সরকারি চাকরি না করার আক্ষেপ কি বাড়তেই থাকবে

ফাইল ছবি

প্রায় দেড় বছর ধরে চলা উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছেন সীমিত আয়ের মানুষেরা। এই বাস্তবতায় বিশ্বের অনেক দেশেই সীমিত আয়ের মানুষের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা (জ্বালানি ভর্তুকি, খাদ্যসহায়তা) করা হলেও বাংলাদেশে ট্রাকে করে কম দামে কিছু পণ্য বিক্রি এবং পরে প্রতি মাসে পারিবারিক কার্ডধারীদের কিছু কিছু পণ্য দেওয়া ছাড়া সরকার আর কোনো ব্যবস্থা নেয়নি বললেই চলে।

সম্প্রতি খবর ছড়িয়ে পড়ে যে সরকারি কর্মচারীদের মহার্ঘ ভাতা দেওয়ার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। কিন্তু শেষমেশ জানা গেল, সরকারি কর্মচারীদের মহার্ঘ ভাতা দেওয়া হবে না, তবে মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে তাঁদের বেতন বাড়বে। সরকারের পক্ষে থেকে আরও বলা হলো, বেসরকারি খাতের বেতন বৃদ্ধির বিষয়ে সরকারের কিছু করণীয় নেই। কারণ, সেটা সরকারের বিষয় নয়।

এই পরিস্থিতিতে বেসরকারি খাতের কর্মীদের মধ্যে আক্ষেপ বাড়ছে। অনেকেই দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলেন, ‘ইশ্‌, কেন যে সরকারি চাকরি করলাম না।’ এই আক্ষেপের অবসান কবে হবে, তার কূলকিনারা অন্তত এখনো দেখা যাচ্ছে না।

এটা ঠিক, বেসরকারি খাতের বেতন বৃদ্ধি করা সরকারের সরাসরি কাজ নয়, কিন্তু এই খাতের বেতন-ভাতা ন্যূনতম কত হবে, সে বিষয়ে অনেক দেশেই সরকারের দিকনির্দেশনা থাকে। সেটা মানা হচ্ছে কি না, তা–ও সরকার দেখে। আবার বাজারব্যবস্থা একেবারে স্বাধীন হতে পারে না, তার ওপর সরকারের একধরনের নিয়ন্ত্রণ সবখানেই থাকে।

উন্নত দেশে বেসরকারি খাতে মজুরি নির্ধারণে সরকারের ভূমিকা আছে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে যুক্তরাজ্যে গবেষণারত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক মাহতাব উদ্দিন বলেন, এর উত্তর একই সঙ্গে হ্যাঁ ও না। হ্যাঁ, কারণ সরকার ন্যূনতম মজুরি ঠিক করে দেয়। এ ছাড়া ট্রেন, বাস ও মেট্রো কোম্পানিকে ভর্তুকি দেয় এবং বিভিন্ন খাতে কর্মরত কর্মীদের বাধ্যতামূলক সবেতন ছুটি ও পেনশন নিশ্চিত করে। সেই অর্থে সরকার সেখানে পরোক্ষভাবে কর্মীদের মজুরি বা বেতন ও অন্যান্য সুবিধা নিশ্চিত করে।

উত্তর আবার না এ কারণে যে একটি কোম্পানি ঠিক কত বেতন বা মজুরি দেবে, সরকার তা সরাসরি নির্ধারণ করে দেয় না। তা নির্ভর করে সেই কোম্পানির ওপর। কিন্তু তা কোনোভাবেই ন্যূনতম মজুরির চেয়ে কম হবে না। মূল্যস্ফীতির হার লাগামছাড়া হয়ে গেলে সরকার আবার ন্যূনতম মজুরির হার বৃদ্ধি করে। গত কয়েক বছরে উন্নত দেশে তা হয়েছে।

মোদ্দা কথা হলো, যুক্তরাজ্যের মতো উন্নত দেশে যে জাতীয় ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করা আছে, আনুষ্ঠানিক খাতে তার চেয়ে কম মজুরি দেওয়ার সুযোগ নেই। অনানুষ্ঠানিক খাতে সেই সুযোগ নেওয়া হয়। যদিও বলা বাহুল্য, সে দেশে অনানুষ্ঠানিক খাতের পরিধি খুবই ছোট। মূলত অবৈধ অভিবাসীরা এসব খাতে কাজ করেন, নিয়োগকর্তারাও সেই সুযোগ নেন।

