মার্কিন বন্ড কেনা কমাচ্ছে চীন, ভেঙে পড়ছে দুই বিপরীতমুখী শক্তির অংশীদারি

ফাইল ছবি–এএফপি

পৃথিবীতে ঋণ করে ঘি খাওয়ার সবচেয়ে বড় নজির যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির জাতীয় ঋণসীমা প্রায় ৩২ ট্রিলিয়ন বা ৩২ লাখ কোটি ডলার; কিন্তু তা–ও যথেষ্ট নয়, চলতি বছর দেশটির জাতীয় ঋণসীমা বৃদ্ধি নিয়ে রীতিমতো অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছিল। সেখান থেকে তারা আপাতত মুক্তি পেলেও বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতির ঋণ করা ও তার পরিণাম কী, সেটা নিয়ে উন্নয়নশীল দেশগুলোর চিন্তিত হওয়ার কারণ আছে।

যে কারণে যুক্তরাষ্ট্রের ঋণ নিয়ে এ লেখার সূত্রপাত, সেটা হলো, যুক্তরাষ্ট্রের বন্ডের সবচেয়ে বড় ক্রেতা চীনের পিছু হটা। অর্থাৎ চীন যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি বন্ড কেনা কমিয়ে দিয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবর হলো, চীন গত আগস্ট পর্যন্ত টানা পাঁচ মাস যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি সিকিউরিটি কেনা হ্রাস করেছে। ফলে আগস্ট মাসে চীনের হাতে ৮০৫ দশমিক ৪০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ট্রেজারি সিকিউরিটি ছিল, ২০০৯ সালের মে মাসে যা ছিল সর্বনিম্ন ৮০১ দশমিক ৫০ বিলিয়ন ডলার।

দীর্ঘদিন ধরে চীন তাদের বৈদেশিক মুদ্রা মজুতের বড় একটি অংশ মার্কিন ট্রেজারি বন্ডে বিনিয়োগ করে আসছে। এখন তারা বিনিয়োগ বহুমুখী করা এবং মার্কিন ডলারের ওপর নির্ভরতা কমানোর চেষ্টা করছে। এ ছাড়া চীন আন্তর্জাতিক লেনদেনে নিজস্ব মুদ্রা ইউয়ানের আরও বেশি ব্যবহার এবং ইউক্রেনে হামলার পর রাশিয়া যে ধরনের নিষেধাজ্ঞার মুখোমুখি হয়েছে, সে ধরনের নিষেধাজ্ঞার ঝুঁকি থেকে মুক্ত থাকতে চাইছে বলেও অনেকে মনে করছেন। এ ছাড়া ওয়াশিংটনের নীতি নিয়ে বেইজিংয়ের যে অস্বস্তি রয়েছে, ট্রেজারি বন্ডে বিনিয়োগ কমিয়ে দেওয়া তার একটি নিদর্শন হিসেবেও দেখা হচ্ছে।

তবে বাস্তবতা হচ্ছে, চীন ও জাপানের মতো দেশ এত পরিমাণ ডলারভিত্তিক বন্ড কিনে রেখেছে যে তারা একবারে বেশি পরিমাণে বন্ড ছেড়ে দিলে ডলারের বিনিময় হার কমে যাবে, তখন বন্ডের সুদহার কমে যাবে, পরিণামে তাদেরই ক্ষতি। সে জন্য বিষয়টি অতটা সহজ–সরল হবে না। যুক্তরাষ্ট্র যে বৈশ্বিক আর্থিক ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে, তা পাশ কাটিয়ে ভিন্ন ব্যবস্থা গড়ে তোলাও অত সহজ নয় বলেই বিশ্লেষকেরা মনে করেন। এ পরিস্থিতিতে বিশ্লেষকেরা বলছেন, পশ্চিমমুখী বিশ্বায়নের বিপরীতে বহুপক্ষীয় বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে, যেখানে আঞ্চলিক লেনদেন অভিন্ন একক কোনো মুদ্রায় করা সম্ভব হবে।

চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক এত দিন ছিল পারস্পরিক নির্ভরশীলতার। রাজনৈতিকভাবে তারা কোনোকালেও এক মেরুর ছিল না। কিন্তু চীনের আজকের অবস্থানে আসার পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তার অংশীদারি মূল ভূমিকা পালন করেছে। চীন যে বিশ্বের কারখানা হয়ে উঠেছিল, সেই কারখানাগুলোর বেশির ভাগই যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানির, প্রযুক্তিও যুক্তরাষ্ট্রের।

চীন যুক্তরাষ্ট্রে যত পণ্য রপ্তানি করে, সেখান থেকে আমদানি করে তার চেয়ে অনেক কম। রপ্তানিতে সুবিধা বজায় রাখতে চীন দীর্ঘদিন মুদ্রা অবমূল্যায়ন করে রেখেছে। এ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র গাঁইগুঁই করলেও বিশেষ উচ্চবাচ্য করেনি। তবে চীনা মুদ্রার বিনিময়মূল্য বাড়লে যে চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যঘাটতিতে বিশেষ পরিবর্তন আসবে, তা নয়। যুক্তরাষ্ট্র সেটা বোঝে বলেই এ নিয়ে তেমন উচ্চবাচ্য করে না।

বিষয়টি হচ্ছে, এই চীনের মতো দেশগুলো রিজার্ভের অর্থ দিয়ে ট্রেজারি বন্ড কেনে। প্রতিবছর বিশ্বের বিভিন্ন দেশ শত শত কোটি ডলারের রিজার্ভ রাখছে, তাতে উন্নয়নশীল অর্থনীতিতে চাহিদার সংকট হচ্ছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদেরা। শক্তিশালী বৈশ্বিক অর্থনীতির জন্য শক্তিশালী চাহিদা প্রয়োজন। অর্থাৎ প্রয়োজনীয় পণ্য ও সেবা উৎপাদনের জন্য সক্ষমতা দরকার।

অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, রিজার্ভের বিপুল পরিমাণ অর্থ জমা থাকায় তা কাজে আসে না। বিদ্যমান বাস্তবতায় বিশ্বের অনেক দেশের পক্ষে সে চাহিদা তৈরি করা সম্ভব হয় না বলে এই শূন্যতা নানাভাবে পূরণ করা হয়। অতীতে অনেক উন্নয়নশীল দেশ এসব ক্ষেত্রে মুদ্রা ও রাজস্ব নীতির রাশ ছেড়ে দিত। সরকার সাধ্যের অতিরিক্ত ব্যয় করে ফেলত। পরিণাম—আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি করে তারা ঋণের চক্রে পড়ে যায়।

যুক্তরাষ্ট্র অবশ্য একভাবে তার ক্ষতিপূরণ করে দিচ্ছে। সেটি হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রে রিজার্ভ হিসেবে অর্থ রাখায় অন্যান্য দেশের সামগ্রিক চাহিদা কমলেও যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের চূড়ান্ত বা শেষ ভোক্তা হয়ে উঠেছে। তারা ঋণ করে বিপুল ঘাটতি বাজেট নিয়ে চলতে পারে। বিশেষ করে ২০০০ সালের পর থেকে বিপুল অঙ্কের ঘাটতি নিয়ে তারা চলছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ স্বল্প সুদে যুক্তরাষ্ট্রকে ঋণ দেওয়ায় সে দেশের রাজনীতিকেরা সুবিধা পাচ্ছেন। ডলার বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী রিজার্ভ মুদ্রা হওয়ায় তাঁরা দেশের ধনীদের করহার কমিয়েই যাচ্ছেন, ধনীরা পাচ্ছেন নানা ধরনের ছাড়।

যুক্তরাষ্ট্রের এই ঋণ করে ঘি খাওয়ার সুদিন আর নেই। ঋণসীমা বৃদ্ধি নিয়ে আগেও অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে সে দেশে, কিন্তু এবার আন্তর্জাতিক ঋণমান নির্ণয়কারী সংস্থাগুলো তাদের ঋণমান কমিয়ে দিতে শুরু করেছে। সেই সঙ্গে ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতি যে দিকে এগোচ্ছে, তাতে উন্নয়নশীল দেশগুলো ডলারভিত্তিক বৈশ্বিক আর্থিক ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার তোড়জোড় শুরু করেছে। গত দুই বছরে ডলারের বিনিময় হার বেড়ে যাওয়ার কারণে উন্নয়নশীল দেশগুলো বিপাকে পড়েছে। সামষ্টিক অর্থনৈতিক ঝুঁকির মুখে পড়েছে অনেক দেশ, যেমন বাংলাদেশ। ফলে সারা বিশ্বেই ডি–ডলারাইজেশন গতি পেয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের ঋণ করা কঠিন হচ্ছে

এদিকে চীনের উত্থান ঠেকাতে এবং ভূরাজনীতিতে নিজেদের হৃত আসন ফিরে পেতে মরিয়া হয়ে উঠেছে যুক্তরাষ্ট্র। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে ইউক্রেনকে বড় অঙ্কের সহায়তা দিচ্ছে তারা, যদিও ইরাক ও আফগানিস্তান যুদ্ধের জের এখনো তারা টানছে। এর মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যে শুরু হয়েছে ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধ। এখন এসব যুদ্ধে সহায়তা দিতে বাইডেন প্রশাসন ১০৬ বিলিয়ন ডলার সহায়তার প্রস্তাব দিয়েছে, যার বিরুদ্ধে দেশটির ক্ষমতাকাঠামোর একাংশ তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে। যেমন আগামী নির্বাচনে রিপাবলিকান দলের প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী বিবেক রামাস্বামী বলেছেন, ইরাক ও আফগানিস্তানে যুদ্ধ করে যুক্তরাষ্ট্রের লাভ হয়নি, উল্টো সাত লাখ কোটি ডলারের ঋণ হয়েছে। এখন ইউক্রেন ও মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধে জড়িয়েও যুক্তরাষ্ট্র তেমন কিছু অর্জন করতে পারবে না বলেই তিনি বিশ্বাস করেন। সে জন্য তাঁর আহ্বান, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ এড়াতে হবে এবং সেই সঙ্গে চীন থেকে পুরোপুরি স্বাধীন হতে হবে।

রাজনীতিই শেষ কথা

যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি বন্ড কিনে কার্যত সে দেশের ধনীদের সেবা করছে চীন। বিষয়টি হলো, ডলারভিত্তিক রিজার্ভ ব্যবস্থার কারণে বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলো যে তাদের বন্ড কিনছে, তাতে যুক্তরাষ্ট্র কম সুদে ঋণ নিতে পারছে। সেই ঋণে বলীয়ান হয়ে তারা ধনীদের কর ছাড় দিচ্ছে এবং জাতীয় ঋণের সীমা বাড়িয়েই চলেছে।

এখন যে চীন ডলার ত্যাগ করছে বা বন্ড ছেড়ে দিচ্ছে, তা নিছক অর্থনৈতিক কারণে নয়; বরং রাজনৈতিক কারণেই তা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে চীন ঠেকানোর নীতি গ্রহণ করেছে, তাতে চীনও ক্ষেপে উঠেছে। সেই সঙ্গে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ডলার ব্যবহার আরও কমিয়েছে চীন। এসব সিদ্ধান্ত যত না অর্থনৈতিক কারণে নেওয়া হচ্ছে, তার চেয়ে রাজনৈতিক কারণেই বেশি নেওয়া হচ্ছে।