ডের দাম ছিল আনুষ্ঠানিক দরের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ।

বাংলাদেশ ব্যাংক
প্রথম আলো

১১ জানুয়ারি ১৯৮৩

পাউন্ডের পরিবর্তে মার্কিন ডলারকে মধ্যবর্তী মুদ্রা হিসেবে বেছে নেওয়া হয় ১৯৮৩ সালের ১১ জানুয়ারি। এটি ছিল গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত। কারণ, তত দিনে বিশ্ব অর্থনীতিতে পাউন্ড অনেকটাই গুরুত্ব হারিয়েছে। ১৯৮০-এর দশকে বাংলাদেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের সিংহভাগই হয়েছে মার্কিন ডলারে। তখন বাংলাদেশ অনেকটাই সাহায্যনির্ভর। বিদেশি ঋণসহায়তা, প্রবাসী আয়—সবকিছুই মূলত ডলারে আসছিল। আন্তর্জাতিকভাবেও ডলার হয়ে ওঠে প্রধান মুদ্রা বা রিজার্ভ কারেন্সি। ফলে বাংলাদেশও পাউন্ড ছেড়ে ডলারকে মধ্যবর্তী মুদ্রা বেছে নিতে বাধ্য হয়।

১৭ জুলাই ১৯৯৩

বিনিময় হারকে নিয়ন্ত্রণমুক্ত করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশে প্রথম বড় পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল ১৯৯৩ সালে ১৭ জুলাই। এর আগে দেশে বৈদেশিক মুদ্রাবাজার ছিল না। বাংলাদেশ ব্যাংকই চাহিদা অনুযায়ী ব্যবহারকারীদের বৈদেশিক মুদ্রা বরাদ্দ দিত। সেদিন বাংলাদেশি মুদ্রাকে চলতি হিসাবে রূপান্তরযোগ্য করা হবে বলে জানানো হয়। কথা ছিল, ১৯৯৩ সালের ১ অক্টোবর থেকে এটি কার্যকর হবে। প্রস্তুতির অভাবে পরে ২০ অক্টোবর থেকে কার্যকর হয়। এর মাধ্যমে দেশের বৈদেশিক মুদ্রাবাজারকে আংশিকভাবে উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। সে কারণে কেবল পুঁজি বৈদেশিক মুদ্রায় রূপান্তরযোগ্য রাখা হয়নি।

১৯ অক্টোবর এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের জারি করা প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছিল, ‘চলতি হিসাবে টাকাকে বিনিময়যোগ্য করা হয়েছে। এ সিদ্ধান্ত অবিলম্বে কার্যকর হবে। তবে মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত শিক্ষার খরচ ও অননুমোদিত কোর্সসহ প্রবাসী বাংলাদেশি নাগরিকদের পারিবারিক ব্যয়ের ক্ষেত্রে চলতি হিসাবে টাকার বিনিময়যোগ্যতা কার্যকর হবে না। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বিদেশি ব্যাংক, বিমা কোম্পানি ও অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মুনাফা বিদেশে প্রেরণের ক্ষেত্রে এখন থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতির প্রয়োজন হবে না। বহির্মুখী দৃষ্টিভঙ্গি ও বাজারভিত্তিক নীতি গ্রহণের মাধ্যমে সরকারের টেকসই ও দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই বাংলাদেশ ব্যাংক মুদ্রার বিনিময় হার নিয়ন্ত্রণসমূহ উদার করছে।’

১১ এপ্রিল ১৯৯৪

চলতি হিসাবে টাকাকে রূপান্তরযোগ্য করার শর্ত ছিল মূলত আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফের। এই শর্ত পূরণ করায় ১৯৯৪ সালের ১১ এপ্রিল বাংলাদেশ আইএমএফের আর্টিকেল অব অ্যাগ্রিমেন্টের আর্টিকেল-এইটের স্ট্যাটাস লাভ করে।

এই স্ট্যাটাস পাওয়া হচ্ছে কোনো সদস্যদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক অঙ্গীকার, যা আন্তর্জাতিক আর্থিক লেনদেনে উন্মুক্ত ও বাজারভিত্তিক নীতি গ্রহণের প্রতীক। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ আইএমএফের কাছে অঙ্গীকার করে যে তারা চলতি লেনদেনের ক্ষেত্রে নিজস্ব মুদ্রাকে অবাধে রূপান্তরযোগ্য রাখবে; বাণিজ্য, ভ্রমণ, শিক্ষা ব্যয়, মুনাফা ও রেমিট্যান্স–প্রবাহের মতো বৈধ আন্তর্জাতিক লেনদেনে কারেন্সি ব্যবহারে প্রতিবন্ধকতা রাখবে না এবং বৈষম্যমূলক মুদ্রানীতি চালানো হবে না। ফলে আইএমএফের কাছ থেকে ঋণ পাওয়া বাংলাদেশের জন্য আরও সহজ হয়।