এ ছাড়া কখনো এমন হয় যে একজন বিদেশি ছাত্রের সপ্তাহে ২০ ঘণ্টা বৈধভাবে কাজ করার অনুমতি আছে, কিন্তু তিনি বাড়তি রোজগারের আশায় আরও বেশি কাজ করতে চান। তখন দোকান বা রেস্তোরাঁর মালিকেরা তাঁদের আনুষ্ঠানিক মজুরির অর্ধেক মজুরি দিয়ে অনেক সময় কাজ করান।

ফলে বেসরকারি খাতের মজুরি নির্ধারণে সরকারের ভূমিকা থাকতে পারে না, কথাটা ঠিক নয়।

বাংলাদেশের মতো দেশে বেসরকারি খাতে যে অন্যায্যতার পরিবেশ তৈরি হয়েছে, তার মূল কারণ সম্ভবত সরকারের নজরদারি না থাকা। সর্বশেষ পে স্কেল বাস্তবায়নের পর সরকারি চাকরির সঙ্গে বেসরকারি চাকরির বেতনের ব্যবধান বেড়েছে। এখন বেশির ভাগ বেসরকারি কোম্পানির বেতন সরকারি খাতের চেয়ে কম, কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া, যেমন বেসরকারি ব্যাংক, বহুজাতিক কোম্পানি ইত্যাদি। সেই সঙ্গে বেসরকারি খাতে আছে আকাশ-পাতাল ব্যবধান, প্রধান নির্বাহীর সঙ্গে তাঁর পিয়নের বেতনের কত ফারাক থাকবে, তার সূত্র নেই। এমনকি এক বেসরকারি কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালককে বলতে শুনেছি, জিনিসপত্রের দাম এত বেড়েছে যে তাঁর গাড়ির ড্রাইভার পরিবারকে গ্রামে পাঠিয়ে দিয়েছেন।  

বাংলাদেশ এখন মধ্যম আয়ের দেশ হলেও বেসরকারি খাতের জন্য পেনশন-গ্র্যাচুইটির মতো অন্য আনুষঙ্গিক সেবা নিশ্চিত করতে পারেনি। এ নিয়ে বিশেষ মাথাব্যথাও দেখা যাচ্ছে না কারও। ফলে ৬০ বছর বয়স পর্যন্ত চাকরি করার পরও অনেক মানুষ শেষ জীবনে অরক্ষিত হয়ে পড়েন। তখন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি চাকরিজীবীদের দেখে তাঁদের আবারও মনে হতে পারে, ‘ইশ্‌, কেন যে সরকারি চাকরি করলাম না।’

বিষয়টি কার্যত উল্টো হয়ে গেছে, কারণ ১৯৯০-এর দশকে দেশের বাজার যখন উন্মুক্ত হলো, তখন বেসরকারি ও বহুজাতিক কোম্পানির চাকরি চৌকস তরুণদের কাছে স্বপ্নের মতো হয়ে উঠেছিল। তখন অনেক চৌকস তরুণ সরকারি চাকরিতে যেতে চাইতেন না। কারণ, সেখানে বেতন কম ছিল; বরং উচ্চ বেতনের স্মার্ট করপোরেট চাকরি ছিল তাঁদের আরাধ্য। কিন্তু তিন দশকের মধ্যে পরিস্থিতি এতটা বদলে গেল যে বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণেরা জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জনের চেষ্টা না করে বিসিএসের জন্য উন্মত্ত হয়ে উঠেছেন। সবাই তো আর বিসিএস ক্যাডার হতে পারেন না। যাঁরা চার-পাঁচ বছর চেষ্টা করার পর বিসিএস পাস করতে পারেন না, তাঁরা হতাশায় নিমজ্জিত হন, দক্ষতাও অর্জন করতে পারেন না। অথচ বেসরকারি খাতের নিয়োগকর্তারা হরহামেশাই অভিযোগ করেন, দক্ষ লোক পাওয়া যাচ্ছে না।

