এক হচ্ছে রাশিয়া–চীন–ভারত, কী প্রভাব পড়বে ভূ–অর্থনীতি ও রাজনীতিতে
সমরাস্ত্র দিয়ে যুদ্ধ করার চেয়ে বাণিজ্য দিয়ে যুদ্ধ করাই শ্রেয় মনে করছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। অর্থাৎ বাণিজ্যকে রীতিমতো যুদ্ধাস্ত্র বানিয়ে ফেলেছেন তিনি। কোনো দেশের উত্থান ঠেকাতে যেভাবে বাণিজ্যকে ব্যবহার করা হচ্ছে, তা যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমাদের নেতৃত্বে তৈরি হওয়া মুক্তবাণিজ্যব্যবস্থারই পরিপন্থী। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র আধিপত্য (ভ্রমাত্মক) ধরে রাখতে নিজেদের উদ্ভাবিত মুক্তবাণিজ্যব্যবস্থাই জলাঞ্জলি দিতে বসেছে।
শুল্ক ও বাণিজ্যনীতি এখন কেবল অর্থনৈতিক স্বার্থে নয়, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এখন তা ভূরাজনৈতিক চাপ সৃষ্টির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছেন। চীনের সঙ্গে দীর্ঘদিনের বাণিজ্যযুদ্ধ, রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা ও ভারতের ওপর শুল্কসংক্রান্ত চাপ—সব মিলিয়ে ওয়াশিংটন কার্যত বাণিজ্যকে কূটনৈতিক অস্ত্রে রূপ দিচ্ছে।
এই কৌশল বরং উল্টো প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছে। চীনের সঙ্গে রাশিয়ার অর্থনৈতিক সম্পর্ক ইউক্রেন যুদ্ধের পর অভূতপূর্ব উচ্চতায় উঠেছে। বলা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের কূটনীতির এটা বড় ব্যর্থতা। রাশিয়া পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে উঠতে তেল ও গ্যাস বিক্রিতে বেইজিংয়ের ওপর নির্ভরশীল হয়েছে। চীনও রাশিয়াকে সস্তা জ্বালানি, কাঁচামালের উৎস ও কৌশলগত মিত্র হিসেবে বিবেচনা করছে; যদিও সমাজতান্ত্রিক দেশ হওয়া সত্ত্বেও একসময় রাশিয়া ও চীনের সম্পর্ক ছিল খারাপ। উল্টো ১৯৭০-এর দশকে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে গোপনে কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
ভারতের অবস্থান খানিকটা ভিন্ন। নয়াদিল্লি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা বাড়ালেও রাশিয়ার কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ তেল আমদানি করছে এবং চীনের সঙ্গে ব্রিকসে সক্রিয় ভূমিকা রাখছে। সর্বশেষ ভারতের ওপর ট্রাম্প ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপের প্রতিক্রিয়ায় তিন দেশের (রাশিয়া-ভারত-চীন) মধ্যে একধরনের কৌশলগত সমঝোতা তৈরি হচ্ছে। এ ঘটনা সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য-চাপের প্রতিক্রিয়া হিসেবেই দেখা যেতে পারে। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রতিক্রিয়ায় রাশিয়া-চীনের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হয়েছে; বেড়েছে দুই দেশের মধ্যকার দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও সহযোগিতা। এখন ভারত ও চীনের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হওয়ার বাস্তবতা তৈরি হয়েছে। তার বাস্তবায়ন অনেকটা দেখা যাবে বলেও ধারণা করা হচ্ছে।
স্নায়ুযুদ্ধের অবসানের পর যেমন এককেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থা শুরু হয়েছিল, এর মধ্য দিয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে আসার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে।
স্নায়ুযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতিযোগিতা ছিল মূলত সামরিক ও পারমাণবিক সক্ষমতার দৌড়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ। কিন্তু ২০২০-এর দশকে অর্থনীতি ও প্রযুক্তি—এ দুই ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে প্রধান যুদ্ধক্ষেত্র। ট্রাম্প এই নতুন বাস্তবতাকে কাজে লাগিয়ে শুল্ক, নিষেধাজ্ঞা ও বাজারে প্রবেশাধিকারের মাধ্যমে প্রতিপক্ষকে চাপের মধ্যে রাখছেন।
কিন্তু রাশিয়া-চীন-ভারতত্রয়ী এখন বুঝতে পেরেছে, তাদের কারও পক্ষে একা কেউ এই চাপ সামাল দিতে পারবে না। ফলে তারা যৌথ প্রকল্প, মুদ্রা বিনিময় চুক্তি, অবকাঠামো বিনিয়োগ এবং প্রযুক্তি সহযোগিতায় মনোযোগ দিচ্ছে। এ প্রক্রিয়া আরও আগেই শুরু হয়েছে। এখন ট্রাম্প শুল্কচাপের নীতি বজায় রাখলে এ প্রক্রিয়া আরও ত্বরান্বিত হবে।
মুক্তবাণিজ্যের অবসান
আদর্শ মুক্তবাজারের গল্পে বাণিজ্য একধরনের সেতু, যে সেতু ভৌগোলিক দূরত্ব মুছে দেয়। সরবরাহ ও চাহিদার স্বাভাবিক খেলায় সীমান্ত পেরিয়ে পণ্য প্রবাহিত হয়। সেখানে দাম নির্ধারিত হয় প্রতিযোগিতা ও দক্ষতার নিয়মে। সরকার শুধু থাকে রেফারির মতো—খেলার নিয়ম সবার জন্য একই রকম রাখা তার কাজ; নিজের দলের হয়ে গোল দেওয়া নয়।
কিন্তু বাস্তবের আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে এ গল্প বদলে যায়। এখানে সেতুর বদলে বাণিজ্য কখনো হয়ে ওঠে প্রাচীর, কখনোবা অস্ত্র। শত্রুপক্ষের অর্থনীতিতে ধাক্কা দিতে শুল্কের হার বাড়িয়ে দেওয়া হয়, প্রযুক্তি রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা জারি হয়, যেন প্রতিদ্বন্দ্বী বড় হতে না পারে। আবার কোনো কোনো সময় কৌশলগত আনুগত্যের বিনিময়ে বাজার প্রবেশাধিকার দেওয়া হয় পুরস্কার হিসেবে।
যুক্তরাষ্ট্রের ট্রাম্পযুগের শুল্কনীতি, চীনের বিরল ধাতু রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ, কিংবা রাশিয়ার জ্বালানি সরবরাহকে কূটনৈতিক চাপ হিসেবে ব্যবহার—এসব থেকে বোঝা যায় মুক্তবাজারের মধ্যে বাস্তব রাজনীতির প্রভাব কতটা। অ্যাডাম স্মিথের স্বপ্নের সেই উক্তি, নিরপেক্ষ বাজার প্রায়ই ক্ষমতার খেলায় বাঁক নেয়, যেখানে বাণিজ্য আর কেবল অর্থনীতির ভাষায় কথা বলে না, বরং ভূরাজনীতির শর্তে চুক্তি সই করে।
ফলে মুক্তবাজারের নীতি আর বাণিজ্যের রাজনৈতিক অস্ত্রায়ণের দ্বন্দ্ব আজকের বৈশ্বিক অর্থনীতির সবচেয়ে বড় অঘোষিত নাটক, যেখানে দর্শকও ব্যবসায়ী, রাষ্ট্রও খেলোয়াড়।
অ্যাডাম স্মিথ ও ডেভিড রিকার্ডোর বাণিজ্যতত্ত্বে এমন রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ অদক্ষ, ব্যয়বহুল ও উভয় পক্ষের ক্ষতিকর হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বাস্তবতায় রাষ্ট্রগুলো মনে করে, রাজনৈতিক স্বার্থ সুরক্ষাই শেষ পর্যন্ত অর্থনৈতিক স্বার্থকে প্রভাবিত করে।
কেন যুক্তরাষ্ট্রের এই নীতি
সম্প্রতি ভারতের সঙ্গে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যে আচরণ করেছেন, সেই ঘটনা থেকে বাণিজ্যযুদ্ধের প্রকৃত কারণ সম্পর্কে আঁচ করা যায়। সেটা হলো উদীয়মান কোনো দেশকে আটকে দেওয়া। একসময় জাপানের বিরুদ্ধে একই অবস্থান নিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। মুদ্রা কারসাজি থেকে শুরু করে নানাভাবে জাপানের উত্থান তারা ঠেকিয়ে দিয়েছে। এরপর বিশ্বের শীর্ষ অর্থনীতি হিসেবে চীনের উত্থান ঠেকাতে তারা মরিয়া হয়ে ওঠে। এত দিন চীনকে ঠেকানোর কৌশলের অংশ হিসেবে ভারতের সঙ্গে খাতির রাখলেও শুল্ক ও ভূরাজনৈতিক বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র অত্যন্ত কদর্যভাবে ভারতের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, এই ভূ-অর্থনীতির প্রভাব ভূরাজনীতিতেও পড়বে।
চীন-ভারতের বিবাদ
চীন ও ভারতের মধ্যে আস্থার ঘাটতি আছে। কিন্তু এটাও মনে রাখতে হবে, ভারত ও চীনে ২৮০ কোটির ওপরে মানুষের বসবাস। যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের জনসংখ্যা ৩৩ কোটি। চীন ও ভারতের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হচ্ছে দ্রুত, প্রযুক্তিতেও তারা শীর্ষ পর্যায়ে; বিশ্বমানের বিজ্ঞানী, মহাকাশ কর্মসূচি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও ডিজিটাল অর্থনীতিতে অগ্রগতি—সব মিলিয়ে তাদের সম্পর্ক প্রকৃত অর্থে বহুমেরুকেন্দ্রিক ও বহুপক্ষীয় বিশ্বব্যবস্থা গড়তে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের টেকসই উন্নয়ন বিভাগের অধ্যাপক জেফরি স্যাক্স সম্প্রতি হিন্দুস্তান টাইমসের সঙ্গে এক পডকাস্টে বলেন, ‘চীনের প্রতি আমার পরামর্শ হলো, তারা যেন ভারতকে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের ষষ্ঠ স্থায়ী সদস্য হতে সমর্থন দেয়। বর্তমানে জাতিসংঘের এটাই সবচেয়ে বড় ঘাটতি। ভারত এখন বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশ এবং একধরনের পরাশক্তি; বৈশ্বিক শাসনব্যবস্থার বৈধতার জন্য নিরাপত্তা পরিষদে ভারতের থাকা প্রয়োজন। ভারতই একমাত্র দেশ, যাদের স্থায়ী সদস্য হওয়ার সুস্পষ্ট দাবি আছে। ভারতের অন্তর্ভুক্তি বহুপক্ষীয়তা ও বৈশ্বিক শান্তি—উভয়ই সুসংহত করবে।
তবে এ অবস্থানে পৌঁছাতে হলে দুই দেশের মধ্যে আস্থা পুনর্গঠন জরুরি বলেও মনে করেন জেফরি স্যাক্স। এ ক্ষেত্রে প্রধান বাধা সীমান্ত সমস্যা; বিশেষত হিমালয় অঞ্চলের সীমান্তরেখা নিয়ে বিরোধ। এই সীমান্ত আনুষ্ঠানিকভাবে নির্ধারিত হয়নি। ব্রিটিশ কর্মকর্তা ম্যাকমোহন—যিনি কখনো ওই এলাকায় যাননি—মানচিত্রে রেখা এঁকে দেন, যে রেখা নিয়ে আজও বিতর্ক আছে। স্বাধীনতার পর ভারত সেই ‘ম্যাকমোহন লাইন’কে সীমান্ত হিসেবে মেনে নেয়। আমার ব্যক্তিগত ধারণা, বিশ্বের অধিকাংশ সমস্যার শিকড় হলো ব্রিটেন-ভারত-চীন সীমান্ত বিরোধ, ক্রিমিয়ার সংকট, মধ্যপ্রাচ্যের অস্থিরতা—সবকিছুর পেছনে আছে ঔপনিবেশিক যুগের ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ।
