বাংলাদেশ ইনস্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিআইএ) নন-লাইফ শ্রেণির অধিকাংশ সদস্য ব্যক্তি এজেন্টদের লাইসেন্স স্থগিত করার জন্য বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) কাছে আবেদন করেছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে কর্তৃপক্ষ নিজস্ব ক্ষমতাবলে ওই লাইসেন্সগুলো স্থগিত করেছে। ফলে এখন বিমা প্রতিষ্ঠানগুলো কোনোভাবেই এজেন্ট কমিশন দিতে পারবে না।
বিমা আইনের ১২৪ (৪) ধারায় বলা হয়েছে, ‘কর্তৃপক্ষ এ–সংক্রান্ত প্রবিধান প্রণয়নের মাধ্যমে বিমা এজেন্ট নিয়োগের যোগ্যতা এবং অন্যান্য শর্তাবলি, বিমা এজেন্টের নিবন্ধনের মেয়াদকাল, নবায়ন ফি ও অনুরূপ ফি পরিশোধের পদ্ধতি নির্ধারণ করতে পারবে।’ এ ধারা অনুযায়ী আইডিআরএ বিমা এজেন্ট নিবন্ধনের মেয়াদকাল নির্ধারণের পাশাপাশি এজেন্টদের লাইসেন্স স্থগিত করার ক্ষমতাও রাখে।
স্বীকার করতেই হবে, বিমা কমিশনের লাগাম বহুদিন ধরেই সীমাহীন হয়ে পড়েছিল। দীর্ঘ সময় ধরে এ বিষয়ে অসুস্থ প্রতিযোগিতা চলে আসছে। প্রায় সব বিমাকারীরই ধারণা, বিমা ব্যবসায়ের টেকসই উন্নয়নের পথে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে এই কমিশনব্যবস্থা।
বিমা খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে বিআইএ কয়েক ধাপে বিমা কোম্পানির চেয়ারম্যান ও মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তাদের (সিইও) নিয়ে বৈঠক করে। এসব বৈঠকে অধিকাংশই একমত হন যে নন-লাইফ বিমা বাজারে স্বচ্ছতা আনা, অনিয়ম কমানো এবং শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এজেন্ট কমিশন বাতিল করা অপরিহার্য। সিইওরা এজেন্ট কমিশন ছাড়াই ব্যবসা পরিচালনার আশ্বাস দেন।
বৈঠকগুলোতে আরও মত উঠে আসে যে কমিশন পুরোপুরি বন্ধ হলে বিমা কোম্পানির অনিয়ম অনেকাংশে কমে যাবে। এতে কোম্পানিগুলো শেয়ারহোল্ডারদের বেশি লভ্যাংশ দিতে পারবে এবং এই খাত থেকে সরকারের রাজস্ব আহরণও বাড়বে।
কিন্তু বাস্তবতা হলো, বিমা কমিশনের হার ১৫ শতাংশ নির্ধারিত থাকলেও বাস্তবে অনেক ক্ষেত্রে তার চেয়েও বেশি কমিশন দেওয়া হয়েছে। অনেক সময় ঝুঁকি যথাযথভাবে যাচাই না করেই পলিসি ইস্যু করা হয়। এর ফলে কোম্পানির আন্ডাররাইটিং শৃঙ্খলা দুর্বল হয়ে পড়ে, ক্ষতির হার বাড়তে থাকে এবং টেকসই সক্ষমতা কমে যায়। উচ্চ কমিশনের লক্ষ্য পূরণ করতে গিয়ে কিছু কোম্পানি প্রিমিয়াম কমিয়ে অসম প্রতিযোগিতায় জড়িয়ে পড়ে।
ঝুঁকি উপযুক্ত কি না তা বিবেচনা না করেই কমিশননির্ভর পলিসি বিক্রির ফলে গ্রাহকদের অনেক সময় ভুল কাভারেজ দেওয়া হয়। এতে গ্রাহকেরা পরবর্তী সময়ে বিমা দাবি আদায়ে ব্যর্থ হন। অতিরিক্ত কমিশনের কারণে পলিসির শর্ত যথাযথভাবে গ্রাহককে ব্যাখ্যা করা হয় না, এমনকি কিছু বিষয় গোপনও রাখা হয়। এতে বিমাদাবি প্রত্যাখ্যানের সুযোগ সৃষ্টি হয়।
বিমাদাবি পরিশোধে অনাগ্রহ দেখিয়ে কিছু বিমা কোম্পানি অতিরিক্ত কমিশন দিয়ে আসছে—এমন অভিযোগও রয়েছে। এতে একদিকে গ্রাহক সুরক্ষা ব্যাহত হচ্ছে, অন্যদিকে কোম্পানির সুনাম ক্ষুণ্ন হচ্ছে। এজেন্ট কমিশনের দৌরাত্ম্যের কারণে দেশে পেশাদার এজেন্ট বা ব্রোকারেজ সংস্কৃতিও গড়ে উঠছে না।
কমিশনের নামে বিভিন্ন অঘোষিত সুবিধা তৈরির লক্ষ্যে কিছু বিমা কোম্পানি এমন পদক্ষেপ গ্রহণ করছে, যা বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) নীতিমালার পরিপন্থী। এর ফলে কোম্পানিগুলো নিজেরাই ঝুঁকির মুখে পড়ছে। কারণ, অতিরিক্ত কমিশন দেওয়ার কারণে কোম্পানির নিট প্রিমিয়াম আয় কমে যাচ্ছে।
আইডিআরএর প্রজ্ঞাপন পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়িত হলে প্রথম দিন থেকেই গ্রাহক সুরক্ষা বাড়বে এবং প্রতিটি বিমা কোম্পানি স্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গে ব্যবসা পরিচালনা করতে সক্ষম হবে। তাই এজেন্ট কমিশন শূন্য করার এই উদ্যোগকে আমরা সাধুবাদ জানাই।
দিলশাদ আহমেদ, স্বতন্ত্র পরিচালক, পিপলস ইনস্যুরেন্স