বেসরকারি খাতকে দেওয়া বিভিন্ন প্রণোদনার ক্ষেত্রে বিভিন্ন শর্ত আরোপ করা যেতে পারে, যেমন ন্যূনতম মজুরি বাধ্যতামূলক করা (ন্যূনতম মজুরির আওতার বাইরে থাকা খাতগুলোর ক্ষেত্রে), ন্যূনতম মজুরির আওতার খাতগুলোর মজুরি স্বল্প পরিমাণে হলেও সমন্বয় করা, রেশনের ব্যবস্থা করা ইত্যাদি।
সায়েমা হক, অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

জিডিপির অনুপাতে বেসরকারি বিনিয়োগ অনেক দিন ধরে স্থবির—২০২২-২৩ অর্থবছরের সাময়িক হিসাবে তা আগের অর্থবছরের তুলনায় বরং কমেছে। অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকেরা এর জন্য ব্যবসার পরিবেশকে দায়ী করেন; সেই পরিবেশ উন্নত না হওয়ার পেছনে আমলাতন্ত্রের দৌরাত্ম্যকেও অনেকে দায়ী করেন।

ফলে যা ঘটছে, তা হলো, দেশের বেসরকারি খাত এখন যোগ্য প্রার্থী পাচ্ছে না, কবে না তাদের আবার ‘যোগ্য প্রার্থী আন্দোলনে’ নামতে হয়। অথচ বেসরকারি খাতই অর্থনীতির প্রাণ, জিডিপির সিংহভাগই আসে এই খাত থেকে; সরকারি খাত থাকে মূলত প্রশাসনিক ব্যবস্থা ও পরিকল্পনায়।

বাস্তবতার আলোকে বেসরকারি খাতের কর্মজীবীদের জন্য সরকার কী করতে পারে—এমন প্রশ্নের জবাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সায়েমা হক বলেন, ‘সরকারি কর্মচারীদের বেতন মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সমন্বয় করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। বেসরকারি খাতে নিয়োজিতদের জন্য স্বাভাবিকভাবেই এই সমন্বয় প্রযোজ্য না হলেও মূল্যস্ফীতির ক্ষেত্রে কিছু স্বস্তি দিতে এই খাতের জন্য সরকার কিছু নির্দেশ দিতে পারে। বেসরকারি খাতকে দেওয়া বিভিন্ন প্রণোদনার ক্ষেত্রে বিভিন্ন শর্ত আরোপ করা যেতে পারে, যেমন ন্যূনতম মজুরি বাধ্যতামূলক করা (ন্যূনতম মজুরির আওতার বাইরে থাকা খাতগুলোর ক্ষেত্রে), ন্যূনতম মজুরির আওতার খাতগুলোর মজুরি স্বল্প পরিমাণে হলেও সমন্বয় করা, রেশনের ব্যবস্থা করা ইত্যাদি।’

সায়েমা হক আরও বলেন, সার্বিকভাবে সরকারি–বেসরকারি এমনকি অনানুষ্ঠানিক খাতসহ অর্থনীতির সব ক্ষেত্র ও খাতকে ধীরে ধীরে ন্যূনতম মজুরি ও এর পাশাপাশি নির্দিষ্ট সময় পরপর মজুরির সমন্বয় করার কাঠামোর ভেতর নিয়ে আসতে হবে। তবে মনে রাখতে হবে, বেসরকারি ও অনানুষ্ঠানিক খাতকে সুনির্দিষ্ট কাঠামোর মধ্যে আনতে হলে শ্রমবাজারে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে হবে ও ব্যাপক হারে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে, যাতে বাজারব্যবস্থার স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় মজুরির ক্ষেত্রে ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা তৈরি হয়।

সরকারি কর্মকর্তারা অবসরের পর পেনশনও পান। বেসরকারি খাতের জন্য সর্বজনীন পেনশনব্যবস্থা এখনো দেশে নেই, যদিও সম্প্রতি এ বিষয়ে খানিকটা অগ্রগতি হয়েছে। আনুষ্ঠানিক খাতে থাকা সব বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে এই পেনশন স্কিমে আসা বাধ্যতামূলক করা উচিত। বেসরকারি খাতেরও এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। কারণ, শুধু সরকারের চাপে এসব সমস্যার পূর্ণাঙ্গ সমাধান সম্ভব নয়। এ পরিস্থিতির দ্রুত অবসান হওয়া উচিত।