কাঠামোগত সংস্কার ছাড়া কোনো কিছু কাজ করবে না: রাশেদ আল মাহমুদ

নতুন সরকার গঠিত হয়েছে। বদল এসেছে মন্ত্রিসভায়ও। তবে সরকারের বিভিন্ন পর্যায় থেকে বলা হচ্ছে, অর্থনীতিই এখন সরকারের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ। অর্থনীতির বর্তমান সংকট ও করণীয় নিয়ে প্রথম আলো আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে আলোচকেরা বলেছেন, এই পরিস্থিতিতে কী করণীয়।

রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীরপ্রথম আলো

সরকারের পরিসংখ্যানে সমস্যা আছে বলে অভিযোগ করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর। তিনি বলেন, পরিসংখ্যান না থাকলে নীতি প্রণয়ন করা যায় না।

গতকাল শনিবার প্রথম আলো আয়োজিত ‘অর্থনীতি: নতুন সরকারের চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর বলেন, পরিসংখ্যান প্রসঙ্গে বলা দরকার, রপ্তানির তথ্য আমরা কোনটা বিশ্বাস করব—বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য, রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর নাকি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের। আগে এটা ঠিক করা দরকার, কার তথ্য সঠিক। বানানো গল্পের ওপর আলোচনা করা হলে সেই গল্পের ভিত্তি থাকে না।

জিডিপি নিয়ে আলোচনা করে লাভ নেই, সেখানে সব তথ্য থাকে না। ফলে যেসব ক্ষেত্রে প্রকৃত তথ্য থাকা দরকার, সেখানে তা আছে কি না, তা দেখা দরকার বলে মনে করেন রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর। তাঁর প্রশ্ন, প্রকৃত তথ্য না থাকলে নীতিনির্ধারণ কীভাবে হবে। প্রকৃত তথ্য থাকলে বাস্তবতা সম্পর্কে জানা যাবে, সেটা জানা থাকলে বাস্তবভিত্তিক নীতি প্রণয়ন করা যাবে। অপতথ্য ও ভুল তথ্য আলাদা করতে হবে। যেসব বিষয় আমাদের জানা আছে বা যেগুলো মীমাংসিত বিষয়, সেগুলো দিয়ে আমাদের শুরু করতে হবে, যেমন আমদানি, রপ্তানি, আর্থিক ও চলতি হিসাবের তথ্য।

দ্বিতীয়ত, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফে বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে, কিন্তু দেশে আইএমএফ নিয়ে আলোচনায় তার ছাপ পাওয়া যাচ্ছে না বলে মন্তব্য করেন রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর। সেটা হলো, কাঠামোগত সংস্কার ছাড়া অর্থনৈতিক সংস্কার হবে না। কিন্তু এখানে আলোচনা হচ্ছে সুদহার নিয়ে—নয়-ছয় ও সুদহার বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া নিয়ে। কিন্তু এখানে অনুমিতি বা মডেলের ক্ষেত্রে বড় ধরনের ভুল আছে। বিষয়টা হচ্ছে, বাজার একধরনের প্রতিষ্ঠান, সেটা কাজ না করলে কীভাবে কী হবে।

ধনবান ও নীতিপ্রণেতারা একাকার হয়ে গেলে বড় সমস্যা হয় বলে অভিযোগ করেন রাশেদ আল মাহমুদ। বলেন, কেউ বিশ্বমানের শপিং মল নির্মাণ করবেন। নীতি প্রণয়নে তাঁর প্রভাব থাকলে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানানো হবে, তিনি যেহেতু শপিং মল নির্মাণ করবেন, সেহেতু তাঁকে করছাড় দেওয়া হোক। ফলে সুদহার, শুল্ক যৌক্তিকীকরণ, কার্যকর বিনিময় হার ও ঋণ নিশ্চিত করা—এই চারটি বিষয় এখানে কাজ করবে না; কারণ, ধনবান ও নীতি প্রণেতারা একাকার হয়ে গেলে এই বিষয়গুলো কাজ করে না।

সে জন্য বিশ্ববাজারে খাদ্য ও জ্বালানির দাম কমলে দেশের বাজারে কমে না। আমার এক ছাত্র মাস্টার্স থিসিসে বিষয়টি চমৎকারভাবে এনেছে।  কথা হচ্ছে, কাঠামোগত সংস্কার না হলে সুদহার বা মুদ্রার বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করা যাবে না।

জনপরিসরে বিভিন্ন আলোচনার প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন রাশেদ আল মাহমদু তিতুমীর। বলেন, বাংলাদেশ কেন ঋণ পরিশোধের সংকটে পড়েছে, কেন সরকারি ঋণ ৩২২ শতাংশ বেড়েছে বা খেলাপি ঋণ কেন ৭০০ শতাংশ বেড়েছে। আমাদের কর-জিডিপির অনুপাত অনেক কম বা ঋণ-জিডিপির অনুপাত নিয়ে আলোচনা হয়, এই আলোচনার প্রাসঙ্গিকতা কী। দেশের কর আয় কত এবং এর সঙ্গে ঋণের সম্পর্ক কী। সরকার বা প্রতিষ্ঠানের আয় যত হবে, তার ঋণ নেওয়ার সক্ষমতাও তত হবে। কথা হচ্ছে, আমাদের সামষ্টিক অর্থনীতিতে যে ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি হয়েছে তা হয়েছে কাঠামোগত কারণে।

বিভিন্ন খাতে দেশের নিরাপত্তা নিয়ে আলোচনা করেন রাশেদ আল মাহমুদ। বলেন, নিরাপত্তার তিনটি দিক আছে, সেগুলো বিবেচনা করা হলে দেখা যাবে, আমরা হুমকির সম্মুখীন। প্রথম নিরাপত্তার জায়গা হচ্ছে খাদ্য। খাদ্য নিয়ে পত্রিকায় যে আলোচনা হয় সেটা হলো ভরা মৌসুমে চালের দাম বেশি কেন, ভালো বিষয়। কিন্তু যে আলোচনা হয় না, সেটা হলো কৌশলগত খাদ্যপণ্যের জন্য আমরা একটি দেশের ওপর নির্ভরশীল। রাজীব গান্ধী যখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী, তখন ভূমিবেষ্টিত দেশ নেপালের অবস্থা কী হয়েছিল। আমাদের এখানে দাম বাড়ার পেছনে তৃতীয় দেশের ভূমিকা আছে। অর্থাৎ খাদ্যনিরাপত্তা বড় ধরনের হুমকির সম্মুখীন।

জ্বালানি নিরাপত্তা হুমকির সম্মুখীন বলে উল্লেখ করেন রাশেদ আল মাহমুদ। বলেন, মিয়ানমারে এখন ২৮ শতাংশ মূল্যস্ফীতি। মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলোতে প্রথাগত সেনাবাহিনীর সঙ্গে বিদ্রোহী বাহিনীর লড়াই–সংগ্রাম চলছে, যেমন চীন। রোহিঙ্গা সংকটের কারণে আমরা ভুক্তভোগী হয়েছি, এবার তার সঙ্গে যুক্ত হবে মিয়ানমারের অর্থনৈতিক সংকট। ফলে আমাদের মিয়ানমার সীমান্ত দিয়ে পাচার বাড়বে, বিনিময়ে আসবে মাদক। মনে রাখা দরকার, হুন্ডি ব্যবসা চালায় এই মাদককেন্দ্রিক অর্থনীতি। এটা কোন ধরনের নিরাপত্তাহুমকি সৃষ্টি করবে, তা খতিয়ে দেখা দরকার। সামষ্টিক অর্থনীতির সঙ্গে এটি বড় ধরনের হুমকি তৈরি করবে। এ ধরনের পরিস্থিতি প্রতিরোধ করার মতো বাস্তবতা আমাদের দেশে নেই।  
নিরাপত্তাহীনতার এই ক্ষেত্রগুলো নীতিবাহিত।

অর্থাৎ যাঁরা নীতি প্রণয়ন করছেন, তাঁরা জানেন, এসব আছে। যেমন আমদানিনির্ভর নীতি প্রণয়ন করা হলে যে ভূরাজনৈতিক যেকোনো গোলযোগের প্রভাব দেশীয় উদ্যোক্তাদের ওপর পড়বে, তা আগেভাগেই জানা ছিল বলে অভিযোগ করেন রাশেদ আল মাহমুদ।  

রাশেদ আল মাহমুদের ভাষ্য, বিদ্যমান রাজনৈতিক বন্দোবস্ত এসব সংকটের সমাধান দেবে না। এফডিআই কেন স্থবির হয়ে গেছে ও সঞ্চয়ের হার কম কেন এবং আয়কর কেন বাড়ছে না, এসব নিয়ে আলোচনা হবে না। একটা সম্পদনির্ভর সিন্ডিকেট তৈরি হয়েছে, যাকে টিকিয়ে রাখতে হয়। সমস্যা হচ্ছে, ব্যাংক ও আর্থিক খাত টাকা দিতে না পারলে ভবিষ্যতে দখলদারি বাড়বে। এটা বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে।