স্থিতিশীলতা এসেছে সামষ্টিক অর্থনীতিতে, কিন্তু মানুষ ভালো আছে কী

গ্রাফিকস: প্রথম আলো

অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে দেশের অর্থনীতিতে যত সংস্কারের কথা বলা হয়েছে, তার মধ্যে কেবল ব্যাংকিং খাতে কিছু দৃশ্যমান হয়েছে। ডলারের বিনিময় হার স্থিতিশীল হয়েছে। রিজার্ভ বেড়েছে বা কেন্দ্রীয় ব্যাংককে বাজারে ডলার বিক্রি করতে হয়নি।

সেই সঙ্গে ব্যাংকিং খাতে নানা অনিয়ম দূর করার উদ্যোগ দৃশ্যমান। কিন্তু প্রবৃদ্ধির গতি কমে গেছে। এর মূল কারণ হলো অর্থনীতির প্রাণ বা বিনিয়োগের প্রবাহে টান পড়া। ফলে বেকারত্ব ও দারিদ্র্য বাড়ছে।

বিষয়টি হচ্ছে, বিনিয়োগ কমে যাওয়ার সরাসরি প্রভাব পড়ছে চাকরির বাজারে। নতুন কারখানা বা প্রকল্প না এলে কর্মসংস্থান বাড়ে না; বরং বিদ্যমান প্রতিষ্ঠানগুলো খরচ কমাতে গেলে ছাঁটাইয়ের ঝুঁকি তৈরি হয়। এতে সাধারণ মানুষের আয়ের উৎস সংকুচিত হচ্ছে। শেয়ারবাজারের বেশ কিছু কোম্পানি গত বছরের জন্য লভ্যাংশ দেয়নি। এই প্রবণতা দীর্ঘমেয়াদি হলে প্রবৃদ্ধি ও আয় বৃদ্ধির সম্ভাবনা কমিয়ে দেবে।

উল্টো দিকে কিছু ইতিবাচক দিকও আছে। ডলারের বাজারে স্থিতিশীলতা আসায় আমদানি ব্যয় নিয়ন্ত্রণে আসছে। ফলে ওষুধ, কাঁচামাল ও জ্বালানির সরবরাহে তুলনামূলক স্বস্তি এসেছে। মূল্যস্ফীতির হারও কমেছে, যদিও বাস্তবতা অতটা সরলরৈখিক নয়। সব মিলিয়ে পরিবর্তন যেটুকু হয়েছে তা মূলত ব্যবস্থাপনাগত; সংস্কার বলতে যা বোঝায়, অর্থনীতিতে সেরকম কিছু দেখা যাচ্ছে না।

আধুনিক সামষ্টিক অর্থনীতির পুরোধা হিসেবে পরিচিত জন মেনার্ড কেইনসের তত্ত্ব অনুযায়ী, বিনিয়োগই প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থানের প্রধান চালিকা শক্তি। যখন ব্যবসায়ীরা আস্থাহীন হয়ে বিনিয়োগ কমিয়ে দেন, তখন তার মাল্টিপ্লায়ার ইফেক্টের মাধ্যমে পুরো অর্থনীতিতে এর নেতিবাচক প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে। কম বিনিয়োগ মানে কম উৎপাদন, কম কর্মসংস্থান ও অবশেষে ভোগব্যয়ের সংকোচন। এর প্রভাব এরই মধ্যে শেয়ারবাজারে দেখা যাচ্ছে, ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা লভ্যাংশ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

এদিকে গত এপ্রিলে বাংলাদেশের ওপর প্রকাশিত প্রতিবেদনে শ্রমবাজারের করুণ চিত্র তুলে ধরে বিশ্বব্যাংক। সেখানে বলা হয়, দুর্বল আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, ব্যবসায়িক পরিবেশের অবনতি ও কর্মসংস্থানের সুযোগের অভাবের কারণে অনেকেই শ্রমবাজার থেকে সরে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। ফলে শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণের হারও কমে গেছে।

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর দেশে যত কারখানা বন্ধ হয়েছে, তাতে বিপুলসংখ্যক মানুষ কাজ হারিয়েছেন। সেই সঙ্গে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি কমে যাওয়ায় পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। প্রথম আলোর সংবাদেই উঠে এসেছে, গাজীপুরে কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে অনেক শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছেন। তাঁরা এখন সবজি বিক্রি করছেন।

চলতি বছর দেশে দারিদ্র্য বাড়বে বলে জানিয়েছে বিশ্ব ব্যাংক।
ছবি: প্রথম আলো

দারিদ্র্য ও কর্মসংস্থান

সম্প্রতি পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) গবেষণায় বলা হয়েছে, মানুষের বড় একটি অংশ পূর্ণাঙ্গ কর্মসংস্থানে যুক্ত নেই। এসব কর্মজীবীর প্রায় চারজনের মধ্যে একজন (৩৮ শতাংশ) পূর্ণ সময় (সপ্তাহে ৪০ ঘণ্টা) কাজ করছেন না। তাঁরা পছন্দমতো কাজ পাচ্ছেন না। তাঁরা হলেন আন্ডারএমপ্লয়েড বা ছদ্মবেকার।

আরেকটি উদ্বেগের বিষয় হলো, তিন বছরের বেশি সময় ধরে দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে। এ সময়ে ধারাবাহিকভাবে মানুষের মজুরি বৃদ্ধির হার মূল্যস্ফীতির চেয়ে কম ছিল। ২০২২ সালের এপ্রিল থেকে শুরু করে মূল্যস্ফীতির হার ধারাবাহিকভাবে মজুরি বৃদ্ধির হারকে ছাড়িয়ে গেছে। ফলে ভোক্তাদের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে এবং প্রকৃত আয় কমেছে। ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে যখন মূল্যস্ফীতি কমতে শুরু করে, তখন থেকে এই ব্যবধান কিছুটা কমতে থাকে।

আর এসব কিছুর সম্মিলিত ফল হলো, দারিদ্র্য বৃদ্ধি। বিশ্বব্যাংকের শঙ্কা, বাংলাদেশে এ বছর আরও ৩০ লাখ মানুষ ‘অতিদরিদ্র’ হবে। ফলে অতিদারিদ্র্যের হার বেড়ে ৯ দশমিক ৩ শতাংশ হবে। ২০২৪ সালে এই হার ছিল ৭ দশমিক ৭ শতাংশ। পিপিআরসির হিসাবে, গত মে মাসে দেশের দারিদ্র্যের হার দাঁড়িয়েছে প্রায় ২৮ শতাংশে। ২০২২ সালে সরকারি হিসাবে (পরিসংখ্যান ব্যুরোর খানা আয়–ব্যয় জরিপ) ছিল ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ।

প্রবৃদ্ধি কমে গেলে কী হয়

২০২৪–২৫ অর্থবছরে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ৪ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সাময়িক হিসাবে, চলতি অর্থবছরের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৩ দশমিক ৯৭ শতাংশ। ২০১৯–২০ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয় ৩ দশমিক ৫১ শতাংশ। কোভিডের সময়ের বিশেষ পরিস্থিতি বাদ দিলে গত দুই দশকের মধ্যে এত কম প্রবৃদ্ধি আর কোনো বছরে হয়নি।

বাস্তবতা হলো, প্রবৃদ্ধিকেন্দ্রিক উন্নয়ন ধারণার যত সমালোচনাই থাকুক না কেন, প্রবৃদ্ধি অর্থনীতির প্রাণশক্তি। যদিও শুধু প্রবৃদ্ধি দিয়ে বোঝা যায় না মানুষ ঠিক কেমন আছে। যখন অর্থনীতি দ্রুত বৃদ্ধি পায়, তখন নতুন কারখানা গড়ে ওঠে, ব্যবসার পরিধি বাড়ে ও কর্মসংস্থান তৈরি হয়। মানুষ চাকরি পায়, বেতন ও মজুরি বাড়ে। ফলে পরিবারের হাতে অতিরিক্ত অর্থ আসে। এই বাড়তি আয় দিয়ে তাঁরা বেশি পণ্য ও সেবা কেনেন, সন্তানদের পড়াশোনায় খরচ করেন ও চিকিৎসায় ব্যয় করেন। অর্থনীতিতে একধরনের ইতিবাচক চক্র চালু হয়। ফলে উন্নয়ন টেকসই হয়।

