কেন খাদ্য মূল্যস্ফীতির সরকারি হিসাব বাস্তব মনে হয় না
চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো বা বিবিএসের তথ্যে খাদ্য মূল্যস্ফীতি সামান্য বৃদ্ধি দেখানো হয়েছে। তবে সরকারি এই পরিসংখ্যান বাস্তবতার সঙ্গে খাপ খায় না। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে ঢাকার যেকোনো হাটবাজারে গেলেই বোঝা যায়, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মধ্যে চাল, আটা, ডাল, ভোজ্যতেল, মাংস ও মাছের মূল্যবৃদ্ধির হার সরকারি হিসাবের চেয়ে অনেক বেশি। অথচ বিবিএসের পরিসংখ্যান বলছে, খাদ্য মূল্যস্ফীতি সেপ্টেম্বরে এসে আগের মাসের চেয়ে শূন্য দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ বেড়েছে।
সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের ট্রেডিং করপোরেশনের (টিসিবি) সেপ্টেম্বর মাসের দৈনিক খুচরা মূল্যতালিকায়ও সম্পূর্ণ ভিন্ন চিত্র দেখা যায়। টিসিবির হিসাবেও প্রায় সব মৌলিক খাদ্যপণ্যের দাম গত বছরের সেপ্টেম্বরের তুলনায় গত সেপ্টেম্বরে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেশি ছিল। এই পরিপ্রেক্ষিতে ৭ দশমিক ৬৪ শতাংশ খাদ্য মূল্যস্ফীতির সরকারি পরিসংখ্যানকে বাস্তবতার চেয়ে অনেকটাই কম বলে মনে হয়। তাতে একটি মৌলিক প্রশ্ন সামনে চলে আসে, পরিসংখ্যান সংস্থাটি কি এখনো এমন নমুনা পদ্ধতি, বাজার কাভারেজ ও গুরুত্ব নির্ধারণের ধারা অনুসরণ করছে, যা সাধারণ ভোক্তার বাস্তব অভিজ্ঞতাকে সঠিকভাবে প্রতিফলিত করছে না?
খাদ্য মূল্যস্ফীতির পাশাপাশি খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের মূল্যস্ফীতির হিসাবের ক্ষেত্রে বিশ্বাসযোগ্যতার ঘাটতি আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের মূল্যস্ফীতি হলো সামগ্রিক মূল্যবৃদ্ধির প্রধান চালিকা শক্তি। কিন্তু এই পণ্যের দাম কীভাবে সংগ্রহ করা হয়, কত ঘন ঘন তা পর্যবেক্ষণ করা হয় এবং কোন গুরুত্বে তা হিসাব করা হয়, এসব প্রক্রিয়া এখনো অস্বচ্ছ। অন্যভাবে বললে, আমরা ঠিক জানি না কোন খাদ্যবহির্ভূত পণ্য ও পরিষেবার মূল্য কীভাবে নির্ধারণ করা হচ্ছে, কতবার সেগুলো পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে এবং সরকারি বাস্কেট শহর ও গ্রামীণ পরিবারের প্রকৃত ভোগের ধরন প্রতিফলিত করে কি না। এই স্পষ্টতা ছাড়া খাদ্যবহির্ভূত মুদ্রাস্ফীতির যেকোনো গতিবিধি ব্যাখ্যা করা কঠিন হয়ে পড়ে। উদাহরণস্বরূপ, খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতির এই বৃদ্ধির কতটা অংশ বাড়িভাড়া, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা বা পরিবহন খরচ থেকে আসছে? আর কতটা প্রশাসনিকভাবে নির্ধারিত দামের প্রভাবে, বাজারের প্রকৃত গতিশীলতার কারণে নয়?
সংক্ষেপে বলা যায়, ৮ শতাংশের ওপর মূল্যস্ফীতি যে বাস্তব, তা স্পষ্ট। বরং বাস্তবতা হয়তো আরও বেশি উচ্চ হারের ইঙ্গিত দেয়। কিন্তু এই মূল্যস্ফীতির ভেতরের কাঠামো ও উপাদানগুলো পরিসংখ্যানগত সীমাবদ্ধতার কারণে অস্পষ্ট থেকে গেছে। যখন বাস্তব বাজারে খাদ্যপণ্যের দাম অনেক বেশি বাড়তে দেখা যায়, অথচ সরকারি পরিসংখ্যানে তার সামান্য পরিবর্তন দেখায়, তখন পরিসংখ্যানগত তথ্যের প্রতি মানুষের আস্থা দুর্বল করে দেয়। এই দৃষ্টিকোণ থেকে, এখন প্রয়োজন আরও বেশি স্বচ্ছতা, মূল্য সংগ্রহের পদ্ধতি, সূচকের গুরুত্ব নির্ধারণের প্রক্রিয়া এবং অঞ্চলভেদে পার্থক্যগুলো কীভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে, এসব বিষয়ে স্পষ্ট ব্যাখ্যা দেওয়া। তবেই মূল্যস্ফীতির হিসাব একটি আমলাতান্ত্রিক কর্মকাণ্ডে সীমাবদ্ধ না থেকে মানুষের প্রকৃত জীবনযাত্রার ব্যয়ের সঠিক প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠবে।
আরও একটি বিষয় গভীরভাবে বিবেচনা করা প্রয়োজন, তা হলো মূল্যস্ফীতি নির্ধারণে ব্যবহৃত পণ্যের ঝুড়ির গঠন। বর্তমানে খাদ্য মূল্যস্ফীতি নিরূপণ করা হয় একটি দীর্ঘ পণ্যের তালিকার ভিত্তিতে; যার অনেকগুলোই মানুষ খুব কম কেনে বা গড় পরিবারের ব্যয়ে যাদের গুরুত্ব অত্যন্ত সীমিত। অন্যভাবে বললে, চাল, আটা, ডাল, ভোজ্যতেল, সবজি, মাছ ও মাংসের মতো মৌলিক খাদ্যপণ্যের দাম যখন আকাশছোঁয়া, অথচ এই পণ্যগুলোকে তুলনামূলকভাবে কম ব্যবহৃত পণ্যের সঙ্গে গড়ে মিশিয়ে হিসাব করা হয়, তখন সামগ্রিক সূচকটি কৃত্রিমভাবে নিচে নেমে আসে। এই দৃষ্টিকোণ থেকে, খাদ্য মূল্যস্ফীতির হিসাব কেবল সেই মৌলিক ও নিয়মিত ভোগ্যপণ্যগুলোর দামের ওপর কেন্দ্রীভূত হওয়াই যুক্তিযুক্ত, যেগুলো আসলেই পরিবারের জীবনযাত্রার মান নির্ধারণ করে। কারণ, মূল্যস্ফীতি কেবল একটি পরিসংখ্যানগত সূচক নয়, এটি সেই প্রতিদিনের সংগ্রামের প্রতিচ্ছবি, যেখানে মানুষ ন্যূনতম খাদ্য নিশ্চিত করার চেষ্টা করে। সুতরাং সীমিত কিন্তু মৌলিক পণ্যের ওপর ভিত্তি করে একটি ‘প্রয়োজনভিত্তিক খাদ্য মূল্যস্ফীতি সূচক’ বাস্তব ভোক্তাদের ওপর চাপের আরও সঠিক ও নীতিনির্ধারণে সহায়ক প্রতিচিত্র উপস্থাপন করতে পারে।