৩১ মে ২০০৩

বিনিময় হারের ক্ষেত্রে এর পরের সবচেয়ে বড় পরিবর্তনটি হয় ২০০৩ সালের ৩১ মে। ওই দিন থেকে ডলারের মূল্যমান নির্ধারণের দায়িত্ব বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার কথা বলা হয়। এর আগপর্যন্ত সামঞ্জস্যপূর্ণ-সম্পর্কিত প্রথা বা ‘অ্যাডজাস্টেবল পেগ’ চালু ছিল। এই প্রথায় বাংলাদেশ ব্যাংকের ঠিক করে দেওয়া নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে অনুমোদিত ডিলাররা বিনিময় হার উদ্ধৃত করতে পারতেন। এটি পুরোপুরি বাজারভিত্তিক বিনিময় হার ছিল না, বরং নিয়ন্ত্রিত বা ‘ম্যানেজড ফ্লোটিং’ ছিল। অর্থাৎ বাংলাদেশ ব্যাংক তখন বাজারে অর্থের সরবরাহ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে ডলারের মূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখত। বৈদেশিক মুদ্রাবাজারের বড় অংশীদার ছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ফলে তার পক্ষে মার্কিন ডলারের সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করা ছিল সহজ।

১২ সেপ্টেম্বর ২০২২

সাবেক আওয়ামী লীগ সরকারের সময় অর্থনৈতিক পরিস্থিতি চরম সংকটে পড়লে আইএমএফের কাছ থেকে ঋণ নিতে বাধ্য হয়। আইএমএফের সঙ্গে বাংলাদেশের এই ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ কর্মসূচি শুরু হয় ২০২৩ সালের ৩০ জানুয়ারি। এই ঋণ পেতে বাংলাদেশ আলোচনা শুরু করে আরও ছয় মাস আগে। এ সময় বিনিময় হারের ক্ষেত্রে অভিনব এক সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরামর্শে বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা) ও অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) ২০২২ সালের ১১ সেপ্টেম্বর এক যৌথ সভায় সিদ্ধান্ত নেয়, তারা ডলারের বিনিময় হার নির্ধারণ করবে। এই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ২০২২ সালের ১২ সেপ্টেম্বর থেকে সব অনুমোদিত ডিলার ব্যাংকগুলোকে নির্ধারিত হারে ডলার কেনাবেচা করতে বলা হয়। এ সময় ডলারের চারটি দর তৈরি হয় বাজারে। আমদানি, রপ্তানি, প্রবাসী আয়, এক্সচেঞ্জ হাউস—সব ক্ষেত্রেই ভিন্ন ভিন্ন দর। সে সময় খোলাবাজারে ডলারের দর ছিল আরও বেশি। সব মিলিয়ে বিনিময় হারব্যবস্থায় দেখা দেয় চরম বিশৃঙ্খলা।

৮ মে ২০২৪

আর পরের পদক্ষেপ হচ্ছে ‘ক্রলিং পেগ’, যা করা হলো ২০২৪ সালের ৮ মে। ‘ক্রলিং পেগ’-এর আক্ষরিক বাংলা হচ্ছে ‘দেশের মধ্যে ডলারের দর লাফ দিতে পারবে না, কেবল হামাগুড়ি দিতে পারবে।’ সেই হামাগুড়িও দিতে হবে নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে। সীমার বাইরে যাওয়া যাবে না। যেমন তখন ঠিক করা হয় ডলারের মধ্যবর্তী দাম ১১৭ টাকার আশপাশে থাকবে আর তা যেন সর্বোচ্চ ১১৮ টাকার মধ্যে লেনদেন হয়। এর নাম হচ্ছে আসলে ‘ক্রলিং পেগ মিড-রেট’ বা মধ্যদর। ডলারের বিনিময়মূল্য এর আশপাশেই থাকতে হবে। অর্থাৎ বিনিময় হারের আর কোনো উচ্চসীমা বা নিম্নসীমা নেই, কিন্তু মধ্যসীমা আছে। এটাই মেনে চলতে হবে। বলা যায়—স্বাধীনতা আছে, তবে অবশ্যই তা নিয়ন্ত্রিত।

