পাল্টা শুল্কে তৈরি পোশাক, ব্যাংক, কর্মসংস্থান-সব ক্ষতিগ্রস্ত হবে: শোভন ইসলাম

যুক্তরাষ্ট্রের নতুন করে আরোপ করা ৩৫ শতাংশ পাল্টা শুল্ক আগামী ১ আগস্ট থেকে কার্যকর হতে পারে। এ অবস্থায় দেশ থেকে তৈরি পোশাকের অনেক রপ্তানি ক্রয়াদেশ স্থগিত বা বাতিল হচ্ছে। সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন স্প্যারো গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক শোভন ইসলাম। তাঁর প্রতিষ্ঠানটি মূলত যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে পোশাক রপ্তানি করে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শফিকুল ইসলাম

প্রথম আলো:

যুক্তরাষ্ট্রে ৩৫ শতাংশ পাল্টা শুল্ক (রেসিপ্রোক্যাল ট্যারিফ) ১ আগস্ট থেকে কার্যকর হওয়ার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। এর প্রভাব কী হতে পারে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতে?

শোভন ইসলাম: যদি ৩৫ শতাংশ পাল্টা শুল্ক শেষ পর্যন্ত কার্যকর হয়, তাহলে সেটি আমাদের জন্য চরম ধাক্কা হবে। আমাদের বিদ্যমান শুল্কের ট্যারিফ, সেটা তো ১৬ থেকে সাড়ে ১৬ শতাংশ। এর সঙ্গে যদি ৩৫ শতাংশ যোগ হয়, তাহলে মোট ট্যারিফ দাঁড়ায় ৫১ শতাংশ। এই হারে ব্যবসা চালানো কার্যত অসম্ভব হয়ে যাবে।

উচ্চ হারে শুল্কের মূল চাপটা পড়বে এজেন্ট ও বায়িং হাউসগুলোর ওপরে। কারণ, ক্রেতারা ৩০–৪০ শতাংশ পণ্যের ক্রয়াদেশ তাদের মাধ্যমে নেয়। ফলে এজেন্ট ও বায়িং হাউসগুলো নিজেরাই শুল্কের অর্থ পরিশোধ করে। সব মিলিয়ে তাদের ১০ শতাংশ হারে মুনাফা থাকে। এখন ৫০ শতাংশ শুল্ক কার্যকর হলে তা সামাল দেওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব হবে না। অন্যদিকে সরাসরি ক্রেতাদের কাছ থেকে পাওয়া ক্রয়াদেশ বাতিল না হলেও তার পরিমাণ কমে যেতে পারে।

ইতিমধ্যে ক্রয়াদেশ স্থগিত ও বাতিলের কিছু তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। অনেক এজেন্ট পণ্য জাহাজিকরণ স্থগিত রাখার জন্য আমাদের জানাচ্ছেন। সব মিলিয়ে আমি বলব, যদি বিদ্যমান সংকটের দ্রুত সমাধান করতে না পারি, তাহলে আমরা একটি ভয়াবহ থেকে ভয়াবহতর পরিস্থিতির দিকে যাব।

প্রথম আলো:

যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দর–কষাকষির যে আলোচনা চলছে, সেটি যথেষ্ট কি না?

শোভন ইসলাম: আমি এটিকে যথেষ্ট মনে করি না। পুরো বিষয়টি স্পষ্টও না। আমাদের উচিত ছিল যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি স্পষ্ট ও শক্ত অবস্থান নেওয়া। যেমনটা ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, শ্রীলঙ্কা প্রভৃতি দেশ করেছে। তারা কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের অনুকূলে সুতা, এলএনজি, খাদ্যপণ্য প্রভৃতি কেনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। বাংলাদেশও এসব প্রতিশ্রুতি দিতে পারত। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়েছে, বাংলাদেশ এখনো কোনো জোরালো প্রতিশ্রুতি দেয়নি।

অবশ্যই যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য রয়েছে। তারা একটি বার্তা দিতে চায়, বিশ্ববাসীকে দেখাতে চায় যে তারা কিছু অর্জন করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের এই মানসিকতা আমাদের বোঝা দরকার। ফলে কিছু বিষয়ে তাদের স্বার্থ অগ্রাধিকার দেওয়া যেতে পারে। উপরন্তু বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত আজকে যে পর্যায়ে এসেছে এর পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের বড় অবদান রয়েছে। সেটিও মনে রাখা উচিত।

প্রথম আলো:

দেশের তৈরি পোশাক খাতের জন্য যদি মার্কিন বাজার সংকুচিত হয়, তাহলে ভবিষ্যৎটা কেমন হবে?

শোভন ইসলাম: ভয়াবহ হবে। ইউরোপের বাজারে আমাদের প্রবৃদ্ধি থেমে গেছে। উল্টো যুক্তরাষ্ট্রের বাজারেই আমাদের প্রবৃদ্ধি ছিল। আমাদের সবচেয়ে সম্ভাবনার এই বাজারে ইতিমধ্যে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি দেখা যাচ্ছে। আমরা যদি এই বাজার হারাই, তাহলে আমাদের কারখানার সক্ষমতা ২০-৩০ শতাংশ কমাতে হবে। এটি শেষ পর্যন্ত আমাদের তৈরি পোশাক খাত, ব্যাংকিং খাত, কর্মসংস্থান—সবকিছুকে একত্রে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।

বৃহত্তর দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, উচ্চ হারে যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক অব্যাহত থাকলে এই অঞ্চল থেকেই তৈরি পোশাক শিল্পের ৩০-৪০ শতাংশ অন্যত্র চলে যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে শুধু ভারত বা ভিয়েতনাম না, অর্ডার চলে যাবে জর্ডান, কেনিয়া, মিসরের মতো দেশেও। আমরা আমাদের তৈরি পোশাক খাতই হারিয়ে ফেলব।

যা হোক, শেষ পর্যন্ত শুল্ক কমানো না গেলে আমাদের তৈরি পোশাক খাত মুখ থুবড়ে পড়বে; ব্যাংক খাত মুখ থুবড়ে পড়বে। তাতে দেশের অর্থনীতিতে যে ধস নামবে সেটা আমরা এখন কল্পনাও করতে পারছি না।

প্রথম আলো:

এই সংকট নিরসনে আপনার প্রস্তাব কী?

শোভন ইসলাম: আমাদের অবশ্যই পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুধাবন করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আমার অনুরোধ থাকবে—প্রধান উপদেষ্টা নিজে যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে বিষয়টি সমাধানের উদ্যোগ নিতে পারেন। তিনি যদি যান, তাহলে হয়তো এই জট খুলে যাবে। এটা জাতীয় সংকট—আমাদের যেকোনো মূল্যে এই সংকট কাটাতে হবে।

যদিও এখন পর্যন্ত চীন, ভারত ও পাকিস্তানের জন্য চূড়ান্ত শুল্কের হার যুক্তরাষ্ট্র প্রকাশ করেনি। তবে যেটা আভাস পাওয়া যাচ্ছে, তাতে ভারতে ১৫ থেকে ২০ শতাংশের মধ্যে পাল্টা শুল্ক থাকবে। পাকিস্তানও অনেক কম হার থাকতে পারে। কারণ, পাকিস্তান দীর্ঘদিন ধরে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র। সম্প্রতি দেশটি নোবেল পুরস্কারের জন্য ডোনাল্ড ট্রাম্পের নাম প্রস্তাব করেছে। কাজেই আমাদের উচিত হবে প্রতিবেশী এই দেশগুলোর সমতুল্য পর্যায়ে যেন শুল্কহার রাখা যায়, সেই চেষ্টা করা।

আমাদের হাতে সময় খুবই সীমিত। এখনই যদি কার্যকর ও পরিপূর্ণ কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক উদ্যোগ না নেই, তাহলে আমরা মার্কিন বাজার হারিয়ে ফেলব। এটা শুধু একটি খাতের সংকট না, এটা জাতীয় অর্থনীতির অস্তিত্বের প্রশ্ন।