সাক্ষাৎকার

চ্যালেঞ্জের মধ্যেও আবাসন খাত ঘুরে দাঁড়ানোর পথে

দেশের অর্থনৈতিক স্থবিরতা, উচ্চ সুদের হার এবং সামনে জাতীয় নির্বাচন—এমন প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের আবাসন খাত একধরনের কঠিন সময় অতিক্রম করছে। তবে এই চ্যালেঞ্জের মধ্যেও সম্ভাবনা দেখছেন উদ্যোক্তারা। আবাসন খাতের সার্বিক অবস্থা ও আগামী দিনের দিকনির্দেশনা নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাব) সভাপতি মো. ওয়াহিদুজ্জামান। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শামসুল হক মো. মিরাজ

প্রথম আলো:

রিহ্যাব ফেয়ার ২০২৫–এর প্রস্তুতি কেমন নিলেন? দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় এ বছরের মেলায় অংশগ্রহণ ও ক্রেতাদের সাড়া সম্পর্কে আপনার কী প্রত্যাশা?

মো. ওয়াহিদুজ্জামান: রিহ্যাব মেলার প্রস্তুতি আমরা বেশ আগে থেকেই
শুরু করেছি। এবারের মেলাকে শুধু ফ্ল্যাট বা প্রকল্প প্রদর্শনীর জায়গা হিসেবে নয়, বরং আবাসন খাতের বর্তমান চ্যালেঞ্জ, ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা এবং নীতিগত আলোচনার একটি কার্যকর প্ল্যাটফর্ম হিসেবে সাজানো হয়েছে। অর্থনৈতিক বাস্তবতা কিছুটা কঠিন হলেও আমরা ইতিমধ্যে বেশ কিছু কোম্পানির অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে পেরেছি। ক্রেতাদের মধ্যেও আগ্রহ দেখা যাচ্ছে—বিশেষ করে মধ্যবিত্ত ও প্রবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যে। বাজারে স্থবিরতা থাকলেও মানুষ এখনো নিজের একটি
বাসার স্বপ্ন নিয়ে এগোতে চায়। এবারের মেলায় বাস্তবসম্মত দামে মানসম্মত নতুন প্রকল্পের সঠিক তুলনা করতে পারলে ক্রেতাদের আস্থা বাড়বে।

প্রথম আলো:

দেশের আবাসন খাতের সার্বিক ব্যবসা কীভাবে এগোচ্ছে? খাতটি কি স্থিতিশীলতা ধরে রাখতে পারছে?

মো. ওয়াহিদুজ্জামান: একটি বিষয় পরিষ্কারভাবে বলা যায়—বাংলাদেশে আবাসনের চাহিদা কখনোই কমেনি। বরং নগরায়ণ, জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও কর্মসংস্থানের বিস্তারের কারণে চাহিদা আরও বাড়ছে। তবে সমস্যা তৈরি হয়েছে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ও বাজারমূল্যের মধ্যে ব্যবধানের কারণে। বাজার পুরোপুরি স্থবির নয়; বরং খাতটি নতুন বাস্তবতার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। নির্মাণ উপকরণের মূল্যবৃদ্ধি এবং কিছু নীতিগত পরিবর্তনে চাপ এলেও দীর্ঘ মেয়াদে আবাসন খাত দেশের অর্থনীতি, কর্মসংস্থান ও নগর উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

প্রথম আলো:

জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরপরই রিহ্যাব মেলা অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। নির্বাচনী পরিবেশে আবাসন বাজারের আস্থা ও সম্ভাবনাকে আপনি কীভাবে দেখছেন?

মো. ওয়াহিদুজ্জামান: নির্বাচনের সময় সাধারণত বিনিয়োগকারী ও ক্রেতাদের মধ্যে কিছুটা দ্বিধাদ্বন্দ্বের মনোভাব তৈরি হয়, যা স্বাভাবিক। তবে আমাদের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, নির্বাচন–পরবর্তী সময়ে বাজার দ্রুত পুনরুদ্ধার হয়। মানুষের বাসস্থানের প্রয়োজন কখনো থেমে থাকে না। আমরা আশা করছি, নির্বাচন–পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরে এলে বিনিয়োগ ও কেনাকাটার সিদ্ধান্ত আরও গতি পাবে। দীর্ঘ মেয়াদে আবাসন খাতের সম্ভাবনা এখনো খুবই উজ্জ্বল।

প্রথম আলো:

বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনায় (ড্যাপ) কোন সংশোধন বাস্তবসম্মত, যা বাজারকে স্বস্তি দিতে পারে?

মো. ওয়াহিদুজ্জামান: ড্যাপ অবশ্যই বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে। পুরো ঢাকায় একই উচ্চতা ও ফ্লোর এরিয়া রেশিও (ফার) নীতি প্রয়োগ করলে অনেক এলাকায় আবাসন উন্নয়ন কঠিন হয়ে পড়ে। এলাকাভেদে উচ্চতা ও ফার নির্ধারণ করা হলে উন্নয়ন সহজ হবে এবং একই সঙ্গে পরিবেশ ও জনঘনত্বের ভারসাম্য বজায় রাখা সম্ভব হবে। আমরা চাই, ড্যাপ হোক বাস্তবসম্মত, পরিবেশবান্ধব ও জনবান্ধব।

প্রথম আলো:

উচ্চতা ও ফার–সংক্রান্ত বিধিনিষেধ কি ফ্ল্যাটের খরচ বাড়াচ্ছে?

মো. ওয়াহিদুজ্জামান: নিঃসন্দেহে বাড়াচ্ছে। ফার কম হলে একই জমিতে কম ইউনিট নির্মাণ করা যায়, ফলে প্রতিটি ইউনিটে জমি ও নির্মাণ ব্যয়ের চাপ বেড়ে যায়। এর সরাসরি প্রভাব পড়ে ফ্ল্যাটের দামে। আমরা চাই পরিকল্পনা সংস্থা, সিটি করপোরেশন ও রাষ্ট্র—সবাই মিলে একটি ভারসাম্যপূর্ণ নীতি গ্রহণ করুক। যাতে উন্নয়ন যেমন হয়, তেমনি সাশ্রয়ী আবাসনও নিশ্চিত হয়।

প্রথম আলো:

ফ্ল্যাটের দাম মধ্যবিত্তের হাতের নাগালের বাইরে যাওয়ার মূল কারণ কী?

মো. ওয়াহিদুজ্জামান: ফ্ল্যাটের মূল্যবৃদ্ধির পেছনে একাধিক কাঠামোগত কারণ রয়েছে। নির্মাণ উপকরণের দাম গত কয়েক বছরে অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। ঢাকায় জমির সংকট ও জমির উচ্চ মূল্য প্রকল্প ব্যয়ের সবচেয়ে বড় চাপ। পাশাপাশি ব্যাংকঋণের উচ্চ সুদ নির্মাতা ও ক্রেতা—উভয়ের জন্য বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর সঙ্গে অনুমোদনপ্রক্রিয়ার জটিলতা এবং বিভিন্ন ফি–চার্জ যোগ হয়ে প্রকল্প ব্যয় আরও বাড়াচ্ছে।

প্রথম আলো:

মধ্যবিত্ত ও স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য সাশ্রয়ী আবাসন নিশ্চিত করতে কী করা প্রয়োজন?

মো. ওয়াহিদুজ্জামান: সাশ্রয়ী আবাসন শুধু ব্যবসার বিষয় নয়, এটি সামাজিক নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের অংশ। এ কারণেই রাষ্ট্রীয় কাঠামো, নীতিসহায়তা ও বেসরকারি বিনিয়োগ—তিনটি বিষয়কে একসঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। এটি বাস্তবায়নে দীর্ঘমেয়াদি জাতীয় হাউজিং নীতি প্রয়োজন। কম সুদের গৃহঋণ চালু করা, শহরের বাইরে উপশহরভিত্তিক আবাসন পরিকল্পনা এবং সরকারি–বেসরকারি অংশীদারত্ব বাড়ানো জরুরি। সরকার জমি দেবে, বেসরকারি খাত নির্মাণ করবে—এভাবে বিপুলসংখ্যক পরিবার সাশ্রয়ী দামে বাসা পেতে পারে।

প্রথম আলো:

আগামী ৫–১০ বছরে আবাসন খাত কোন দিকে যেতে পারে?

মো. ওয়াহিদুজ্জামান: আগামী দশকে বাংলাদেশের আবাসন খাত একটি ইতিবাচক রূপান্তরের মধ্য দিয়ে যাবে। প্রযুক্তিনির্ভর নির্মাণ, সবুজ ও স্মার্ট ভবন, ঢাকার বাইরে উপশহরকেন্দ্রিক আবাসন এবং সরকারি–বেসরকারি সমন্বয় খাতটিকে আরও টেকসই করবে। আবাসন খাত শুধু ব্যবসায়িক নয়, দেশের অর্থনীতি ও সামাজিক স্থিতিশীলতার একটি শক্ত ভিত্তি হয়ে উঠবে বলে আমি বিশ্বাস করি।