বাজেটে এবার কাকে খুশি করবেন অর্থমন্ত্রী

অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক—দুই দিক থেকেই অর্থনীতিতে চাপ বাড়ছে। তাই সবাইকে খুশি করতে অর্থমন্ত্রীকে বাজেটের মঞ্চে জাদুই দেখাতে হবে।

ডলার–সংকট বাংলাদেশের অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যের জগতে এক বছর ধরে সবচেয়ে আলোচিত বিষয়। রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর তরতর করে দেশের রিজার্ভ কমেছে, যা ডলার–সংকট আরও প্রকট করেছে। এ ছাড়া সংকট চলছে অর্থনীতির সব খাতে। গত এক বছরে জীবনযাত্রার সংকট কেবলই তীব্র হয়েছে। মানুষ বাজারে গিয়ে কাঁদছে—এমন কথা সরকারের একাধিক মন্ত্রীও বলেছেন। কিন্তু দেশের অর্থনীতির মঞ্চে এখন স্পটলাইটে রয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল।

বাজেটে নানা গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষা করা এবং এসবের মধ্যে ভারসাম্য আনা যেকোনো অর্থমন্ত্রীর জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালকে আরও একবার এই চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। জাতীয় সংসদে তিনি আজ বৃহস্পতিবার যে বাজেটটি পেশ করতে যাচ্ছেন, তার মাধ্যমে তাঁকে প্রত্যাশা পূরণ করতে হবে এমন সব পক্ষের, অনেক ক্ষেত্রে যাদের স্বার্থ পরস্পরবিরোধী। অর্থনীতিতে যে সংকট চলছে, তা সামাল দিতে সরকার শেষ পর্যন্ত আইএমএফের কাছেই গেছে। আইএমএফ বড় অঙ্কের ঋণও দিয়েছে—৪৭০ কোটি মার্কিন ডলার। তবে এ ঋণের সঙ্গে দিয়েছে একগুচ্ছ শর্ত, যা পালন করতে হবে সময় ধরে ধরে। অর্থাৎ টাইমলাইনটিও আইএমএফ ঠিক করে দিয়েছে।

আইএমএফ

সবার আগে সরকারকে দৃষ্টি দিতে হবে বহুজাতিক এই ঋণদানকারী প্রতিষ্ঠানের দিকে। আইএমএফের শর্তগুলোর ব্যাপ্তি বিস্তৃত। বিভিন্ন খাতে সংস্কারের কর্মসূচি দিয়েছে তারা। অর্থনীতিবিদদের বেশির ভাগই একমত যে এসব সংস্কার বাস্তবায়ন করা বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য প্রয়োজনীয়। তবে সমস্যা হলো, দীর্ঘদিন ধরে অর্থনীতিতে সংস্কার হয়নি বললেই চলে। ফলে আইএমএফের শর্ত পালন এরই মধ্যে অনেক ক্ষেত্রে বেদনাদায়ক হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভর্তুকি কমানো শুরু হয়েছে। তাতে জ্বালানির দাম বেড়েছে, বেড়েছে পণ্যমূল্যও।

ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর এমনিতেই পণ্যমূল্যের বাড়বাড়ন্ত ছিল। এখন মূল্যস্ফীতি বেড়ে অনেক নিত্যপণ্য সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। মানুষের জীবনযাত্রা কঠিন হয়েছে, আয়ের সঙ্গে সংগতি রেখে ব্যয় করতে পারছেন না অনেকে। এখন আইএমএফের শর্ত মেনে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে ৪৮ হাজার কোটি টাকার অতিরিক্ত কর আদায় করতে হবে। অথচ চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ৩৪ হাজার কোটি টাকা কম রাজস্ব আদায় হয়েছে। সুতরাং বাড়তি কর আদায় করতে এনবিআরকে আরও কঠোর হতে হবে। বাস্তবায়ন করতে হবে আরও অনেক শর্ত। তাতে মানুষের দুর্দশা হয়তো বাড়বে, তবে শর্ত পালনের মাধ্যমে সরকার আইএমএফকে খুশি করবে, তাতে সন্দেহ নেই।

ব্যবসা-বাণিজ্য

গত এক বছর ছিল ব্যবসায়ীদের জন্য কঠিন সময়। ডলার কেবল মহার্ঘ মুদ্রা হয়েছে তাই নয়, কোনো কোনো ক্ষেত্রে এটি দুর্লভও হয়েছে। স্থানীয় বাজারে এক বছরে এই মুদ্রার দাম বেড়েছে প্রায় ৩০ শতাংশ। পরিস্থিতি সামাল দিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলার বিক্রি করে চলেছে। কিন্তু ব্যবসায়ীরা বলছেন, ব্যাংকগুলো প্রয়োজনীয় ডলার দিতে পারছে না, ফলে তাঁরা ঋণপত্র খুলতে হিমশিম খাচ্ছেন। কাঁচামাল আমদানি করতে পারছেন না। রপ্তানির চিত্রও আশাব্যঞ্জক নয়। প্রবাসী আয় শিগগিরই বাড়বে এমন কোনো লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না।

ডলার-সংকটে বিলাসপণ্যের আমদানি সংকোচনের উদ্যোগ নিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। তাতে গত জুন থেকে এপ্রিল পর্যন্ত সময়ে মূলধনি যন্ত্রপাতির আমদানি কমেছে ৫৬ শতাংশ, আর মধ্যবর্তী পণ্য আমদানি কমেছে ৩১ শতাংশ। সুখবর নেই বেসরকারি বিনিয়োগেও। দাম বাড়ানো হলেও শিল্প খাতে জ্বালানিসংকটের সুরাহা হয়নি। ব্যবসায়ীরা চান করপোরেট কর আরও কমানো হোক। কিন্তু আইএমএফ আবার করছাড়ের বিপক্ষে।

ভোটার

সন্দেহ নেই, অর্থমন্ত্রী এটা মাথায় রেখেছেন যে তিনি চলতি মেয়াদে সরকারের শেষ বাজেট দিচ্ছেন এবং এটি একটি নির্বাচনী বছর। গত দুটি সাধারণ নির্বাচন যেভাবে হয়েছে, তাতে হয়তো ভোটারদের খুশি করার বিষয়টি নিয়ে খুব একটা ভাবতে হয়নি অর্থমন্ত্রীকে। কিন্তু সম্প্রতি ঘোষণা করা মার্কিন ভিসা নীতির কারণে একটি প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচনের সম্ভাবনা বাড়ছে। তাই সাধারণ মানুষকে খুশি করার দিকে অর্থমন্ত্রীকে নিঃসন্দেহে নজর দিতে হবে।

কিন্তু আইএমএফের নানা শর্ত মেনে এই কাজ করা খুব একটা সহজ হবে না। গত এক বছর ছিল দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির বছর। দেশে মূল্যস্ফীতি এখনো ৯ শতাংশের বেশি। এখন পর্যন্ত জাতীয় রাজস্ব বোর্ড সূত্রে যতটুকু জানা গেছে, তাতে করমুক্ত আয়সীমা বাড়িয়ে সাধারণ মানুষকে খানিকটা স্বস্তি দেওয়ার চেষ্টা করবেন অর্থমন্ত্রী। সর্বজনীন পেনশনের ঘোষণাও থাকবে বাজেটে, কিন্তু বাধ্যতামূলক হবে আরও পাঁচ বছর পর।

আইএমএফের শর্ত মেনে নানা খাতে ভর্তুকি যদি আরও কমে, তবে মানুষের ব্যয় বাড়বে। এর মধ্যে ঠিক করা হয়েছে, ৪৪ ধরনের সরকারি সেবা পেতে হলে আয়কর রিটার্ন দাখিলের প্রমাণ দিতে হবে। সে ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন করের হারও বেঁধে দেওয়া হবে। মধ্যবিত্তের খরচ বাড়ার সব ইঙ্গিতই এখন পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে। সুতরাং একজন সাধারণ ভোটার শেষ পর্যন্ত এই বাজেটে কতটা খুশি হবেন, তা নিয়ে সংশয় থেকেই যাচ্ছে।

গত এক বছরে অর্থনীতির নানা খাতের সমস্যাগুলো কেবল খারাপই হয়েছে। অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক—দুই দিক থেকেই চাপ বাড়ছে এবং পরিস্থিতির শিগগিরই পরিবর্তন হবে—এমন লক্ষণও নেই। তাই সবাইকে একসঙ্গে খুশি করতে চাইলে অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামালকে বাজেটের মঞ্চে নেমে হয়তো জাদুই দেখাতে হবে। বাজেট বক্তৃতাভর্তি ব্রিফকেসে সেই জাদুর কাঠি কি রাখতে পারবেন অর্থমন্ত্রী? জানা যাবে আজ বিকেলের মধ্যেই।