সাবেক অর্থমন্ত্রী এ এম এ মুহিতের ছোটবেলার ছোট ছোট গল্প

সাবেক অর্থমন্ত্রী সাবেক অর্থমন্ত্রী এ এম এ মুহিতের ৯০ তম জন্মদিনে তাঁকে স্মরণ করে এই নিবন্ধ লেখেন প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি ফখরুল ইসলাম। চলতি বছরের ২৫ জানুয়ারি এটি প্রথম প্রকাশিত হয়। আজ তা পুনরায় প্রকাশ করা হলো।

১৯৬১ সালে বিয়ের অনুষ্ঠানে নববধূর সঙ্গে আবুল মাল আবদুল মুহিত
সংগৃহীত

জাতীয় সংসদে ১২ বার বাজেট উপস্থাপন করা প্রয়াত অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ১৯৩৪ সালের ২৫ জানুয়ারি সিলেটে জন্মগ্রহণ করেন। মারা যান ২০২২ সালের ৩০ এপ্রিল। আজ তাঁর ৯০তম জন্মদিন। আবুল মাল আবদুল মুহিত ছিলেন তৎকালীন সিলেট জেলা মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাতা আবু আহমদ আবদুল হাফিজ ও সৈয়দা শাহার বানু চৌধুরীর ১৪ সন্তানের মধ্যে তৃতীয়।

স্ত্রী সৈয়দা সাবিয়া মুহিত একজন ডিজাইনার। তিন সন্তানের মধ্যে মেয়ে সামিনা মুহিত ব্যাংকার ও আর্থিক খাতের বিশেষজ্ঞ। বড় ছেলে সাহেদ মুহিত বাস্তুকলাবিদ এবং ছোট ছেলে সামির মুহিত শিক্ষক। আবুল মাল আবদুল মুহিতের দাদা খান বাহাদুর আবদুর রহিম ব্রিটিশ ভারতে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন।

যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা গ্রহণ করেছেন আবদুল মুহিত। মেধাবী ছিলেন। দুই পাকিস্তানের অর্থনৈতিক বৈষম্যের চিত্র তুলে ধরে ষাটের দশকের শুরুর দিকে ২৫ পৃষ্ঠার এক প্রবন্ধ লিখেছিলেন। তার আগে ১৯৫৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক (সম্মান) পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করেন তিনি। পরের বছর একই বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। অংশ নিয়েছিলেন ভাষা আন্দোলনে। ছাত্রজীবনে সলিমুল্লাহ হল ছাত্র সংসদের ভিপিও নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি।

১৯৫৬ সালে আবদুল মুহিত যোগ দেন পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে (সিএসপি)। সিএসপিতে যোগ দিয়ে তিনি ওয়াশিংটন দূতাবাসে পাকিস্তানের কূটনীতিকের দায়িত্ব নেন এবং মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১৯৭১ সালের জুনে পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করেন। ওই সময় তিনি বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করেন এবং যুক্তরাষ্ট্রে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

হার্ভার্ডে লিটাওয়ার কেন্দ্রে পাবলিক সার্ভিস ফেলোদের সঙ্গে
সংগৃহীত

১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ এইচ এম এরশাদ ক্ষমতা দখল করার পর তাঁকে অর্থ ও পরিকল্পনামন্ত্রী করার প্রস্তাব দিলে তিনি শর্ত সাপেক্ষে রাজি হন। শর্ত ছিল, নির্দলীয় সরকার গঠন করে জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। এরশাদ কথা না রাখলে দুই বছরের মাথায় মন্ত্রিত্ব থেকে পদত্যাগ করেন মুহিত।

মারা যাওয়ার আগে ২০২২ সালের ২১ মার্চ ঢাকার বনানীর বাসায় প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান ও বিশেষ প্রতিনিধি ফখরুল ইসলামকে দেওয়া তাঁর শেষ সাক্ষাৎকারে মুহিত বলেছিলেন, তিনি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হতে চেয়েছিলেন। তাঁর ভাষায়, ‘আমার খুব বাসনা ছিল। তবে বিষয়টি আমি প্রধানমন্ত্রীকে বলিনি কখনো। একমাত্র তাঁকেই বলতে পারতাম। অবশ্য এ নিয়ে আমার কোনো খেদ নেই।’

