সাক্ষাৎকার

পুঁজি পাচার এখন দেশের প্রধান সমস্যা

অর্থনীতির বিদ্যমান চ্যালেঞ্জ, নির্বাচন–পরবর্তী সময়ে অর্থনীতি নিয়ে শঙ্কা ও করণীয়, অর্থনীতিতে নির্বাচনের প্রভাব এবং গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা এসব সম্পর্কে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও অর্থনীতিবিদ মইনুল ইসলাম। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সুজয় মহাজন

প্রথম আলো:

আপনার দৃষ্টিতে বর্তমানে অর্থনীতিতে বড় চ্যালেঞ্জ কী?

মইনুল ইসলাম: বর্তমান পরিস্থিতিতে অর্থনীতিতে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ঊর্ধ্বমুখী মূল্যস্ফীতি। ডলারের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির ফলে সব ধরনের আমদানি খরচ বেড়ে গেছে। তাতে বেড়েছে পণ্য আমদানির খরচ। এর ফলে বাজারে পণ্যের দাম অনেক বেড়ে গেছে। যদিও ডলারের কারণে যেটুকু খরচ বেড়েছে, তার সঙ্গে পণ্য মূল্যবৃদ্ধি সংগতিপূর্ণ কি না, সেটি নিয়ে প্রশ্ন আছে। বছরজুড়ে উচ্চ মূল্যস্ফীতি থাকলেও তা নিয়ন্ত্রণে সরকারের সদিচ্ছা ছিল কি না, সেটিও একটি বড় প্রশ্ন। কারণ, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে যেসব কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া দরকার ছিল সরকারের পক্ষ থেকে সেই ধরনের ব্যবস্থা খুব বেশি নিতে দেখিনি আমরা। আমি মনে করি, টাকার অবচয়ন বা অবমূল্যায়ন রোধ করা সম্ভব না হলে, মূল্যস্ফীতিও নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না।

প্রথম আলো:

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কী করা দরকার বলে আপনি মনে করেন?

মইনুল ইসলাম: এ ক্ষেত্রে সবার আগে ডলারের দাম স্থিতিশীল করতে হবে, বন্ধ করতে হবে টাকার অবমূল্যায়ন। সেটি করতে প্রবাসী ও রপ্তানি আয় বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু আমরা রপ্তানিতে খুব বেশি সুখবর দেখছি না। ব্যাংকের চেয়ে এখন হুন্ডিতে বেশি প্রবাসী আয় আসছে। হুন্ডিতে প্রবাসী আয় বেড়ে যাওয়ার মানে হচ্ছে, এসব ডলার দেশে আসছে না, বিদেশেই থেকে যাচ্ছে। কারণ, অর্থ পাচার বেড়ে যাওয়ায় বিদেশে ডলারের চাহিদা বেড়েছে। ফলে বিদেশের ডলার বিদেশেই থেকে যাচ্ছে। দেশে প্রবাসীদের আত্মীয়পরিজনকে টাকা পরিশোধ করা হচ্ছে। হুন্ডির সঙ্গে জড়িত লোকজন অনেক ক্ষেত্রে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে হুন্ডির অর্থ পরিশোধ করছে। আর দেশের বাইরে ওই ডলার কিনে নিচ্ছে অর্থ পাচারকারীরা। বিদেশে যখন ডলারের চাহিদা থাকে তখন বৈধ পথে দেশে প্রবাসী আয় আসা কমে যাবে, এটিই স্বাভাবিক। বর্তমানে বাংলাদেশের প্রধান সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে পুঁজি পাচার। আমরা দেখেছি যে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশ এবং দুবাইয়ে বাংলাদেশিদের অর্থ পাচার বেড়ে গেছে।

নির্বাচনের পর যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন বা আন্তর্জাতিক কোনো মহল থেকে যদি বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা আসে, তাহলে বড় ধরনের ধাক্কা খাবে অর্থনীতি। এমনিতে অর্থনীতি সংকটে রয়েছে, এ অবস্থায় নিষেধাজ্ঞা সেই চাপ নেওয়ার সক্ষমতা নেই বাংলাদেশের।
প্রথম আলো:

অর্থ পাচারের সঙ্গে নিশ্চয়ই নির্বাচনের একটি সম্পর্ক রয়েছে। আপনি কী মনে করেন?

মইনুল ইসলাম: আগে নির্বাচনের বছরে পাচার বেড়ে যেত। এখন সব সময়ই পাচার হচ্ছে। দুর্নীতি ও ব্যাংক লুটের ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় পাচারও বেড়েছে। যারা নানা অনিয়ম করে টাকা কামান, তাঁরা কেউ দেশে টাকা রাখতে চান না। অর্থ পাচারের সঙ্গে রাজনৈতিক যোগসাজশেরও একটি বিষয় জড়িত।

প্রথম আলো:

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ইতিমধ্যে নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশ করেছে। সেখানে অর্থনীতিতে বিদ্যমান চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। যেসব পদক্ষেপ ঘোষণা করা হয়েছে, সেগুলো দিয়ে সংকট কাটবে কি?

মইনুল ইসলাম: নির্বাচনী ইশতেহারে আওয়ামী লীগ যেসব পদক্ষেপ ঘোষণা করেছে, সেগুলো দিয়ে সংকট কাটানো যাবে বলে আমি মনে করি না। কারণ, রপ্তানির ক্ষেত্রে আমরা একধরনের অনিশ্চয়তা দেখতে পাচ্ছি। রপ্তানিকারকেরা রপ্তানি কমে যাওয়ার আশঙ্কা ব্যক্ত করছেন। প্রবাসী আয় বৃদ্ধিরও খুব বেশি সম্ভাবনা দেখছি না। আবার নির্বাচনের পর বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞারও একধরনের শঙ্কা রয়েছে। দেশে যে নির্বাচন হতে যাচ্ছে সেটিকে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন মনে করছে না যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ও জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক মহল। তারা সবাই জানে, দেশে একটি একতরফা নির্বাচন হতে যাচ্ছে। এমন এক বাস্তবতায় নির্বাচনের পর যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন বা আন্তর্জাতিক কোনো মহল থেকে যদি বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা আসে, তাহলে বড় ধরনের ধাক্কা খাবে অর্থনীতি। এমনিতে অর্থনীতি সংকটে রয়েছে, এ অবস্থায় নিষেধাজ্ঞা এলে সেই চাপ নেওয়ার সক্ষমতা নেই বাংলাদেশের।

প্রথম আলো:

আপনি নির্বাচনের পর বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞার কোনো আশঙ্কা করছেন কি?

মইনুল ইসলাম: আপাতত আমি সে ধরনের কোনো আশঙ্কা করছি না। আমি মনে করি, নির্বাচনের পরপরই সরকার যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোকে নিজেদের পক্ষে আনার চেষ্টা করবে। সে ক্ষেত্রে হয়তো দেখা যেতে পারে, মার্কিন কোনো কোম্পানিকে সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের কাজ দেওয়া হতে পারে। আবার মার্কিন কোম্পানি বোয়িং থেকে কিছু উড়োজাহাজ কেনার উদ্যোগ নেওয়া হবে। এসব উদ্যোগ নেওয়ার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের চাপ সামাল দেওয়ার চেষ্টা করবে সরকার। এ ছাড়া সরকার মনে করছে, ভারত-রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো থাকলে যুক্তরাষ্ট্রের চাপ মোকাবিলায় খুব বেশি বেগ পেতে হবে না।

প্রথম আলো:

ভারত-রাশিয়া-চীনের মতো তিন পরাশক্তি পক্ষে থাকলে তাতে সরকার সব অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে পারবে বলে মনে করেন কি?

মইনুল ইসলাম: আমি তা মনে করি না। তবে এ কথা সত্য, ভারত আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষে থাকলে অন্য কারও পক্ষে তাদের পতন ঘটানো খুব কঠিন হবে। সেদিক থেকে হয়তো সরকারের খুব বেশি দুশ্চিন্তার কারণ নেই। তবে অর্থনৈতিক সংকট বা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ভারত কতটা বাংলাদেশের পক্ষে থাকবে, সেটি বলা কঠিন। তবে আমি মনে করি, নির্বাচনের পর আন্তর্জাতিক মহল থেকে যদি কোনো নিষেধাজ্ঞা না আসে এবং বর্তমান অর্থমন্ত্রীর চেয়ে দক্ষ কারও হাতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়, তাহলে চলমান সংকট মোকাবিলা খুব বেশি কঠিন হবে না।

প্রথম আলো:

দেশ যে ধরনের নির্বাচন ব্যবস্থায় ঢুকে গেছে, সেটি অর্থনীতি ও গণতন্ত্রের জন্য কতটা মঙ্গলজনক?

মইনুল ইসলাম: ২০১৮ সালের প্রহসনমূলক এক নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দেশের গণতান্ত্রিক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন প্রক্রিয়াটি শেষ হয়ে গেছে। এখন আর দেশে ভোটের গণতন্ত্র বলে কিছু নেই। তবে দ্রুত এ ব্যবস্থা থেকে আমরা বেরিয়ে আসতে পারব, সেটিরও কোনো সম্ভাবনা আমি দেখি না। বিদ্যমান নির্বাচন ব্যবস্থার মধ্য দিয়েই সরকার তার শাসনকাল এগিয়ে নিয়ে যাবে। আর সেই শাসনকালকে প্রলম্বিত করতে অর্থনীতির জন্যও নানা ব্যবস্থা নেবে। এভাবেই দেশ এগোবে। অদূর ভবিষ্যতেও আমি এর কোনো বিকল্প দেখি না।