১৪ মে ২০২৫

বিনিময় হারের ইতিহাসের সর্বশেষ গুরুত্বপূর্ণ তারিখ হচ্ছে ২০২৫ সালের ১৪ মে। সেদিন বিনিময় হার আরও বাজারভিত্তিক করা হয়। এটি মূলত ক্রলিং পেগই, তবে দাম নির্ধারণের সীমা আগের তুলনায় বাড়বে। যেমন এর আগের পদ্ধতিতে বর্তমান দরের সঙ্গে ২ দশমিক ৫ শতাংশ পর্যন্ত দাম বাড়তে ও কমতে পারত। এর সঙ্গে সর্বোচ্চ ১ টাকা ব্যবধানে ডলার বিক্রি করা যেত। তখন এই সীমা বাড়ানো হয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের জারি করা প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, ‘এখন থেকে বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনের অনুমোদিত ব্যাংক শাখাগুলো (এডি ব্রাঞ্চ) তাদের গ্রাহক ও ডিলারদের কাছে নিজেরা আলোচনার মাধ্যমে বিনিময় হার নির্ধারণ করতে পারবে। এডি শাখাগুলো থেকে প্রতিদিন দুইবার বৈদেশিক মুদ্রা কেনাবেচার তথ্য বাংলাদেশ ব্যাংককে সরবরাহ করবে। এক লাখ ডলারের বেশি কেনাবেচার তথ্য বেলা সাড়ে ১১টার মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংককে জানাতে হবে।

এ ছাড়া বেলা ১১টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত বৈদেশিক মুদ্রা কেনাবেচার তথ্য বিকেল সাড়ে পাঁচটার মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংককে জানাতে হবে। পাশাপাশি আগের মতো বৈদেশিক মুদ্রার কেনাবেচার তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিদিনের একটি ভিত্তিমূল্য বা রেফারেন্স প্রাইস প্রকাশ করবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ওয়েবসাইটের মাধ্যমে এই ভিত্তিমূল্য প্রকাশ করা হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংক আরও জানিয়েছে, ডলারের দাম যাতে অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে না যায়, সে জন্য কঠোর নজরদারি করা হচ্ছে। পাশাপাশি অতি জরুরি প্রয়োজনে ডলারের চাহিদা মেটাতে রিজার্ভ থেকে ৫০ কোটি ডলার দিয়ে একটি তহবিল গঠন করা হয়েছে।

শ্রীলঙ্কার অভিজ্ঞতা

শ্রীলঙ্কায় অর্থনৈতিক সংকট থেকে শুরু হয় রাজনৈতিক সংকট। শেষমেশ রাজাপক্ষে সরকারের পতন ঘটে।
ফাইল ছবি: এএফপি

২০২২ সালের ৭ মার্চ শ্রীলঙ্কার কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাদের রুপি বাজারভিত্তিক বা ভাসমান (ফ্লোটিং এক্সচেঞ্জ) করার সিদ্ধান্ত নেয়। চরম অর্থনৈতিক সংকটের কারণে আইএমএফের কাছ থেকে ঋণ পেতেই দেশটি এ সিদ্ধান্ত নেয়। তবে এর তাৎক্ষণিক প্রভাব ছিল তীব্র। কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই ডলারের বিপরীতে রুপির দর ২০০ থেকে ৩৬০ ছাড়িয়ে যায়। অর্থাৎ প্রায় ৮০ শতাংশ অবমূল্যায়ন হয়।

সে কারণে আমদানি ব্যয় ও মূল্যস্ফীতির হার—দুটোই অনেক বেড়ে যায়। এর পরের কাহিনি সবারই জানা। ব্যাপক অসন্তোষে, বিক্ষোভ ও সহিসংতার মুখে সরকারেরই পতন ঘটে। এমন নয় যে স্থানীয় মুদ্রাকে বাজারভিত্তিক করার কারণে শ্রীলঙ্কা দেউলিয়া হয়েছিল। দেশটির সংকট দেখা দিয়েছিল আগেই, এ ঘটনা সংকটের তীব্রতা আরও বাড়িয়ে দেয়।

সেই শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতি অবশ্য এখন অনেকটাই সামাল দিয়েছে। ২০২৩ সালের মার্চে তারা আইএমএফের কাছ থেকে ২৯০ কোটি ডলারের ঋণসহায়তা পেয়েছে। তাদের রিজার্ভ বেড়েছে, মূল্যস্ফীতিও নিয়ন্ত্রণে।

এটাই কি ভালো সময়

এর আগে বিনিময় হারের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় পরিবর্তন আনা হয়েছিল ২০০৩ সালের ৩১ মে। ওই দিন থেকে টাকাকে ‘ভাসমান মুদ্রা’র ঘোষণা দেওয়া হয়। অর্থাৎ ডলারের মূল্যমান নির্ধারণের দায়িত্ব বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার কথা বলা হয়। নতুন এই বিনিময় হার আসলে পুরোপুরি বাজারভিত্তিক ছিল না, বরং ছিল নিয়ন্ত্রিত বা ‘ম্যানেজড ফ্লোটিং’। এর আগে বাংলাদেশ ব্যাংক ঘোষণা দিয়ে টাকার অবমূল্যায়ন বা অতি মূল্যায়ন করত। যেমন স্বাধীনতার পর থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংক ৮৬ বার অবমূল্যায়ন ও ৬ বার অতি মূল্যায়ন করেছে।

আসলে ২০০৩ সালে অনেকটা প্রস্তুতি নিয়েই বিনিময় হারকে কিছুটা বাজারভিত্তিক করা হয়েছিল। এম সাইফুর রহমান তখন অর্থমন্ত্রী ছিলেন। সে সময় ডলার তেমন শক্তিশালী ছিল না। রপ্তানি পরিস্থিতি ভালো ছিল। সরকারি ব্যাংকগুলোর হাতেও উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ডলার ছিল। ফলে বিনিময় হার বড় কোনো লাফ দেয়নি। এই ঘোষণার আগে প্রতি মার্কিন ডলারের ক্রয়-বিক্রয়ের মধ্যদর ছিল ৫৭ দশমিক ৯০ টাকা। আর নতুন ঘোষণায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানিয়ে দিয়েছিল, ৫৭ দশমিক ৪০ থেকে ৫৮ দশমিক ৪০ টাকার মধ্যে যেকোনো দরে ডিলারদের কাছ থেকে ডলার কেনাবেচা করা যাবে। ভাসমান করার ঘোষণার পর বাজার স্থিতিশীল রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক টাকার সরবরাহ কমিয়ে দেওয়ায় প্রথম কয়েক দিন আন্তব্যাংক লেনদেনের কলমানি হার বেড়ে ৩৫ পর্যন্ত উঠেছিল। পরে আবার স্বাভাবিক হয়। বিনিময় হার ভাসমান করার দিনে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার মজুত ছিল ১৮৯ কোটি ৫২ লাখ ২০ হাজার মার্কিন ডলার। এই রিজার্ভ এক সপ্তাহের মধ্যে ২ বিলিয়ন বা ২০০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যায়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বুধবার দুবাই থেকে অনলাইনে যুক্ত হয়ে সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেন।
প্রথম আলো

গত বুধবারের সংবাদ সম্মেলনে কেন্দ্রীয় ব্যাংক গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, ‘ডলারের বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করার এখন ভালো সময়। কারণ, এখন প্রবাসী আয় ভালো আসছে, রিজার্ভও স্থিতিশীল, উন্নতি হয়েছে লেনদেন ভারসাম্যের। আগামী জুন মাসের মধ্যে ৩৫০ কোটি ডলার আসবে। এতে রিজার্ভ আরও বাড়বে। ফলে বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করার এটাই ভালো সময়।’

সব মিলিয়ে বাংলাদেশ বিনিময় হারের দিক থেকে বড় পরিবর্তনের দিকে গেল। যদিও ডলার পুরোপুরি বাজারভিত্তিক, তা বলা যাবে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের ভূমিকা থাকবে। আইএমএফের তথ্য বলছে, বিশ্বের ৩৬টি দেশ তাদের মুদ্রা পুরোপুরি ভাসমান (ফ্রি ফ্লোট) করে রেখেছে। বেশির ভাগ দেশই নিয়ন্ত্রিত ফ্লোটিং বা ক্রলিং পেগ নীতি অনুসরণ করে। আবার স্থির বিনিময় হার চালু আছে, এমন দেশও আছে।

বাংলাদেশ এক রকম নিয়ন্ত্রিত বিনিময় হার অনুসরণ করবে। ভবিষ্যতে অর্থনীতির গতি বাড়লে বা ডলারের চাহিদা বাড়লে বিনিময় হারের পরিণতি কী হবে, তা দেখার বিষয়। কিংবা চাহিদার তুলনায় সরবরাহে ঘাটতি দেখা দিলে বাংলাদেশ ব্যাংক কীভাবে বাজারের হস্তক্ষেপ করবে, তাও আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

বাংলাদেশ আপাতত ৫০ কোটি ডলারের একটি কারেন্সি ইন্টারভেনশন ফান্ড বা তহবিল গঠন করেছে। ভারত, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, থাইল্যান্ডসহ অনেক দেশেই এমন তহবিল আছে। এই তহবিলের অর্থের পরিমাণ আরও বাড়াতে যেমন হবে, তেমনি রিজার্ভের অর্থ নিয়ে বড় বড় প্রকল্পে অর্থসংস্থানের মতো তুঘলকি সিদ্ধান্ত নেওয়া থেকেও ভবিষ্যতে বিরত থাকতে হবে। তাহলেই দুশ্চিন্তা অনেক কমে যাবে।