আবুল মাল আবদুল মুহিতের আত্মজীবনীর প্রথম পর্ব বের হয় ২০১৬ সালে। এর নাম ‘সোনালি দিনগুলি’। বইয়ে নিজের জীবনের বর্ণাঢ্য সব কাহিনি তুলে ধরেন মুহিত। পরের বছর ২০১৭ সালে ‘স্মৃতিময় কর্মজীবন’ নামে আরেকটি বই প্রকাশ করেন তিনি। চন্দ্রাবতী একাডেমি থেকে প্রকাশিত এ দুই বইয়ে তাঁর শৈশব, কৈশোর ও কর্মময় জীবনের বৈচিত্র্যপূর্ণ দিক ওঠে আসে। তাঁর ডাক নাম ছিল ‘শিশু’।

অঙ্কে শূন্য পেয়েছিলেন মুহিত

১৯৪১ সালে মুহিতরা দুই ভাই সিলেট সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পরীক্ষা দিয়েছিলেন। তাঁর ভাষায়, ‘আমার ভাই দিলেন চতুর্থ শ্রেণির জন্য আর আমি তৃতীয় শ্রেণির জন্য। আমার ভাই তৃতীয় শ্রেণির জন্য উপযুক্ত হলেও আমি পাস করলাম না। প্রধান শিক্ষক খান সাহেব মফিজুর রহমান প্রতিদিন একটি ছোট বেত নিয়ে নিঃশব্দে হাঁটতেন। সবাই তাঁকে ভয় করত। আব্বা প্রধান শিক্ষকের বাসায় নিয়ে গেলেন আমাকে। বললেন, “দুটি ছেলের মধ্যে যেটি খুবই ভালো, তাকে নিলেন না কেন?” শিক্ষক জানালেন, আমি শ্রুতলিপি ও অঙ্কে শূন্য পেয়েছি। তিনি বললেন, “এত যখন প্রশংসা করছেন, ওকে একদিন স্কুলে পাঠিয়ে দিয়েন।” পরদিন আব্বার মুনশি আবদুর রাজ্জাক স্কুলে নিয়ে গেলেন আমাকে। শিক্ষককে বলা হয়েছিল আমি ইংরেজি ভালো জানি। তাঁর প্রশ্ন ছিল, "What is your name and what is your father? " আমি উত্তর দিলাম, "My name is A M A Muhith and my father is a pleader"। প্রধান শিক্ষক হেড ক্লার্ক ও মুনশি সাহেবকে ডেকে বললেন, “ছেলেটিকে তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি করে নেন।”’

সিভিল সার্ভিস একাডেমি লাহোরে অশ্বারোহণের প্রশিক্ষণ নেওয়ার সময়
সংগৃহীত

‘তোমরা তো ঘোড়ার খোরাক খাও’

‘সোনালি দিনগুলি’ বইয়ে আবুল মাল আবদুল মুহিত লেখেন, ‘স্কুলে টিফিনের ব্যবস্থা ছিল আদা ও লবণমিশ্রিত ভেজা ছোলা। এটিকে খুব স্বাস্থ্যসম্মত খাবার বলে বিবেচনা করা হতো। ছোলা খেতাম বলে অন্য স্কুলের ছেলেরা খেপাত, “তোমরা তো ঘোড়ার খোরাক খাও।” আমরাও জবাব দিতাম, “আমরা তো তবু ঘোড়ার খোরাক খাই, তোমাদের তো টিফিনই নেই।”

‘ব্যক্তিগতভাবে ঝগড়া হলে আমরা খুব গালাগালি করতাম। তুই পচা, তুই গাধা, তুই বেকুব, তুই ঝগড়াটে ইত্যাদি ছিল বেশ শক্ত গালি। তারপরও ঝগড়া থাকলে নতুন নতুন গালি উদ্ভাবন করা হতো। একবার আমি ভূগোলের শব্দটব্দ দিয়ে গালি দেওয়া শুরু করলাম। যেমন তুই মাদ্রাজ, তুই বিহার ইত্যাদি। একবার ব্যবহার করি উড়িষ্যা। পর দিন থেকেই বন্ধু আহমদ কবীর চৌধুরী আমাকে চটাত খাউরি ও উড়িষ্যা বলে।