কিন্তু যখন প্রবৃদ্ধি কমে যায়, তখন এর প্রথম ধাক্কা লাগে কর্মসংস্থানে। বিনিয়োগ কমে যাওয়ায় নতুন শিল্প বা ব্যবসা আর তেমন তৈরি হয় না। কোম্পানিগুলো খরচ কমানোর জন্য নিয়োগ বন্ধ করে দেয়, কোথাও কোথাও ছাঁটাই শুরু হয়। এতে চাকরির বাজার সংকুচিত হয়। কাজ না থাকলে মানুষের হাতে আয় কমে আসে। যাঁরা চাকরি ধরে রাখতে পারেন, তাঁরাও বেতন বৃদ্ধির সুযোগ হারান। উচ্চ মূল্যস্ফীতি থাকলে তখন প্রকৃত আয় আরও কমে যায়।

আরও পড়ুন

ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী বা অনানুষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের গায়ে এই ধাক্কা সবচেয়ে বেশি লাগে। বাজারে চাহিদা কমে গেলে তাঁদের বিক্রি কমে যায়, আয় নেমে আসে। অন্যদিকে সমাজের ধনী ও সম্পদশালী শ্রেণি তুলনামূলকভাবে কম ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কেননা, তাঁদের যথেষ্ট সঞ্চয় ও বিনিয়োগযোগ্য অর্থ আছে। ফলে আয়–বৈষম্য বেড়ে যায়, গরিবেরা আরও গরিব হন আর ধনীরা টিকে থাকেন বা লাভবান হন।

এ অবস্থার দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব আরও গুরুতর। পরিবারগুলো যখন আয় কমে যাওয়ার কারণে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় কমিয়ে দেয়, তখন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ওপর প্রভাব পড়ে এবং মানবসম্পদ উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়। একই সঙ্গে ভোগব্যয় কমে যাওয়ায় সামগ্রিক চাহিদা কমে যায়। এতে আবার বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত হয়। ফলে অর্থনীতি একধরনের স্থবিরতার ফাঁদে পড়ে—আয় কমে যায়, বৈষম্য বাড়ে ও উন্নয়নের গতি থমকে দাঁড়ায়।

মূল্যস্ফীতি কতটা কমল

গত তিন বছরে দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে। ২০২৪–২৫ অর্থবছরে গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ। চলতি বছরের মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত টানা চার মাস মূল্যস্ফীতি কমেছে। জুলাইয়ে তা আবার বেড়েছে। সে মাসে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৮ দশমিক ৫৫ শতাংশ। গত জুনে এই হার ছিল ৮ দশমিক ৪৮ শতাংশ। কথা হলো, ৮ শতাংশ মূল্যস্ফীতিও কম নয়, বিশেষ করে যখন তার সঙ্গে দেশে বিনিয়োগ ও অর্থের প্রবাহ কমে যায়, তখন বিষয়টি প্রকট হয়ে ওঠে। আরও মনে রাখা দরকার, এই মূল্যফীতি কিন্তু উচ্চ ভিতের ওপর।

পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কায় মূল্যস্ফীতি কমলেও বাংলাদেশে কমছে না
গ্রাফিকস: প্রথম আলো

আশপাশের দেশগুলোর দিকে তাকানো যাক, ২০২২ সালে দেউলিয়া হওয়া শ্রীলঙ্কায় এখন মূল্যস্ফীতি অর্থাৎ নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে না; বরং কমছে। মূল্য সংকোচনের হার শূন্য দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ। চরম অর্থনৈতিক সংকটে পড়া পাকিস্তানে মূল্যস্ফীতি ছাড়িয়েছিল ২০২৩ সালে ৩৫ শতাংশ। সেটা এখন নেমেছে ৪ শতাংশের কাছাকাছি। অর্থাৎ শ্রীলঙ্কায় যেখানে দাম কমছে বা পাকিস্তানে ৩৫ থেকে ৪ শতাংমে নেমে এসেছে, সেখানে বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি এখনো সাড়ে ৮ শতাংশের বেশি।

ভারতে মূল্যস্ফীতি এখন একেবারেই কম, ১ দশমিক ৫৫ শতাংশ। নেপালেও তা–ই, ২ দশমিক ৭২ শতাংশ। অর্থাৎ দক্ষিণ এশিয়ার এসব দেশের তুলনায় বাংলাদেশের মানুষ খারাপ আছে।

আরেকটি বড় বিষয়, দেশে চালের দাম বাড়তি। সেই শীত মৌসুম থেকেই চালের দামে বাড়তি ধারা দেখা যাচ্ছে। আমাদের দেশের মানুষের খাদ্যতালিকায় ভাতের হিস্যা সম্প্রতি কয়েক বছরে তুলনায় এখনো যথেষ্ট বেশি, বিশেষ করে নিম্ন আয়ের মানুষের জীবনে। ফলে চালের দাম বেশি থাকলে তার প্রভাব অন্যান্য পণ্যের চেয়ে অনেক বেশি অনুভূত হয়। এদিকে বর্ষা মৌসুম শুরু হওয়ার পর থেকেই টানা বৃষ্টিতে সবজির দাম বাড়তি। সবজির চাহিদা কমে ডিমে চাপ পড়েছে। ফলে সেই ডিমের দামও বেড়ে গেছে। এতে নিম্ন আয়ের মানুষের কষ্ট বেড়েছে। মূল্যস্ফীতির হার কমে আসা নিয়ে সরকার যতই বড়াই করুক না কেন, মানুষের জীবনে কিন্তু তা অনুভূত হচ্ছে না। সেই সঙ্গে কমেছে আয়।

যখন আয় কমে যায় অর্থাৎ মানুষের হাতে নিট টাকা কম আসে, তখন তাঁদের ভোগের ক্ষমতা স্বাভাবিকভাবেই হ্রাস পায়। কম আয় মানে, মানুষ এখন অতিরিক্ত পণ্য বা সেবা কিনতে পারেন না। ফলে বাজারে চাহিদা কমে আসে।

যদি সেই সময়ে মূল্যস্ফীতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে থাকে বা ধীরে ধীরে কমে আসে, তাহলে খুচরা ও নিত্যপণ্যের দাম আগের চেয়ে কমে বা স্থিতিশীল থাকে। এটি কিছুটা স্বস্তি দেয়। তবে এই স্বস্তি সীমিত। আয় কমার কারণে মানুষ বড় ব্যয়, যেমন শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সংকোচন করতে বাধ্য। অর্থাৎ মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমলেও আয় কম হওয়ায় ক্রয়ক্ষমতা সীমিত থাকে এবং অর্থনীতির সামগ্রিক চাহিদা পুরোপুরি ঠিক থাকে না। আমাদের বাস্তবতা হচ্ছে, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম কিন্তু সেই অর্থে কমেনি।

মূলধনি পণ্য আমদানি কমেছে

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুসারে, ২০২৪–২৫ অর্থবছরে দেশে মোট ৬৮ দশমিক ৩৫ বিলিয়ন বা ৬ হাজার ৮৩৫ কোটি মার্কিন ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছে। আগের ২০২৩–২৪ অর্থবছরের চেয়ে যা ২ দশমিক ৪ শতাংশ বেশি। কিন্তু উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, এই সময় মূলধনি পণ্য আমদানি কমেছে ১০ দশমিক ২ শতাংশ। এর মধ্যে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি কমেছে ১৯ দশমিক ১ শতাংশ আর অন্যান্য মূলধনি পণ্য আমদানি কমেছে ৫ দশমিক ৯ শতাংশ। এ ছাড়া আমদানি কমার তালিকায় রয়েছে সিমেন্টের কাঁচামাল ক্লিংকার। এর আমদানি কমেছে ৭ শতাংশ। অর্থাৎ শিল্প ও নির্মাণের উপকরণ আমদানি কমেছে।

এই সময় আমদানি প্রবৃদ্ধি সবচেয়ে বেশি চালের ক্ষেত্রে। ২০২৩–২৪ অর্থবছরে দেশে চাল আমদানি হয়েছে ২ কোটি ৫৪ লাখ ডলারের। ২০২৪–২৫ অর্থবছরে আমদানি হয়েছে ৬৮ কোটি ২৪ লাখ ডলারের। এই সময় অর্থমূল্যে চালের আমদানি বেড়েছে ২ হাজার ৫৮৬ শতাংশ। সামগ্রিকভাবে আমদানি বৃদ্ধির এটি বড় কারণ।