এ প্রেক্ষাপটে ট্রাম্প-পুতিনের আসন্ন আলাস্কা বৈঠক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, শুধু কূটনৈতিক প্রতীকী অর্থে নয়, বাস্তব অর্থেও। ট্রাম্পের যে উচ্চ শুল্কনীতি, তা মূলত ব্রিকসভুক্ত দেশগুলোর (ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন, দক্ষিণ আফ্রিকা) বিরুদ্ধে—কেউ শুল্কের শিকার, কেউ সরাসরি নিষেধাজ্ঞার। এরা সবাই বড় দেশ। জেফরি স্যাক্স বলেন, যুক্তরাষ্ট্র বড় দেশ পছন্দ করে না। কেননা, তারা আমেরিকার তথাকথিত একক আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ জানায়। চীনের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের বিরূপ মনোভাবের মূল কারণ বিশ্বাসঘাতকতা নয়, বরং চীনের দ্রুত অর্থনৈতিক উত্থান—২০১০ সালের পর থেকে ওয়াশিংটনের চোখে তারা এক নম্বর হুমকি হয়ে। একইভাবে রাশিয়ার বিরুদ্ধেও এ মনোভাব কয়েক শ বছরের পুরোনো। কেননা, রাশিয়া আয়তনে অনেক বড়। সেই সঙ্গে ভূরাজনীতিতে তারা অনেক আগে থেকেই প্রভাবশালী।
ভূ-অর্থনীতি
ভূরাজনীতির পাশাপাশি আরেকটি শব্দ ইদানীং উচ্চারিত হয়, সেটা হলো ভূ-অর্থনীতি। বাণিজ্য ও বিনিয়োগের মতো অর্থনৈতিক হাতিয়ার ব্যবহার করে যেভাবে বৈশ্বিক ক্ষমতার রাজনীতি পরিচালিত হচ্ছে এবং যেভাবে তা বৈশ্বিক অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলছে, সেটাই ভূ-অর্থনীতি।
এ বাস্তবতায় ভারত, চীন ও রাশিয়ার একতা বিশ্ব অর্থনীতিতে নতুন অধ্যায়ের সূচনা করতে পারে। এই তিন দেশের বিশাল জনসংখ্যা, প্রাকৃতিক সম্পদ ও প্রযুক্তির সমন্বয় শক্তিশালী অভ্যন্তরীণ বাজার গড়ে তুলবে। মার্কিন ডলারের আধিপত্য থেকে মুক্ত হয়ে তারা নিজেদের আর্থিক ও বাণিজ্যব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারে। এর মধ্য দিয়ে তারা পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা এড়াতে পারবে। সরবরাহব্যবস্থা পুনর্গঠন ও অবকাঠামোগত বিনিয়োগে বিশ্ব অর্থনীতির ভারসাম্য বদলে যাবে। সীমান্ত বিরোধ ও আস্থার ঘাটতি আছে ঠিক, তা সত্ত্বেও এই একতা বহুপক্ষীয় বিশ্ব গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। স্নায়ুযুদ্ধের অবসানের পর যেমন এককেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থা শুরু হয়েছিল, এর মধ্য দিয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে আসার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে।
রাশিয়া-চীন-ভারতের ঘনিষ্ঠতা কেবল অর্থনৈতিক জোট নয়, এটি একধরনের ভূরাজনৈতিক বার্তা। পশ্চিমা চাপ যত বাড়বে, এই ত্রয়ীর সমন্বয় তত বাড়তে পারে। এটি বৈশ্বিক ক্ষমতার মেরুকরণকে স্নায়ুযুদ্ধ-উত্তর যুগের তুলনায় আরও জটিল করে তুলছে।