কয়েকটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছে

অর্থনীতির বর্তমান সংকটময় পরিস্থিতি ও উত্তরণের উপায় নিয়ে প্রথম আলো আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা বলেছেন, বড় ধরনের সংস্কার ছাড়া বর্তমান অর্থনীতির সংকট মোকাবিলা করা কঠিন হবে। নির্বাচনের আগে সরকারের পক্ষে বড় ধরনের সংস্কার সম্ভব নয়। তবে নির্বাচনের পর সংস্কারের কৌশল কী হবে, তা এখনই ঠিক করতে হবে। গতকাল মঙ্গলবার প্রথম আলো কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এ বৈঠকে ছিলেন চার অর্থনীতিবিদ, একজন সাবেক ব্যাংকার ও একজন ব্যবসায়ী।

শামস মাহমুদ

বেসরকারি খাতে আমরা একধরনের গোষ্ঠী শাসনতন্ত্রের প্রবণতা দেখছি। অর্থের জোগান, সহজে অর্থায়নের সুযোগসহ সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ করছে কয়েকটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। এটি খুবই দুর্ভাগ্যজনক। আবার শুধু রাজনৈতিক বিবেচনায় কোনো ব্যবসায়িক গ্রুপের ঋণ পুনঃ তফসিল করে দিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

অপ্রত্যাশিত ও আশ্চর্যজনক এ ঘটনা বেসরকারি খাতের জন্য খুবই অপমানজনক।

নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির জন্য সিন্ডিকেটকে দায়ী করা হয়। অথচ পণ্যবাহী ট্রাক ঢাকায় আসার পথে বিভিন্ন জায়গায় চাঁদা দিতে হয়। যে ছোট্ট জায়গায় বসে পণ্য বিক্রি করা হয়, তার জন্য চাঁদা দিতে হয়।

ডলার–সংকটের কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিত্যপ্রয়োজনীয় নয়, এমন পণ্য আমদানির ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে। এতে ব্যবসা-বাণিজ্যের স্বাভাবিক গতি ব্যাহত হয়। এক বা দুই বছরের মধ্যে এই বিধিনিষেধ তুলে দিতে হবে। কারণ, এটির সুদূরপ্রসারী প্রভাব রয়েছে। আমদানিতে নিয়ন্ত্রণ থাকলে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান শ্লথ হবে।

রপ্তানি ও দেশীয় শিল্পের জন্য জ্বালানি নিরাপত্তা গুরুত্বপূর্ণ। চলতি বছর হঠাৎ করেই গ্যাসের দাম ১৫০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়িয়ে দেওয়া হয়। অথচ দুই বছর ধরে আমরা বলে আসছি, জ্বালানি খাত নিয়ে ১০ বছরের রূপকল্প দিন। আমরা বলছি না, আপনি ভর্তুকি দেন। তবে গ্যাসের দাম কোন বছর কী পরিমাণ বাড়বে, সেটি আগে থেকে জানা থাকলে ব্যবসায়িক পরিকল্পনা করতে সুবিধা হয়।  

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) যেভাবে কর আদায়ের পরিকল্পনা করছে, তা বেসরকারি খাতের বিকাশে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। আমরা ব্যবসায়ীরা সরকারকে কর দিচ্ছি। সরকারের প্রকল্প ব্যয় প্রয়োজনের তুলনায় ২০০-৩০০ শতাংশ বেড়ে যাচ্ছে। টাকা ছাপিয়ে সরকারের ব্যয় মেটানোও হয়েছে। এই অতিরিক্ত তারল্য মূল্যস্ফীতিকে উসকে দিচ্ছে। অথচ কারণে-অকারণে ব্যবসায়ীদের দায়ী করা হচ্ছে।

সাম্প্রতিক সময়ে ডিমের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির জন্য সিন্ডিকেটকে দায়ী করা হচ্ছে। ডিম উৎপাদনে নিয়োজিত ফার্মগুলোকে নিয়ে কেউ কথা বলছে না। পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীদের ঘাড়ে দোষ চাপানো হচ্ছে। অথচ মূল সমস্যা সমাধান না করলে তো কোনো লাভ হবে না। ব্যবসায়ীদের মুরগির খাবার আমদানির জন্য ১২০ টাকায় প্রতি ডলার কিনে ঋণপত্র খুলতে হচ্ছে। ঋণপত্র খুলতেও ব্যাংকগুলো গড়িমসি করছে। এতে ব্যবসার খরচ বাড়ছে, যা পণ্যের দাম বাড়াচ্ছে।

নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির জন্য সিন্ডিকেটকে দায়ী করা হয়। অথচ পণ্যবাহী ট্রাক ঢাকায় আসার পথে বিভিন্ন জায়গায় চাঁদা দিতে হয়। যে ছোট্ট জায়গায় বসে পণ্য বিক্রি করা হয়, তার জন্য চাঁদা দিতে হয়। আট মাস আগেও মতিঝিলে গাড়ি পার্কিং করলে ২০ টাকা দিলে হতো। সেদিন গাড়ি পার্ক করতে গিয়ে ১২০ টাকা চাঁদা দিতে হয়েছে। কারণ জানতে চাইলে চাঁদা সংগ্রহকারী জানান, সবকিছুর দাম বাড়তি। তাই চাঁদার হারও বাড়ছে।

বর্তমানে দেশে যতগুলো সমস্যা রয়েছে, জনগণ হিসেবে সেগুলো নিয়ে প্রশ্ন করার অধিকার আমাদের রয়েছে। এসব বিষয়ে আমরা পরিষ্কার উত্তর আশা করি। বেসরকারি খাতকে আশ্বস্ত করার মতো তেমন কোনো জবাবদিহি আমরা দেখছি না। বর্তমানে নির্বাচনী প্রক্রিয়া নিয়ে সবাই কথা বলছেন। আমাদের জন্য আশঙ্কার কথা হচ্ছে, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিপর্যয়কর কিছু ঘটলে দেশ থেকে অর্থ পাচার বেড়ে যাবে। তখন তা বড় সমস্যা হয়ে দেখা দিতে পারে।

সরকারের নীতি সংস্কার নিয়ে আমরা যখনই কোনো কথা বলতে চাই তখন বলা হয়, দেশের প্রতি আমাদের কোনো অনুভূতি নেই। এটি খুবই অপ্রত্যাশিত। আমরা বাংলাদেশে ব্যবসা করি। বিদেশে আমাদের কোনো সহায়-সম্পত্তি নেই। আমরা চাই, আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এসব সমস্যার মধ্যে থাকবে না।