শিল্প কারখানার জন্য মূলধনী পণ্য আমদানি কমেছে অনেকটাই।
ফাইল ছবি

মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি কমে গেলে উৎপাদন বাড়ানো ও আধুনিকীকরণ ব্যাহত হয়। নতুন যন্ত্র বা প্রযুক্তি না আসায় শিল্পপ্রতিষ্ঠান তাদের ক্ষমতা পূর্ণভাবে ব্যবহার করতে পারে না। ফলে উৎপাদন হ্রাস পায়, নতুন বিনিয়োগ কমে যায় ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির গতিও কমে যায়। শ্রমিকের আয় বৃদ্ধির হার কমে যায়। তাঁদের ক্রয়ক্ষমতা কমে এবং মধ্যবিত্ত ও নিম্ন আয়ের মানুষের জীবনযাত্রায় প্রভাব পড়ে। প্রযুক্তিগত উন্নয়ন থমকে যায়, বিদেশি বাজারে প্রতিযোগিতার সক্ষমতা কমে যায়। সামগ্রিকভাবে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি কমে যাওয়া দেশের দীর্ঘমেয়াদি প্রবৃদ্ধি ও আয়ের ধারাকে বাধাগ্রস্ত করে।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক সেলিম রায়হান বলেন, সামষ্টিক অর্থনীতিতে একধরনের স্থিতিশীলতা এসেছে। যে ধস হওয়ার আশঙ্কা ছিল আগের সরকারের আমলে, তা ঠেকানো গেছে। কিন্তু এটি নিম্নমুখী স্থিতিশীলতা। এই স্থিতিশীলতার কারণ হচ্ছে, চাহিদা সৃষ্টি হচ্ছে না বা চাপ কমে গেছে। এই পরিস্থিতিতে তেমন একটা উৎসাহিত বা আশাবাদী হওয়ার কারণ নেই।

ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ নিয়ে বিশেষভাবে উদ্বেগ প্রকাশ করেন সেলিম রায়হান। তিনি বলেন, এ ক্ষেত্রে পরিস্থিতি অত্যন্ত খারাপ। জানুয়ারি–মার্চ প্রান্তিকে এফডিআইয়ের প্রবাহ বাড়লেও তা বড় পরিবর্তন নয় বলেই মনে করেন তিনি। এ ছাড়া নতুন এফডিআই তেমন একটা আসেনি, যা এসেছে তা মূলত পুনর্বিনিয়োগ। এই মুহূর্তে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি না হলে বিনিয়োগে গতি আসবে না।

সবজির দাম বেড়েছে সম্প্রতি
ছবি: প্রথম আলো

সম্প্রতি সবজি, ডিম ও চালের মূল্যবৃদ্ধিতে উদ্বেগ প্রকাশ করেন সেলিম রায়হান। তিনি বলেন, একদিকে দারিদ্র্যের হার বৃদ্ধি, বেকারত্ব বৃদ্ধি, প্রবৃদ্ধির গতি কমে যাওয়া ও মূল্যস্ফীতির চাপ—সব মিলিয়ে সাধারণ মানুষ ভালো নেই বলেই মনে করেন।

মোদ্দাকথা হলো, বিনিয়োগ হচ্ছে অর্থনীতির প্রাণ। বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অপরিহার্য। সরকারের নীতি ও আইন যদি দীর্ঘ মেয়াদে স্থিতিশীল থাকে, তাহলে ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারীরা নতুন প্রকল্প শুরু করতে উৎসাহিত হন। কিন্তু রাজনৈতিক অস্থিরতা বা হঠাৎ নীতি পরিবর্তনের কারণে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়। ফলে নতুন শিল্প, ব্যবসা ও উৎপাদন সম্প্রসারণের পরিকল্পনা বিলম্বিত হয়।

রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা শুধু আইন ও নিয়মের ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করে না; বরং কর্মসংস্থান ও আয় বৃদ্ধিতেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। বিনিয়োগকারীরা তখন দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করতে পারেন, নতুন প্রযুক্তি ও মূলধনি যন্ত্রপাতিতে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হন। এখন নির্বাচন ছাড়া এই স্থিতিশীলতা ফেরানো সম্ভব নয়।