দীর্ঘদিন সঠিক সিদ্ধান্ত হয়নি, এতেই সংকট তৈরি হয়েছে

অর্থনীতির বর্তমান সংকটময় পরিস্থিতি ও উত্তরণের উপায় নিয়ে প্রথম আলো আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা বলেছেন, বড় ধরনের সংস্কার ছাড়া বর্তমান অর্থনীতির সংকট মোকাবিলা করা কঠিন হবে। নির্বাচনের আগে সরকারের পক্ষে বড় ধরনের সংস্কার সম্ভব নয়। তবে নির্বাচনের পর সংস্কারের কৌশল কী হবে, তা এখনই ঠিক করতে হবে। গতকাল মঙ্গলবার প্রথম আলো কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এ বৈঠকে ছিলেন চার অর্থনীতিবিদ, একজন সাবেক ব্যাংকার ও একজন ব্যবসায়ী।

আরফান আলী

১৯৯৬ সালে থাইল্যান্ড বড় সংকটে পড়েছিল, যা এশিয়ার অন্যান্য দেশেও ছড়িয়েছিল। তখন পশ্চিমা দেশগুলোর অর্থায়নে দেশটিতে বড় বড় অবকাঠামো গড়ে উঠছিল। কিন্তু সংকটের কারণে সেসব দেশ হাত গুটিয়ে নিয়েছিল। বাংলাদেশের অর্থনীতির বর্তমান সংকটও সেভাবে তৈরি হয়েছে।

কারণ, স্বল্পমেয়াদি আমানতের টাকায় দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। বড় প্রকল্পগুলোর পাথরও বিদেশ থেকে আনতে হয়েছে। ফলে ডলারের ওপর চাপের সৃষ্টি হয়েছে। এটা দেশের প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সম্পর্কিত, প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে গিয়ে এই অসামঞ্জস্য তৈরি হয়েছে।

৯ শতাংশ সুদহার করোনাকালে খুব ভালো কাজে দিয়েছে। এর ফলে ব্যবসায়ীরা সহজে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। আমরা অন্য অনেক দেশের চেয়ে ভালোভাবে করোনার মোকাবিলা করেছি।
আরফান আলী, সাবেক এমডি, ব্যাংক এশিয়া চেয়ারম্যান, জয়তুন বিজনেস সলিউশন

ব্যাংক খাতে সুশাসনের চর্চার যে অভাব, তা দীর্ঘদিনের। ব্যাংকের যেকোনো সিদ্ধান্ত নেয় পরিচালনা পর্ষদ, আর তা বাস্তবায়ন করতে হয় ব্যাংকারদের। এ ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা হলে সে দায় গিয়ে পড়ে ব্যাংকারদের ওপর।

একইভাবে বাংলাদেশ ব্যাংক বারবার ঋণখেলাপিদের সুযোগ দিয়ে ঋণ পুনঃ তফসিল করার নীতিমালা দিচ্ছে আর তা ব্যাংককে বাস্তবায়ন করতে হচ্ছে। এই দায়ও গিয়ে পড়ছে ব্যাংকারদের ওপর। ফলে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ধারা পরিবর্তিত হয়ে গেছে। অনেকেই আবার এর সুযোগ নিচ্ছেন।

এদিকে বেশি ঋণ নেওয়া ব্যবসায়ীদের জন্য আলাদা প্রজ্ঞাপন জারি করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এটা কেন হবে? এর পেছনে মূলত বড় ব্যবসায়ীদের প্রভাব কাজ করে। দেশের আইনপ্রণেতাদের ৭০ শতাংশই ব্যবসায়ী। তাই আর্থিক খাতে খুব বেশি সুশাসন আশা করা যায় না। পুঁজিবাদের উত্থান শুরু হয় দুঃশাসন থেকে। বড়দের দৌরাত্ম্য বন্ধ করতে হলে রাজনৈতিক অঙ্গীকারের চর্চা করতে হবে।

পুঁজিবাদের দৌরাত্ম্যের কারণে দীর্ঘদিন ধরে আর্থিক খাতে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। এতে সংকট তৈরি হয়েছে। দীর্ঘ সময়ের জন্য ঋণ পুনঃ তফসিল, বাংলাদেশ ব্যাংকের নানা ছাড়ের প্রভাব এখন ব্যাংকের সূচকে পড়ছে। খেলাপি ঋণ বেড়ে যাচ্ছে। সামনে খেলাপি ঋণ আরও বাড়বে।

৯ শতাংশ সুদহার করোনাকালে খুব ভালো কাজে দিয়েছে। এর ফলে ব্যবসায়ীরা সহজে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। আমরা অন্য অনেক দেশের চেয়ে ভালোভাবে করোনার মোকাবিলা করেছি। কারণ, এখানে ব্যবসায়ীদের সুবিধা দেওয়া হয়েছে। বেতনের টাকা দিতে ঋণ দেওয়া হয়েছে।

এর প্রভাব এখন ব্যাংকের আর্থিক প্রতিবেদনে পড়ছে। করোনাকালে যেসব সুবিধা দেওয়া হয়েছে, তার প্রভাব এখন দেখা যাচ্ছে। যেসব পণ্য আমদানি করা হয়েছে, তা আমরা দেশে এনে ভোগ করেছি। কিন্তু সেই দায়ই এখন পরিশোধ করতে হচ্ছে। ২০২২ সালের মার্চের পর সুবিধা আর বাড়ানো হয়নি, ফলে সে সময় থেকে রিজার্ভে চাপ পড়তে শুরু করে। এ সিদ্ধান্ত যদি আরও দক্ষতার সঙ্গে নেওয়া হতো, তাহলে চাপ একেবারে আসত না।

আমেরিকার সুদহারের কারণে সবাই সুবিধা নিয়েছে। কম সুদে ঋণ এনে ব্যবসা সম্প্রসারণ করেছে। যখন ঋণ পরিশোধ করতে গেছে, তখন সুদহার অনেক বেড়ে গেছে। একই ঘটনা ১৯৯৬ সালে থাইল্যান্ডে ঘটেছিল। ডলার এখন একটা পণ্য হয়ে গেছে। আমেরিকা এখন জীবাশ্ম জ্বালানির রপ্তানিকারকে পরিণত হয়েছে। জীবাশ্ম জ্বালানির দাম যখন বাড়ে, তখন ডলারের দামও বেড়ে যায়। এতে আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলো সমস্যায় পড়ে যায়। এ জন্য বিদ্যমান সংকটের ব্যবস্থাপনা কীভাবে হবে, সেই পথরেখা ঠিক করতে হবে।

  • আরফান আলী
    সাবেক এমডি, ব্যাংক এশিয়া
    চেয়ারম্যান, জয়তুন বিজনেস সলিউশন