দেশের কর-জিডিপির অনুপাত অনেক দিন ধরেই কম, এ নিয়ে অনেক আলাপ-আলোচনা হয়েছে; কিন্তু সরকার তা বাড়ানোর দুরূহ পথে না গিয়ে সহজ পথে হাঁটল। পরোক্ষ কর ধনী-গরিব সবার জন্যই সমান। পরোক্ষ কর বাড়লে ধনীদের সমস্যা হয় না, সমস্যা হয় গরিবদের। এতে অসমতা আরও বাড়বে।
অর্থ বছরের মাঝামাঝি সময় হঠাৎ করে এভাবে ভ্যাট বাড়ানোর সিদ্ধান্তে কিছুটা বিস্মিত হয়েছি। এমনিতেই উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এই সময় পরোক্ষ কর বাড়ানোর সিদ্ধান্ত কতটা খতিয়ে দেখা হয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্নের অবকাশ থেকে যায়। কারণ এতে মানুষের ভোগ কমে যেতে পারে, তখন এই ভ্যাট বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত থেকে কাঙ্ক্ষিত ফল আসবে না। অর্থাৎ কাঙ্ক্ষিত পরিমাণে রাজস্ব আদায় নাও হতে পারে।
সামগ্রিকভাবে আমার মনে হচ্ছে, সরকার রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সংস্কারের বিষয় ও বিতর্ক নিয়ে যতটা জড়িয়ে গেছে এবং অগ্রাধিকার দিচ্ছে, অর্থনৈতিক সংস্কারে ততটা দিচ্ছে না। সে কারণে অর্থনীতিতে সমন্বিত উদ্যোগ চোখে পড়ছে না। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে একদিকে যখন বাংলাদেশ ব্যাংক নীতি সুদহার বাড়িয়ে যাচ্ছে, অথচ অন্যদিকে এনবিআরও ভ্যাট বাড়াচ্ছে। অথচ সমন্বয় থাকলে কিছু ক্ষেত্রে উল্টো কর হ্রাসের কথা ছিল। এই বাস্তবতায় বলতে হয়, বিদ্যমান মূল্যস্ফীতির মতো জটিল সমস্যা সমাধানে শক্তিশালী অর্থনৈতিক নেতৃত্ব চোখে পড়ছে না। এই বাস্তবতায় আমার আশঙ্কা, অর্থনৈতিক সংস্কারের বিষয়গুলো ধামাচাপা পড়ে যায় কি না।
কর সংস্কারের কথা আমরা ধারাবাহিকভাবে বলে আসছি। কিন্তু কীভাবে তা করা হবে, সেটাই মূল কথা। ধনীদের কর বাড়ানো থেকে শুরু করে কর ফাঁকি রোধ ও অর্থ পাচার রোধ করে এই সংস্কার করতে হবে। যেসব সংস্কারের কথা বললাম, সেগুলো বাস্তবায়ন করতে কঠিন পথে হাঁটতে হবে। শুধু পরোক্ষ কর বাড়ানোর মতো সহজ পথে হাঁটলে গভীর সমস্যার সমাধান হবে না। তাই প্রয়োজন করের আওতা বাড়ানো, কর খাতে দুর্নীতি রোধ করা এবং কর ব্যবস্থার আধুনিকায়ন।
গভীর সংস্কারের লক্ষ্যে যে পরিবেশ থাকা দরকার, অর্থাৎ আমলাতন্ত্র, ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক শক্তি সহ সব অংশীজনের যেভাবে অংশগ্রহণ দরকার, সেই বাস্তবতার ক্ষেত্রে এখন অনেক চ্যালেঞ্জ। আমলাতন্ত্রে যে অস্থিরতা দেখা যাচ্ছে তা নতুন সমস্যা সৃষ্টি করছে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নে। কিন্তু তারপরও ভ্যাট বাড়ানোর মতো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সরকারের ভেবে দেখা দরকার, কী করলে কী হবে, এবং এ ব্যাপারে বিস্তারিত হোমওয়ার্ক থাকা দরকার।
নানা কারণে বেশ কিছু বড় কারখানার উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। যেসব কারখানা বন্ধ হয়েছে সেগুলোর মালিকেরা সাবেক সরকারের ঘনিষ্ঠজন ঠিক আছে, কিন্তু ব্যবসা বা উৎপাদন বন্ধ করা কাজের কথা নয়। এতে অনেক মানুষ বেকার হচ্ছেন। ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ কমে যাচ্ছে। সুদহার বাড়ানো হয়েছে, সেই সঙ্গে আছে অনিশ্চয়তা ও অস্থিতিশীলতা-এই বাস্তবতায় নতুন ব্যবসা বা ব্যবসার সম্প্রসারণ ব্যাহত হচ্ছে। বিনিয়োগ পরিস্থিতির উন্নতি না হলে এবং প্রবৃদ্ধি সংকুচিত হলে সামগ্রিকভাবে সরকারের রাজস্ব আয় কমে যাবে। কিন্তু এসব ক্ষতি পূরণ করতে সরকার ভ্যাট বা পরোক্ষ কর হঠাৎ করে বাড়াতে পারে না। এই মুহূর্তে তার এমন কিছু করা ঠিক নয়, যার কারণে মূল্যস্ফীতির ওপর আবার নতুন এক চাপ সৃষ্টি হবে।
অথচ ভ্যাট বা পরোক্ষ কর বৃদ্ধির কারণে মূল্যস্ফীতির হার আরও বেড়ে গেলে নিম্নআয়ের মানুষকে স্বস্তি দিতে সরকার যে ব্যবস্থা নেবে, সেরকম কিছু দেখা যাচ্ছে না। সংকটের সমাধান করতে হবে। কিন্তু এ লক্ষ্যে যে সমন্বিত ও সুস্পষ্ট উদ্যোগ থাকা দরকার, তা দৃশ্যমান নয়।
সেলিম রায়হান: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক।