বলেছিলেন কোথাও না কোথাও দাঁড়ি টানতে হয়...

অ্যাপেক্স গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী। ২০২১ সালের ৯ নভেম্বর গুলশানে অ্যাপেক্সের কার্যালয়েছবি: আশরাফুল আলম

অফিসকক্ষে ঢুকতেই নিজের আসন ছেড়ে উঠে এসে আমাদের স্বাগত জানালেন। কুশল বিনিময় করে জিজ্ঞাসা করলেন, কোথায় বসলে তোমাদের সুবিধা হয়। বললাম, আপনি যেখানে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। বললেন, তাহলে সোফায় বসি; কথা বলতে সুবিধা হবে। এরপর আরাম করে সোফায় বসলেন সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী। সামনের সোফায় আমি।

শুরুতেই সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী দুঃখ প্রকাশ করে বললেন, শরীরটা একটু খারাপ ছিল তাই আগে সময় দিতে পারিনি। শুরুতে সাক্ষাৎকারের বাইরে বিভিন্ন বিষয়ে নিজে ১৫–২০ মিনিট কথা বললেন। জানতেও চাইলেন কিছু বিষয়ে। ঘটনাটি ২০২১ সালের ৯ নভেম্বরের।

চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের দেশের শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান অ্যাপেক্স ফুটওয়্যার নিয়ে প্রথম আলোর বিশেষ এক প্রতিবেদনের জন্য ওই দিন আমরা মুখোমুখি হয়েছিলাম প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান সৈয়দ মঞ্জুর এলাহীর। প্রতিবেদক ও ফটোসাংবাদিক মিলে আমরা ছিলাম দুজন। একই বছরের ৬ নভেম্বর সাক্ষাৎকারের দিনক্ষণ চূড়ান্ত হলেও সেদিন মঞ্জুর এলাহীর অসুস্থতার কারণে তা আর হয়নি। তার পরিবর্তে ৯ নভেম্বর সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। আজ বুধবার সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান বিশিষ্ট শিল্পোদ্যোক্তা ও অ্যাপেক্স ফুটওয়্যারের চেয়ারম্যান সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী। তাঁর মৃত্যুর সংবাদে ২০২১ সালে নেওয়া সেই সাক্ষাৎকারের দিনটির কথাই মনে পড়ছে বারবার।

ওই দিন সাক্ষাৎকারের শুরুতেই নিজের ছেলেবেলায় ফিরে গেলেন সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী। বললেন, আমার জন্ম কলকাতায়। আমাদের পরিবার ছিল আইন পেশার সঙ্গে যুক্ত। বাবা সৈয়দ নাসিম আলী ১৯৪৬ সালে কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি হয়েছিলেন। তার আগের বছর ব্রিটিশ সরকার তাঁকে ‘নাইট’ উপাধি দেয়। বড় ভাই এস এ মাসুদও ১৯৭৭ সালে প্রধান বিচারপতি হয়েছিলেন। মেজ ভাই এস এ মওদুদ বিলেত থেকে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়াশোনা করে সরকারি চাকরিতে যোগ দেন। আর সেজ ভাই এস এ মনসুর ছিলেন ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য।

সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী কলকাতাতেই স্কুল ও কলেজের পাট শেষ করেন। ১৯৬২ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক ডিগ্রি নেন। তারপর স্নাতকোত্তর করতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন, ১৯৬৪ সালে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। থাকতেন সলিমুল্লাহ মুসলিম (এস এম) হলে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।

কলকাতা ছেড়ে ঢাকায় কেন পড়তে এলেন জানতে চাইলে মঞ্জুর এলাহী বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগ তখন খুবই শক্তিশালী। আনিসুর রহমান, রেহমান সোবহানদের মতো শিক্ষকেরা তখন অর্থনীতি পড়াতেন। বড় ভাই আমাকে বলেছিলেন, তোমাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি পড়তে হবে।

সাক্ষাৎকারের পুরো সময়টা ছিলেন হাসিমুখে। কথার ফাঁকে ফাঁকে মন খুলে হাসেন। প্রাণোচ্ছল মানুষটার বয়স তখন ৭৯। ছোটবেলায় কখনো ভেবেছিলেন ব্যবসায়ী হবেন—এমন প্রশ্নের উত্তরে হাসতে হাসতে বললেন ‘ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন ছিল চাকরি করব না; ব্যবসা করব, নিজের পায়ে দাঁড়াব। প্রত্যেক মানুষেরই স্বপ্ন থাকে; আমারও ছিল। ব্যবসার কথা বললে আমার ভাইয়েরা হাসাহাসি করত। বলত, ‘তুই ব্যবসার কী বুঝিস। আমাদের চৌদ্দ পুরুষ কেউ ব্যবসা করেনি।’

ছোটবেলা থেকে চাকরি না করার স্বপ্ন দেখলেও বহুজাতিক কোম্পানিতে কর্মজীবন শুরু করেছিলেন সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী। ১৯৭২ সালে ৩০তম জন্মদিনে ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বা বিএটির চাকরি ছেড়ে চামড়ার ব্যবসায় যুক্ত হলেন। ১৯৭৬ সালে রাষ্ট্রমালিকানাধীন ওরিয়েন্ট ট্যানারি নিলামে কিনে অ্যাপেক্স ট্যানারির যাত্রা শুরু করেন মঞ্জুর এলাহী। ১৪ বছর ট্যানারির ব্যবসার পর জুতা রপ্তানির জন্য কারখানা করেন। ১৯৯০ সালে যখন কারখানার মাটি কাটা শুরু হলো, তখন তাঁর একমাত্র ছেলে সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর দেশে ফিরে প্রকল্পটির সঙ্গে যুক্ত হন।

সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী শুধু সফল ব্যবসায়ীর গণ্ডির মধ্যে নিজেকে আটকে রাখেননি। তিনি ১৯৯৬ সালে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ছিলেন। তখন যোগাযোগ, নৌপরিবহন, বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন, ডাক ও টেলিযোগাযোগ এবং গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন। ২০০১ সালেও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হন। তার বাইরে সংগঠক হিসেবেও অনেক কাজ করেছেন তিনি।

দেড় ঘণ্টার আলাপচারিতার শেষ দিকে মঞ্জুর এলাহীর কাছে জানতে চাইলাম অবসর কীভাবে কাটে। বললেন, দুপুরের পর অফিসে থাকেন না। অ্যাপেক্সের বাইরেও অন্য সংস্থার কাজে যুক্ত থাকেন। অবসরে বই পড়েন। প্রচুর গান শোনেন। বন্ধুদের সঙ্গেও আড্ডা হয়।

করোনার প্রথম ঢেউয়ে সৈয়দ মঞ্জুর এলাহীর জীবনসঙ্গী নিলুফার মঞ্জুর করোনা আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর শূন্যতার কথা এক–দুইবার বললেন। তবে জীবন নিয়ে সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী কথাগুলো মন ছুঁয়ে গেল, ‘জীবন নিয়ে আমার কোনো আফসোস নেই। একজন মানুষের কত আর প্রয়োজন। কোথাও না কোথাও তো দাঁড়ি টানতে হয়...।’

আলাপ শেষে আশরাফুল আলম যখন ছবি তোলার কথা বললেন তখন মঞ্জুর এলাহী বেশ আগ্রহ নিয়ে পোজ দিলেন। তাঁর কার্যালয়ে দেয়ালে দেয়ালে ছিল বিখ্যাত চিত্রশিল্পীদের চিত্রকর্ম। নিজে ডেকে আমাদের একটি ছবি দেখালেন, তাঁর পৈতৃক বাড়ির একটি স্কেচ।

আলাপচারিতা শেষে ফেরার পথে হাসিমুখে নিজেই দরজা পর্যন্ত এগিয়ে এসে আমাদের বিদায় দিলেন। তারপর ২০২২ সালের ২৪ জানুয়ারি প্রথম আলোতে ‘সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী: বহুজাতিকের চাকরি ছেড়ে চামড়ায় সফল ব্যবসায়ী’ শিরোনামে প্রতিবেদনটি ছাপা হয়।

প্রতিবেদনটি ছাপা হওয়ার দিন দুপুরে অপরিচিত এক নম্বর থেকে ফোন এল। রিসিভ করতেই অপর প্রান্ত থেকে এক ব্যক্তি বললেন, চেয়ারম্যান (মঞ্জুর এলাহী) স্যার কথা বলবেন। এরপর অপর প্রান্ত থেকে মঞ্জুর এলাহী সাহেব ফোন ধরে বললেন, ‘আপনি তো অনেক সুন্দর করে লিখেছেন। আমি তো এত গুছিয়ে বলতে পারিনি। আরেক দিন আসেন আমার অফিসে, চায়ের দাওয়াত।’