খেলাপির ক্যানসার এখন আর প্যারাসিটামলে সারবে না
২০০৯ থেকে ২০২৩। আওয়ামী লীগের ১৪ বছরের শাসনামলে দেশে খেলাপি ঋণ বেড়েছে সাত গুণ। ২০০৯ সালে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ছিল মাত্র ২২ হাজার ৪৮১ কোটি ৪১ লাখ টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ হিসাবে গত জুন শেষে তা বেড়ে হয়েছে ১ লাখ ৫৬ হাজার ৩৯ কোটি টাকা। নানা সুবিধা দেওয়ার পরও কেন খেলাপি ঋণ এভাবে বাড়ছে, তা নিয়ে কথা বলেছেন বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন। অনুলিখন করেছেন সুজয় মহাজন।
খেলাপি ঋণ কমাতে বছরের পর বছর ঋণগ্রহীতা ও ঋণদাতাদের জন্য আমরা যে উদারতা দেখিয়েছি, তারই যোগফল খেলাপি ঋণের ধারাবাহিক বৃদ্ধি। যখন কাউকে কোনো সুবিধা দেওয়া হয়, তখন তিনিই ওই সুযোগ নেবেন—এটাই স্বাভাবিক। এ জন্য যিনি সুযোগ নিচ্ছেন, তাঁর চেয়ে যাঁরা সুযোগ দিচ্ছেন, তাঁরাই বেশি দায়ী। উদারতার সুযোগ দিয়ে আমরা বছরের পর বছর খেলাপি ঋণ কমানোর চেষ্টা করে গেছি। কিন্তু সেটি কাজ করেনি। উল্টো ফল দিয়েছে। সুযোগ নেওয়ার পর সুযোগসন্ধানীরা আরও বেশি সুযোগ নিতে ঋণের অপব্যবহার করেছেন। ফলে খেলাপি ঋণের বিষয়টি অর্থনীতির জন্য ক্যানসারে রূপ নিয়েছে। ক্যানসার এমন একটা রোগ, যা প্যারাসিটামল দিয়ে সারানো সম্ভব নয়। তাই এখন সময় এসেছে সর্বোচ্চ কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে খেলাপি ঋণ নামক অর্থনীতির এ ক্যানসার থেকে মুক্তির পথ খোঁজার।
এ কাজ আরও অনেক আগেই করা দরকার ছিল। এরই মধ্যে অনেক দেরি করে ফেলেছি আমরা। তারপরও খেলাপি ঋণের বাড়বাড়ন্ত এ ক্ষত থেকে রক্ষা পেতে হলে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের দিকে যেতে হবে। ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষেত্রে আবার আইনি সীমাবদ্ধতা, আইন প্রয়োগ ও প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতাও রয়েছে। এসব দুর্বলতা যত দ্রুত সম্ভব দূর করতে হবে। প্রথমত, আইন করে আমরা ঋণখেলাপিদের অনেক সুযোগ দিয়েছি। এসব সুযোগ এখনই বন্ধ করতে হবে। আবার খেলাপি ঋণ আদায়ে আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে যেসব দুর্বলতা রয়েছে, সেগুলো দূর করা জরুরি। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, ঋণ আদায়ে মামলা করলেও বছরের পর বছর তা নিষ্পত্তি হয় না। তাতে ঋণখেলাপিরাই উপকৃত হন। এ কারণে ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে মামলার দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বাড়াতে হবে।
বর্তমানে খেলাপিদের কেন্দ্র করে নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান, আইনের সঙ্গে যুক্ত লোকজনের একধরনের যোগসাজশের বলয় গড়ে উঠেছে। এ বলয়ের সঙ্গে যাঁরা যুক্ত, তাঁরা সবাই লাভবান হন খেলাপি ঋণ বাড়লে। এ অবস্থার সুরাহা করা দরকার।
আমরা দেখলাম, ন্যূনতম অর্থ দিয়ে খেলাপি ঋণ পুনঃ তফসিলের বারবার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। সেই সুযোগ একই প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি বারবার নিয়েছে। ফলে খেলাপি ঋণ কমার বদলে উল্টো বাড়ছে। একসময় এ দেশে আইন ছিল, কোনো ঋণ খেলাপি হলে তার বিপরীতে ঋণদাতা ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে ওই ঋণের বিপরীতে শতভাগ নিরাপত্তা সঞ্চিতি বা প্রভিশনিং রাখতে হতো। এতে ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর মুনাফায় টান পড়ত। কিন্তু আমরা দেখলাম, সেখানেও বারবার ছাড় দেওয়া হয়েছে।
প্রভিশনিং কম করার সুযোগ পেয়ে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের মুনাফা বাড়িয়ে দেখাচ্ছে। সেই মুনাফা থেকে আবার মালিকেরা ভালো অঙ্কের লভ্যাংশও নিচ্ছেন। এ কারণে ব্যাংকের মালিকদের মধ্যেও একধরনের যোগসূত্র গড়ে উঠেছে। এক ব্যাংকের মালিক অন্য ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছেন। তার একটি বড় অংশ খেলাপি হলেও হয়তো আইনি ছাড়ের কারণে তা খেলাপি হিসেবে নথিভুক্ত হচ্ছে না।
আমরা দেখছি, একদিকে ব্যাংকঋণ বাড়ছে, তার সঙ্গে বাড়ছে খেলাপির পরিমাণও। তার মানে অনেকেই ঋণ নিচ্ছে ফেরত না দেওয়ার জন্যই। তাহলে আমরা এ সংস্কৃতি লালন করছি কেন? অনেকেই হয়তো বলে থাকবেন, অর্থনীতির অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক সংকট, মূল্যস্ফীতির সমস্যা, উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি ইত্যাদি যৌক্তিক কারণে অনিচ্ছাকৃতভাবে ঋণখেলাপি হয়ে পড়ছেন। যদি সেটিকে সত্য হিসেব মেনে নিই, তাহলে অর্থনীতির সঙ্গে তো এ হিসাব মিলছে না। একদিকে আমরা ৬ শতাংশের বেশি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কথা বলছি, অন্যদিকে ব্যবসা খারাপ—এটি কীভাবে সম্ভব? অর্থনীতি ভালো চললে তো ব্যবসা-বাণিজ্যও ভালো চলার কথা। তাতে খেলাপি ঋণও কমে আসার কথা। কিন্তু ঘটছে উল্টোটি। আর এমনটি হচ্ছে মূলত ঋণখেলাপিদের দেওয়া উদার সুবিধার কারণে।
সবশেষে আমি মনে করি, খেলাপি ঋণের মতো অর্থনীতির ভয়াবহ ক্যানসারকে এখন আর সাধারণ ওষুধ বা চিকিৎসায় সারানো যাবে না। এখন দরকার হবে সার্জারির মতো কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ। সেটি যত তাড়াতাড়ি করা হবে, অর্থনীতির জন্য ততই মঙ্গল।