‘কেউ সুন্দর কাপড় পরে এলে আমরা বলতাম, ওর বেশ ফুটানি হয়েছে। ফুটানির জন্য খোঁটা দেওয়া হতো, “এত ফুটানি মারছিস কেন?” দেখতে গোবেচারা ও দুষ্টুমিতে ওস্তাদদের বলতাম “মিচকি শয়তান”।’

আব্বা তাঁকে পায়ে ধরে সালাম করেন

‘১৯৪১ সালে এক ভদ্রলোক আমাদের বাসায় সকালবেলা হাজির হন। আব্বা তাঁকে পায়ে ধরে সালাম করেন এবং আমাদের সবাইকে বললেন তাঁকে সালাম করতে। আমরা ভাবলাম তিনি নিশ্চয়ই একজন ঘনিষ্ঠ আত্মীয় হবেন। পরে জানলাম তিনি ঠিক আত্মীয় নন। তিনি আব্বার দেখাশোনা করেছিলেন দশ বছর (১৯০৮ থেকে ১৯১৮)। একধরনের অভিভাবক ও গৃহশিক্ষক হিসেবে ছিলেন। তাঁর নাম আবদুল গফুর চৌধুরী এবং পরবর্তী সময়ে তিনি আমাদের স্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। তাঁর পুত্র মাহমুদুল আমিন চৌধুরী বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি হন।
‘তিনি আমার অঙ্কে দুর্বলতা নিয়ে এত চিন্তিত ছিলেন যে প্রবেশিকা পরীক্ষার আগে তারই পরামর্শে সহকারী প্রধান শিক্ষক চন্দ্র গোপাল পাল দেড় মাস এক ঘণ্টা করে একান্তে পড়াতেন।’

পুলিশ ধরেছিল ছোটবেলায়

‘সহপাঠী সুবিমল রায় চৌধুরী আমার ঘনিষ্ঠ। ছোটবেলার ঘনিষ্ঠতা পরেও বজায় থাকে। আমার সাইকেলের ডগায় সচরাচর চলাফেরা করত সুবিমল। এক সন্ধ্যায় বংশালের কাছে পুলিশ আমাদের আটক করে। আমাদের দোষ হচ্ছে, বিনা লাইটে সাইকেল চালাচ্ছি। পুলিশ আমাদের বংশাল ফাঁড়িতে নিয়ে গেল এবং বলা হলো, আমাদের হাজতে থাকতে হবে। পরদিন ভাগ্য নির্ধারিত হবে আদালত থেকে। ব্যবস্থাটি মোটেই গ্রহণযোগ্য মনে হলো না। খুব খারাপ লাগল যে আমার বন্ধুটিকেও বিপদে ফেলেছি। বংশাল পুলিশ ফাঁড়ির কাছেই ছিল আমার ফুফুর বাড়ি। পুলিশকে বললাম যে “আমি যদি কোনো অ্যাডভোকেটকে নিয়ে আসতে পারি, তাহলে কি আমরা হাজতবাস থেকে রেহাই পাব?” পুলিশ বলল যে “হ্যাঁ।” বন্ধুকে জিম্মি রেখে ফুফুর বাসায় গিয়ে সৌভাগ্যবশত ফুপাকেও পেলাম। তিনি বিস্ময় প্রকাশ করে বললেন, “পুলিশ কী কারণে এত কড়াকড়ি করছে!” তিনি আমাকে নিয়ে পুলিশ ফাঁড়িতে এলেন এবং আমরা হাজতবাস থেকে রক্ষা পেলাম।’

অভিনেতা ও আবৃত্তিকার আবদুল মুহিত

ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ার সময় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা একটি নাটকে অভিনয়ের চেষ্টা করেও মনোনীত হতে পারেননি আবদুল মুহিত। মুহিতের ভাষায়, ‘তার প্রতিশোধ নিলাম “মার্চেন্ট অব ভেনিস”-এ পর্শিয়ার ভূমিকায় অভিনয় করে। “নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা” নাটকেও ছোটখাটো চরিত্রে অভিনয় করার সুযোগ পাই।’

সিলেটের রাজা গিরীশ চন্দ্র হাইস্কুলে মুসলিম লীগ আয়োজিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে স্থানীয় কবি আবদুর রাজ্জাকের লেখা ‘সিরাজ আবার তোমারে চাই’ শীর্ষক কবিতা আবৃত্তি করেন মুহিত। এ আবৃত্তি শোনার পর পি এম শাহাবুদ্দীন নামের এক রাজনৈতিক নেতা একটি স্বর্ণপদক ঘোষণা করেছিলেন। মুহিত লেখেন, ‘যদিও এ স্বর্ণপদক আমি কোনো দিন পাইনি। তবে এ নিয়ে আমার কোনো খেদ ছিল না।’

১৯৭৫ সালে ভাই শেলী মুবদির বিয়ের অনুষ্ঠানে সাত ভাই
সংগৃহীত

টেনিসে যৌথভাবে চ্যাম্পিয়ন মুহিত

আবদুল মুহিত জন্ম থেকেই সুস্বাস্থ্যের অধিকারী ছিলেন। তিনি লেখেন, ‘এ কারণেই খেলাধুলায় অংশগ্রহণের ব্যাপারে আমার উৎসাহ ছিল বেশি। প্রথম দিকে ডান্ডাগুটি, দাড়িয়াবান্ধা এবং দৌড়ের খেলা। পরে যুক্ত হলো হাডুডু, ফুটবল, ক্রিকেট, হকি এবং আরও পরে ভলিবল, বাস্কেটবল। কলেজে উঠে টেনিস। টেনিসে সহপাঠী শাহ মনওয়ারুল ইসলাম ছিল আমার পার্টনার। দ্বৈতভাবে একবার চ্যাম্পিয়ন হই। একক খেলায় চ্যাম্পিয়ন হইনি, তবে রানারআপ হয়েছি। ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত টেবিল টেনিস খেলা বহাল রাখি। একদিন গ্রীষ্মের দুপুরে টেনিস খেলতে গিয়ে মাঠে অজ্ঞান হয়ে যাই। এর পর থেকে টেনিস খেলা ছেড়ে দিলাম। এর পর থেকে ট্রেড মিল ও সাঁতার হয়ে গেল আমার খেলা।’

স্বাধীনতা যুদ্ধে বিশেষ অবদানের ও অন্যান্য কৃতিত্বের জন্য স্বাধীনতা পুরস্কার গ্রহণ
সংগৃহীত

পরীক্ষার খাতায় ‘হিপোক্রেসি’ বানান ভুল

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজিতে পড়ার সময় আবদুল মুহিত সলিমুল্লাহ হলে থাকতেন। সরকারি চাকরি থেকে অবসর নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে কলেজ পরিদর্শক হন তখন আবু হেনা নামের একজন বিখ্যাত শিক্ষক। পরে হলের প্রভোস্টও হন তিনি। মুহিত লিখেছেন, ‘একদিন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি বেরিয়েছেন এবং আমি সাইকেলে ফিরছি। তিনি আমাকে ইশারায় নামতে বললেন। তখন আমাদের বিএ সম্মান পরীক্ষার ফল বেরিয়েছে। আমি প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়েছি। তিনি চিরন্তন শিক্ষকের মতো প্রশ্ন করলেন, “হিপোক্রেসি বানান কর তো?” আমি থতমত খেয়ে এত সহজ প্রশ্নের জবাব দিলাম Hypocrisy। তিনি বললেন, “প্রথম শ্রেণির শ্রেষ্ঠ ছাত্র, পরীক্ষার খাতায় কিন্তু ভুল লিখেছ।” আমি নাকি Hypocrasy লিখেছিলাম। তিনি আমার হাতের লেখাও বুঝে নিয়েছিলেন। কারণ, পরীক্ষার খাতায় তো নাম থাকে না।’

মারা যাওয়ার আগের মাসে ২০২২ সালের ১৬ মার্চ সিলেট সিটি করপোরেশন তাঁকে ‘গুণী শ্রেষ্ঠ সম্মাননা’দেয়। ওই দিন তিনি বলেছিলেন, ‘যেখানেই ছিলাম না কেন বা থাকি না কেন, সিলেট আমাকে খুব টানে। আমি আবার সিলেট যাব।’ তাঁর সেই চাওয়া পূরণ হওয়ার আগেই ওই বছরের ৩০ এপ্রিল তিনি শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন।