শুধু বাণিজ্য-ঘাটতি নয়, বাণিজ্য বাধায় জোর দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র

মহিউদ্দিন রুবেল, সাবেক পরিচালক, বিজিএমইএ

মার্কিন শুল্কারোপ প্রথমে বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো লাগলেও একটু খেয়াল করলে দেখতে পারব যে তারা বৈদেশিক বাণিজ্যিক বাধা (সরকারি কেনাকাটা, শুল্ক, মেধাস্বত্ব আইন, ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষা বিধান, ইন্টারনেট-সেবা, সাইবার নিরাপত্তা, বিনিয়োগ বাধা, শ্রম সমস্যা, দুর্নীতি ও ঘুষ) উল্লেখ করে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল, যা ছিল প্রথম ধাপ।

তারপর শুল্ক ঘোষণার পর বোঝা গেল, তারা যুক্তরাষ্ট্র শুধু দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক ঘাটতি নয়; বরং বাণিজ্যিক বাধাগুলোর প্রতিও জোর দিচ্ছে। কিছুটা আমদানির মাধ্যমে এ ঘাটতি হয়তো কমানো যাবে। যদি এই বাণিজ্যিক বাধাগুলো নিয়ে কাজ করা না হয়, তবে তা শুধু এখন নয়; ভবিষ্যতে অন্য দেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করবে। যা আরও প্রকট হয়ে দেখা মিলবে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা (এলডিসি) থেকে উত্তরণ-পরবর্তী সময়ে।

যদি শেষ পর্যন্ত এই ৩৫ শতাংশ অতিরিক্ত শুল্ক থেকেই যায়, তবে তা আগের খাতভিত্তিক শুল্কের সঙ্গে আলাদাভাবে যোগ হয়ে ন্যূনতম ৫১ শতাংশ হবে, যা ক্ষেত্রবিশেষে আরও অনেক বেশি হতে পারে। এই হার ধরলে যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশ থেকে গত বছরে ৭ দশমিক ৩৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের পোশাক আমদানিতে ন্যূনতম অতিরিক্ত ২ দশমিক ৫৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ন্যূনতম প্রদান করতে হতো। সুতরাং বাড়তি শুল্কের প্রভাব কতটা তীব্র হতে পারে তা অনুমান করা যায়।

ট্রাম্পের বর্ধিত শুল্কের প্রভাব সরবরাহশৃঙ্খলের বাংলাদেশসহ সব অংশীদারের ওপর পড়বে। ক্রেতা প্রাথমিকভাবে চাইবেন শুল্কের বোঝা বিক্রেতার থেকে নিতে। সেটা যদি আশানুরূপ না হয়, তবে কিছু ক্রয়াদেশ বাংলাদেশের তুলনায় কম খরচে উৎসে স্থানান্তরিত হতে পারে। আমরা জানি, প্রতিযোগী দেশ চীন, ভিয়েতনাম ও ভারত। তাদের সঙ্গে কীভাবে এবং কতটুকু এ প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ টিকে থাকতে পারে, তা একটু বিশ্লেষণ করে দেখা যাক। চীনের শুল্ক আমাদের থেকে বেশি এবং অন্য সব ক্ষেত্রেই তাদের খরচ আমাদের থেকে দিনে দিনে বেড়ে চলেছে। এ জন্য তারা বৃহৎ শিল্পের দিকে বেশি ঝুঁকছে এবং তুলনামূলকভাবে সস্তা হওয়ার কারণে কটন পণ্যের ক্ষেত্রে আগ্রহ কমে যাচ্ছে।

ভারতের গত বছরে রপ্তানির পরিমাণ মাত্র ১৬ দশমিক ৩৪ বিলিয়ন ডলার। সুতরাং রাতারাতি শুধু যুক্তরাষ্ট্রের জন্য তারা তাদের ক্ষমতা বাড়িয়ে ফেলতে পারবে না। বর্তমানে ভিয়েতনামের সক্ষমতার প্রায় সর্বোচ্চ ব্যবহার হচ্ছে। তাদের মোট তৈরি পোশাক রপ্তানি এখন ৩৩ দশমিক ৯৪ বিলিয়ন ডলার করছে। যেখানে তারা দামি পোশাক এবং সিনথেটিক পণ্য বেশি করে থাকে, যা আমরা কম করে থাকি। তাদের শ্রমমূল্য বৃদ্ধির কারণে তারা দামি ও ভারী শিল্পের দিকেও বেশি মনোযোগী হবে বেশি। ভারত ও ভিয়েতনাম—দুই দেশ থেকেই আমাদের সংযোগ শিল্প (ওভেন ফেব্রিকস ছাড়া) অনেক শক্তিশালী।

২০১৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র ৮৫ দশমিক ১৬ বিলিয়ন ডলার মূল্যের পোশাক আমদানি করেছিল, যা ২০২০ সালে কোভিড সময়ে ৬৪ দশমিক শূন্য ৬ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে। ২০২৪ সালের মধ্যে তা ৭৯ দশমিক ২৬ বিলিয়ন ডলারে ফিরে আসে। ১০ বছরের ব্যবধানে প্রবৃদ্ধি নেতিবাচক।

বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্র ২০২৪ সালে বাংলাদেশ থেকে ৭ দশমিক ৩৪ বিলিয়ন ডলার মূল্যের পোশাক আমদানি করেছে। যেখানে ২০২০ সালে ৫ দশমিক ২৩ বিলিয়ন ডলার মূল্যের পোশাক আমদানি করা হয়েছিল, যা ২০১৫ সালে ৫ দশমিক ৪০ বিলিয়ন ডলার ছিল। এ সময়ে প্রায় ৩৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ছিল। এ তথ্য মার্কিন বাজারে অস্থিতিশীল থাকা অবস্থায় বাংলাদেশের শক্তিশালী অবস্থান ইঙ্গিত করে। বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের তার রপ্তানির প্রায় ১৯ শতাংশ করে থাকে। যা একক দেশে হিসেবে সর্বোচ্চ, একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র আমদানি করে থাকে বাংলাদেশ থেকে ৯ শতাংশের মতো। উভয় দেশের জন্য তৈরি পোশাক খাত গুরুত্বপূর্ণ।

বাড়তি শুল্কের প্রভাব যুক্তরাষ্ট্রের গোটা অর্থনীতিতে হবে। উচ্চ ট্যারিফের কারণে বাংলাদেশসহ অন্য প্রতিযোগী দেশের পণ্য কম অথবা বেশি দামি হয়ে উঠবে। সুতরাং ভোক্তারা উচ্চ ব্যয়ের কারণে ক্রয় কমাতে পারে, যার প্রভাব বিক্রেতার ওপরেও পড়বে।
বাংলাদেশের মতো একটি শক্তিশালী ভিত্তি থেকে সরে আসতে চেষ্টা করলে নানা রকম চ্যালেঞ্জ তৈরি হবে, যা স্বাভাবিক এবং সময়সাপেক্ষ। তবে কালের বিবর্তনে যে কোনো শিল্পই উচ্চ ব্যয় ও আনুষাঙ্গিক কারণে এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে চল যেতে পারে।

যদি শেষমেশ শুল্ক এটাই রয়ে যায়, তাহলে কী হবে? বাহ্যিক কারণগুলো যেহেতু আমাদের আয়ত্তে নেই। তবে যেসব অভ্যন্তরীণ উপাদানের ওপর আয়ত্ত আছে, সেসব ক্ষেত্রে মনোনিবেশ করতে হবে। এতে এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাগুলোর সময়ে এবং তীব্র বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় আমরা নিজেদের প্রতিযোগিতামূলক করে রাখতে পারি। সরকার সামগ্রিক অবকাঠামো উন্নয়ন, ব্যবসা বিনিয়োগ-সহায়ক পরিবেশ ও সেবা সৃষ্টি করবে, এটাই প্রত্যাশা।

লেখক: মহিউদ্দিন রুবেল, সাবেক পরিচালক, বিজিএমইএ