ইইউর নতুন বিধানটি আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জের সঙ্গে সুযোগও

মোস্তাফিজ উদ্দিন, প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, বাংলাদেশ অ্যাপারেল এক্সচেঞ্জ (বিএই)
ছবি: সংগৃহীত

ইউরোপীয় পার্লামেন্ট করপোরেট সাসটেইনেবিলিটি ডিউ ডিলিজেন্স ডিরেকটিভ বা সিএসডিডিডি নামের বিধানটি অনুমোদন করেছে। এর মধ্য দিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) এটি আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহণের দিকে এক ধাপ এগিয়ে গেছে। এটি বিশ্বব্যাপী সরবরাহব্যবস্থায় পরিবেশগত ও মানবাধিকার লঙ্ঘনসংক্রান্ত বিষয়ে কোম্পানিগুলোর জন্য একটি আইনি দায়বদ্ধতা তৈরি করবে।

সিএসডিডিডি নিয়ে পশ্চিমা বিশ্বের গণমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা হয়েছে। বিশেষ করে শুরুর দিকে যেসব প্রস্তাব ছিল, তা থেকে কিছুটা সরে এসেছে সিএসডিডিডি। অর্থাৎ শেষ পর্যন্ত অনেক কিছুই কম গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা বা শিথিলভাবে দেখা হতে পারে, এমন শঙ্কাও প্রকাশ করছে গণমাধ্যমগুলো। যাহোক, কী আছে এই নতুন বিধানে? তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে, এটি বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্পে কী প্রভাব ফেলবে?

সহজ ভাষায় বলতে গেলে সিএসডিডিডি আসলে ইইউর একটি উদ্যোগ, যার মূল উদ্দেশ্য হলো, তৈরি পোশাকসহ বিভিন্ন শিল্পে টেকসই ব্যবসায়িক চর্চা নিশ্চিত করা। বিধানটি করপোরেট জবাবদিহি নিশ্চিত করার জন্য একটি বৃহত্তর কৌশলের অংশ। যাতে কোম্পানিগুলো কেবল মুনাফা অর্জনের চেষ্টা না করে বরং তাদের ব্যবসা পরিচালনার পরিবেশগত ও সামাজিক প্রভাবগুলো গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করবে।

সিএসডিডিডির মূলে রয়েছে, ইইউর মধ্যে পরিচালিত বিভিন্ন বড় কোম্পানিকে মানবাধিকার ও পরিবেশের ওপর তাদের কার্যক্রমে নেতিবাচক প্রভাবগুলো শনাক্ত, প্রতিরোধ ও প্রশমিত করার সক্রিয় পদক্ষেপ গ্রহণে বাধ্য করার পাশাপাশি জবাবদিহি নিশ্চিত করা। বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের তাদের ব্যবসা টেকসই করাসংক্রান্ত কর্মপ্রচেষ্টায় প্রতিক্রিয়াশীল বা কেবল বিদ্যমান নিয়মগুলোর সঙ্গে সামঞ্জস্য স্থাপন ও প্রতিপালন না করে বরং সক্রিয় হওয়া উচিত। এই নীতির ভিত্তিতে বিধানটি প্রণয়ন করা হয়েছে।

এই বিধানের বেশ কয়েকটি ক্ষেত্র রয়েছে। নিয়মকানুন অনুসরণের মাধ্যমে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানকে তার নিজস্ব ব্যবসায়িক কার্যক্রম, সরবরাহব্যবস্থা ও ব্যবসায়িক অংশীদারদের মধ্যে প্রকৃত ও সম্ভাব্য ক্ষতিকর প্রভাব শনাক্ত করার পাশাপাশি প্রয়োজন অনুযায়ী প্রতিরোধ, প্রশমন ও প্রতিকারের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। অর্থাৎ পণ্যগুলো কীভাবে তৈরি করা হয়, পণ্য তৈরির উপাদানসমূহ কোথা থেকে সংগ্রহ করা হয়, কারখানার কর্মপরিবেশ কেমন ইত্যাদি বিষয়ের দিকে নজর দেওয়া। কাজেই এসব বিষয় আমাদের পোশাকশিল্পের উদ্যোক্তাদের ওপর সুস্পষ্ট প্রভাব ফেলবে, বিশেষ করে আমি বলব পোশাকশ্রমিকদের অধিকারসংক্রান্ত বিষয়ে।

নতুন বিধানটির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে, স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা। ইইউর ডিউ ডিলিজেন্স ডিরেকটিভের অর্থ হচ্ছে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানকে অবশ্যই তাদের নিয়ম–নীতির আলোকে গৃহীত কর্মপ্রচেষ্টা, ব্যবসায়িক কার্যক্রমে প্রকৃত ও সম্ভাব্য ক্ষতিকর প্রভাব শনাক্ত করা এবং প্রয়োজন অনুযায়ী প্রতিরোধ, প্রশমন ও প্রতিকারের কী ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে, তা আনুষ্ঠানিকভাবে রিপোর্ট করতে হবে। এই রিপোর্টিং একটি প্রতিষ্ঠানের সাসটেইনেবিলিটি বা টেকসই চর্চা সম্পর্কে ভোক্তা, বিনিয়োগকারীসহ সব অংশীজনকে অবগত করাও নিশ্চিত করে। এখানে মূল বিষয় হলো বৃহত্তর স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হলে ফ্যাশন ব্র্যান্ডকে সরবরাহকারীর সঙ্গে আরও সম্পৃক্ত হতে হবে। তবে তার মানে হলো, উৎপাদনকারীদের নতুন নতুন নিরীক্ষা বা অডিটের মুখোমুখি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

সরবরাহব্যবস্থার অংশীজনদের মধ্যে সম্পৃক্ততা হলো, সিএসডিডিডির আরেকটি দিক। নতুন এই বিধানের আওতায় সম্ভাব্য ক্ষতিগ্রস্ত গোষ্ঠী ও অন্যান্য অংশীজনদের সঙ্গে সংযুক্ত হওয়া অপরিহার্য। অর্থাৎ একটি প্রতিষ্ঠানের ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনার বাস্তবিক প্রভাব সম্পর্কে ভালোভাবে জানতে স্থানীয় সম্প্রদায়, শ্রমিক ও বেসরকারি সংস্থাগুলোর সঙ্গে আলোচনা করতে হবে।

যদি একটি প্রতিষ্ঠান দেখে যে তার ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করছে, তাহলে তাকে অবশ্যই সেটি প্রতিকারে সহায়তা প্রদান করতে হবে। এটি হতে পারে পরিবেশগত ক্ষয়ক্ষতির জন্য ক্ষতিপূরণ অথবা কারখানায় কর্মপরিবেশের অবস্থার উন্নতিসংক্রান্ত। আগে প্রতিকারের বিষয়টি সরবরাহব্যবস্থার ওপর ছেড়ে দেওয়া হতো। এখন দেখার বিষয়, সিএসডিডিডির অধীনে প্রতিকারের বিষয়টি কীভাবে কার্যকর করা হবে।

আমরা জানি, মাত্রাতিরিক্ত পানি ব্যবহার ও পরিবেশদূষণ থেকে শুরু করে সরবরাহব্যবস্থায় শ্রম অধিকার লঙ্ঘনসহ বাংলাদেশের পোশাকশিল্পে ব্যবসায়িক কার্যক্রমে পরিবেশগত ও সামাজিক প্রভাব নিয়ে ইতিমধ্যে অনেক যাচাই-বাছাই হয়েছে। এতে আমার কাছে সুস্পষ্টভাবে মনে হচ্ছে যে ইইউর নতুন বিধান বিভিন্নভাবে পোশাক উৎপাদনকারীদের উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাবিত করতে পারে। এর মধ্যে প্রথমটি হলো, সরবরাহব্যবস্থায় নিরীক্ষা। পোশাক উৎপাদনকারীদের কাঁচামাল সংগ্রহ থেকে শুরু করে চূড়ান্ত পণ্য প্রস্তুতকরণ পর্যন্ত তাঁদের সম্পূর্ণ সরবরাহব্যবস্থা সম্পর্কে পুঙ্খানুপুঙ্খ ধারণা থাকতে হবে। এর মধ্যে রয়েছে, সরবরাহব্যবস্থায় প্রতিটি জায়গায় পরিবেশগত মানদণ্ড মানা হয়েছে কি না এবং শ্রমিকদের অধিকারকে সমুন্নত রাখা হয়েছে কি না, তা নিশ্চিত করা।

উদাহরণস্বরূপ উৎপাদনকারীদের এমন সরবরাহকারীদের কাছে যেতে হবে যাঁরা টেকসই উপকরণ ব্যবহার করেন বা ন্যায্য শ্রমচর্চা নিশ্চিত করেন। নিয়ম–নীতি বাস্তবায়নের ফলে ব্যয় বৃদ্ধির সম্ভাবনা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যথাযথ নিয়ম–নীতি বাস্তবায়নে খরচ বাড়তে পারে। উন্নততর সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমে বিনিয়োগ, নতুন নিরীক্ষা এবং সম্ভাব্য উচ্চ মূল্যে টেকসই উৎস থেকে উপকরণ ক্রয়ের কারণে পোশাক উৎপাদনকারীরা ব্যবসা পরিচালনায় ব্যয় বৃদ্ধির পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে পারেন। এই ব্যয় বৃদ্ধি পণ্যে মূল্য নির্ধারণের কৌশল আর মুনাফার মার্জিনকেও প্রভাবিত করতে পারে।

অন্যদিকে, সিএসডিডিডি মেনে ব্যবসা পরিচালনা কিছু সরবরাহকারীর জন্য প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা হতে পারে। বর্তমানে ভোক্তারা পণ্য উৎপাদনে পরিবেশগত ও সামাজিক প্রভাব সম্পর্কে ক্রমেই সচেতন হচ্ছেন। ফলে যেসব ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান সাসটেইনিবিলিটি বা টেকসই চর্চার করবে, তারা আরও বেশি ক্রেতা পাবে। এটি কিছু সরবরাহকারীর জন্য একটি সুযোগ হতে পারে। আমরা ইতিমধ্যে দেখছি যে ব্র্যান্ডগুলো প্রগতিশীল ও দায়িত্বশীল পোশাক প্রস্তুতকারকদের সঙ্গে ব্যবসা বৃদ্ধি করছে।

এই নতুন বিধান পোশাকশিল্পে উদ্ভাবনকে উৎসাহিত করতে পারে। এর ফলে উৎপাদনকারীরা উৎপাদনপ্রক্রিয়ায় নতুন প্রযুক্তি বিনিয়োগ করতে পারে, যেমন পানি পুনর্ব্যবহারযোগ্য করে তোলা কিংবা জ্বালানিসাশ্রয়ী প্রযুক্তির ব্যবহার। এটি ব্যবসা পরিচালনার পরিবেশগত নেতিবাচক প্রভাবগুলো হ্রাস করতেও সাহায্য করবে।

আমাদের তৈরি পোশাকের বৃহত্তম গন্তব্য ইইউর বাজারে প্রবেশের জন্য সিএসডিডিডির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ব্যবসা পরিচালনা করা অপরিহার্য হতে চলেছে। ইইউর এই বিধান মানা না হলে জরিমানা, বাজারে প্রবেশে বিধিনিষেধসহ আইনি ঝুঁকির সম্মুখীন হওয়ার আশঙ্কা থাকবে। ফলে আমাদের পোশাক কারখানার মালিকদের এ ধরনের ঝুঁকি এড়াতে ব্যবসায়িক চর্চার মধ্যে ইইউর নতুন বিধান নিয়ে আসতে হবে।

বড় পরিসরে নতুন বিধানটি ইইউতে আরও টেকসই ও দায়িত্বশীল করপোরেট চর্চা নিশ্চিতকরণে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এর মানে হলো, পোশাক প্রস্তুতকারকদের শুধু নতুন নিয়ম–নীতি মেনে চলার নয়; এটি তাদের বিভিন্ন ব্যবসায়িক মডেলকে নতুন করে সংজ্ঞায়িত করা, ব্যবসায় উদ্ভাবন ও টেকসই চর্চার দিকে ধিকে ধাবিত হওয়ার একটি সুযোগ।

এই পরিবর্তন চ্যালেঞ্জিং ও ব্যয়বহুল হতে পারে। তবে একটি টেকসই শিল্প গড়ে তোলার দীর্ঘমেয়াদি সুবিধাগুলো প্রাথমিক বিনিয়োগের চেয়ে বেশি। এটি শুধু ব্যবসায় মুনাফার দৃষ্টিকোণ থেকে নয় বরং সমাজ ও পরিবেশে ইতিবাচকভাবে অবদান রাখার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।

লেখক: মোস্তাফিজ উদ্দিন, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ডেনিম এক্সপার্ট লিমিটেড এবং প্রতিষ্ঠাতা, বাংলাদেশ অ্যাপারেল এক্সচেঞ্জ