সাক্ষাৎকার

সেখ আকিজ উদ্দিনের অনুপ্রেরণায় আকিজ বশির গ্রুপের পথচলা শুরু

নবযাত্রা শুরু করেছে আকিজ বশির গ্রুপ। গ্রুপটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেখ বশির উদ্দিন। তিনি দেশের প্রথম প্রজন্মের উদ্যোক্তাদের অন্যতম সেখ আকিজ উদ্দিনের সন্তান। আকিজ বশির শিল্পগোষ্ঠীর ব্যবসা-বাণিজ্যের বিভিন্ন দিক নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন সেখ বশির উদ্দিন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জাহাঙ্গীর শাহ

সেখ বশির উদ্দিন
প্রথম আলো
প্রশ্ন:

প্রথম আলো: কেন আকিজ বশির গ্রুপ নামে প্রতিষ্ঠানের নবযাত্রা শুরু করলেন?

সেখ বশির উদ্দিন: ১৯৫০–এর দশকের দিকে দেশের অন্যতম বড় শিল্পগোষ্ঠী আকিজ গ্রুপের যাত্রা শুরু হয়। আমার বাবা সেখ আকিজ উদ্দিন এই শিল্পগোষ্ঠীর গোড়াপত্তন করেন। পাটের ব্যবসা দিয়েই এই শিল্পগোষ্ঠীর যাত্রা শুরু হয়। সত্তর বছরের বেশি সময় ধরে সুনামের সঙ্গে ব্যবসা করে আসছে গ্রুপটি। এ সময়ের মধ্যে নানা ধরনের পণ্য নিয়ে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে বিস্তৃতি ঘটেছে আকিজ গ্রুপের।

আমার বাবার একক নেতৃত্বে আকিজ গ্রুপ এগিয়ে গেছে। বাবা মারা যাওয়ার পর তাঁর সন্তানেরা নিজ নিজ যোগ্যতায় এত দিন ধরে ব্যবসা পরিচালনা করে আসছিলেন। প্রথম দিকে আমরা পাঁচ ভাই একসঙ্গে ব্যবসায় মনোনিবেশ করি। এখন ধীরে ধীরে আমাদের তৃতীয় প্রজন্মও ব্যবসায় যুক্ত হচ্ছে। তাই ব্যবসা পরিচালনার স্বার্থে আমাদের কিছু কিছু ব্যবসা একত্র করে ক্লাস্টার (গুচ্ছ ব্যবসা বা কয়েকটি প্রতিষ্ঠান একসঙ্গে) করি। নিজেদের মধ্যে শেয়ার হস্তান্তর করে একেকটি ক্লাস্টারের একক নেতৃত্ব নেন প্রত্যেক ভাই। আমি আকিজ বশির গ্রুপ নামে একটি ক্লাস্টারের নেতৃত্ব দিচ্ছি।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: আকিজ বশির গ্রুপ করার পেছনে অন্যতম অনুপ্রেরণা কী ছিল? এই গ্রুপের লক্ষ্য কী?

সেখ বশির উদ্দিন: আকিজ বশির গ্রুপ হলো আকিজ গ্রুপেরই উত্তরাধিকার। বলা যায়, আকিজ বশির গ্রুপ হলো আকিজ গ্রুপের নিশ্চয়তা (অ্যাস্যুরেন্স অব আকিজ গ্রুপ)। সেখ আকিজ উদ্দিন ভোক্তাদের প্রত্যাশা পূরণে যেভাবে ব্যবসা পরিচালনা করেছেন, আমরাও সেই প্রত্যাশা পূরণে ব্যবসা পরিচালনা করছি। সেখ আকিজ উদ্দিনের অনুপ্রেরণায় আকিজ বশির গ্রুপের পথচলা শুরু। নৈতিক অবস্থান, ব্যবসার কৌশলে তিনিই আমাদের মূল দর্শন।

আমাদের ব্যবসার বড় শক্তি হলো গ্রাহকের আস্থা। এটাই আমাদের বড় মূলধন। গ্রাহকের এই আস্থার প্রতি সম্মান রেখে আমরা ভবিষ্যতের পথে এগিয়ে যাব। গ্রাহকের জীবনমান উন্নয়নে আমাদের প্রচেষ্টাকে আরও গতিশীল করা হবে
সেখ বশির উদ্দিন, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, আকিজ বশির গ্রুপ

পঞ্চাশের দশক থেকে শুরু করে ২০০৬ সাল পর্যন্ত সেখ আকিজ উদ্দিনের একক নেতৃত্বে আকিজ গ্রুপ পরিচালিত হয়েছে। ১৯৭৭ সালে তিনি ব্রিটিশ মালিকানাধীন একটি চামড়ার কোম্পানি কিনে নেন। এভাবেই তিনি সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নানা সময়ে ব্যবসায় নানা পরিবর্তন এনেছেন। তাই এই পরিবর্তন আমাদের ডিএনএর মধ্যেই আছে। আমরা পরিবর্তনে বিশ্বাসী। পরিবর্তিত অর্থনৈতিক ও ব্যবসায়িক পরিস্থিতিতে আমরাও ক্রমপরিবর্তনশীল। পরিবর্তনকে আমরা আলিঙ্গন করি। ভবিষ্যতেও করব।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: আকিজ বশির গ্রুপের অধীনে কী কী ব্যবসা পরিচালিত হচ্ছে?

সেখ বশির উদ্দিন: আকিজ বশির গ্রুপের অধীনে বর্তমানে ১৬টি প্রতিষ্ঠান আছে। সিরামিকস, পার্টিকেল বোর্ডসহ কিছু ব্যবসা আকিজ গ্রুপ থেকে এসেছে। আবার চা, পাট, এমডিএফ বোর্ড—এসব ব্যবসা নতুন করে যুক্ত হয়েছে। ভবিষ্যতেও আমরা নতুন নতুন খাতে ব্যবসা সম্প্রসারণের চেষ্টা অব্যাহত রাখব।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: বর্তমানে আকিজ বশির গ্রুপে কত হাজার কর্মী কাজ করেন?

সেখ বশির উদ্দিন: আকিজ বশির গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ২৪ হাজারের বেশি কর্মী আছেন। তারাই এই শিল্পগোষ্ঠীর প্রাণ। সবচেয়ে বেশি ১২ হাজারের বেশি কর্মী আছে পাটের ব্যবসায়।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: টেকসই উন্নয়ন ও পরিবেশবান্ধব কার্যক্রমে আকিজ বশির গ্রুপ কী ধরনের অবদান রাখছে? এ বিষয়ে আপনাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?

সেখ বশির উদ্দিন: ব্যবসা বা শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার ক্ষেত্রে আমরা সব সময় টেকসই উন্নয়ন ও পরিবেশবান্ধব কার্যক্রমকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকি। পুরো পৃথিবী এই বিষয়টিতে জোরালো অবস্থান নিচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের উচ্চ ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। সরকার পরিবেশবান্ধব শিল্প খাত তৈরিতে যেসব মানদণ্ড ঠিক করে, আমরা সব সময় তার চেয়ে বেশি মান বজায় রাখি। আমরা এখন সাড়ে ৩ মেগাওয়াট নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদন করি। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের মধ্যে ৪০ মেগাওয়াট নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদনের লক্ষ্য আছে।

আমরা গবেষণা করে শিল্পে প্রযুক্তিগত পরিবর্তন আনি। যেসব ক্ষেত্রে সাফল্য পেয়েছি, তা আমরা সবার জন্য উন্মুক্ত করে দিই। এর কারণ, এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে অন্য উদ্যোক্তাদের পথচলা যেন সহজ হয়।

আরও পড়ুন
প্রথম আলো
প্রশ্ন:

প্রথম আলো: পণ্য উৎপাদন ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নে নতুন উদ্ভাবনে আপনারা কী ধরনের কাজ করছেন? এ বিষয়ে বিস্তারিত বলবেন কি?

সেখ বশির উদ্দিন: ৭০ বছরের বেশি সময় ধরে আমাদের পাটের ব্যবসা। আকিজ গ্রুপের একটি ক্লাস্টারের নেতৃত্ব নেওয়ার পর দুটি পাটের প্রতিষ্ঠান আমরা অধিগ্রহণ করি। পাটের পচানো প্রক্রিয়া নিয়ে আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত রসায়ন বিভাগের সঙ্গে কাজ করছি। এই গবেষণায় পাট পচানোর সময় আশ নষ্ট হওয়া কমানো, পচানোর সময় কমানো এবং পানির দূষণ কমানো—এসব ক্ষেত্রে সফলতা এসেছে। এই গবেষণা এখনো গবেষণাগার পর্যায়ে আছে। কারখানা বা শিল্প পর্যায়ে আসতে আরও দুই বছর সময় লাগবে। তখন কৃষকের খরচ কমবে, পাটকল মালিকদেরও খরচ কমবে।

সিরামিকস কারখানায় সবচেয়ে বেশি লাগে জ্বালানি ও পানি। বর্জ্য ব্যবস্থাপনাও জরুরি। আমাদের ময়মনসিংহের ভালুকায় অবস্থিত সিরামিক কারখানায় এক হাজার টন পানি লাগে। ভূগর্ভস্থ পানি দিয়েই পুরোটা জোগান দিতে হয়। তাই বৃষ্টির পানি ধরে রেখে সিরামিক কারখানায় পানির জোগান বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর আগে আমরা উপকূলীয় অঞ্চলে মিঠাপানির চাহিদা মেটাতে ৬০টি ইউনিয়নে ৭ লাখ টন বৃষ্টির পানি ধরে রেখে পানযোগ্য করে রাখার ব্যবস্থা করা করেছি। সেই অভিজ্ঞতা আমরা ময়মনসিংহের সিরামিকস কারখানায় কাজে লাগাব।

আরও পড়ুন
প্রশ্ন:

প্রথম আলো: আকিজ বশির গ্রুপের অধীনে নতুন কোন কোন খাতে বিনিয়োগের পরিকল্পনা রয়েছে আপনাদের?

সেখ বশির উদ্দিন: হবিগঞ্জ জেলায় আমরা আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবনে ব্যবহারের জন্য কাচ উৎপাদনের কারখানা বানাচ্ছি। আগামী বছর আধুনিক প্রযুক্তির এই কারখানা উৎপাদনে যাবে বলে আশা করছি। এই কারখানার কাচ উৎপাদনের সক্ষমতা দৈনিক ৬৫০ টন। এই কারখানায় এক হাজার লোকের কর্মসংস্থান হবে। নতুন এ কারখানায় এক হাজার কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ করছি আমরা।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: আকিজ বশির গ্রুপের নবযাত্রা উপলক্ষে ভোক্তাদের উদ্দেশে আপনি কী বলবেন?

সেখ বশির উদ্দিন: আমাদের ব্যবসার বড় শক্তি হলো গ্রাহকের আস্থা। এটাই আমাদের বড় মূলধন। গ্রাহকের এ আস্থার প্রতি সম্মান রেখে আমরা ভবিষ্যতের পথে এগিয়ে যাব। গ্রাহকের জীবনমান উন্নয়নে আমাদের প্রচেষ্টাকে আরও গতিশীল করা হবে।

প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।

সেখ বশির উদ্দিন: আপনাকেও ধন্যবাদ।

আরও পড়ুন