পূর্ণাঙ্গ ডিজিটাল অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে চাই

তানভীর আহমেদ, প্রতিষ্ঠাতা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক, নগদ
ছবি– নগদের সৌজন্যে

২০২৭ সালের মধ্যে দেশের সামগ্রিক লেনদেনের তিন-চতুর্থাংশ ক্যাশলেস, মানে নগদবিহীন করার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সন্দেহ নেই, এটি খুবই সময়োপযোগী এক পরিকল্পনা। বলার অপেক্ষা রাখে না যে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে নগদই হবে সবচেয়ে বড় এক অংশীদার।

ব্যক্তিগতভাবে আমি ক্যাশলেস সমাজ গঠনের একজন নিবেদিত কর্মী। নিজেকে সর্বাত্মকভাবে নিয়োজিত করেছি দেশে ছাপা টাকাবিহীন লেনদেনব্যবস্থা জোরদার করার কাজে। নিজের এ রকম অবস্থান থেকেই জোর গলায় বলছি, আগামী চার বছরের মধ্যে আমরা দেশের ৭৫ শতাংশ লেনদেন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে তুলে আনব।

চার বছর ধরেই তো এই একটা লক্ষ্য নিয়েই কাজ করছি আমরা। আগে অবশ্য সামনে সুনির্দিষ্ট কোনো সংখ্যা বা অঙ্ক ছিল না। এবার আমরা এতটাই সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছি যে সেই পথে এগিয়ে যাওয়া এখন আমাদের জন্য অনেক সহজ হয়ে গেছে।

আমরা লক্ষ্য অর্জনে ইতিমধ্যে কাজ শুরু করেছি। দেশের মানুষকে সামগ্রিক কেনাকাটা ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে করার ব্যাপারে তাঁদের উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করছি। এ বিষয়ে এখন আমাদের একটা ক্যাম্পেইন চলছে, যা ব্যাপক সাড়া ফেলেছে।

আপনাদের অনেকেরই হয়তো চোখে পড়ে থাকবে যে নগদের মাধ্যমে কেনাকাটা করার বিপরীতে পুরস্কার হিসেবে কোটি টাকা দামের বিএমডব্লিউ–সেডান গাড়িসহ শত শত মোটরসাইকেল, রেফ্রিজারেটর, স্মার্ট টেলিভিশন, ট্যাব, স্মার্টফোন, স্মার্ট ঘড়ি জেতার সুযোগ এনে দিয়েছি আমরা। সব মিলিয়ে কয়েক হাজার পুরস্কার দিচ্ছি আমরা। ইতিমধ্যে আড়াই হাজারের মতো পুরস্কার বিতরণ হয়ে গেছে। আর এসবই করা হচ্ছে মূলত ডিজিটাল পেমেন্টকে উৎসাহিত করতে।

এ ক্যাম্পেইনে আমাদের কয়েক কোটি টাকা খরচ হচ্ছে। তবে আমার বিশ্বাস, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে লাখ লাখ মানুষ যে কোনাকাটা করবেন, সেটি আমাদের বড় অর্জন হবে, যা এই খরচের চেয়েও বেশি মূল্যবান। কারণ, এর মাধ্যমে বড় একটা ডেটা বা তথ্যসম্ভার তৈরি হবে, যা সামগ্রিকভাবে অর্থনীতিকে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে তুলে আনতে বড় ভূমিকা পালন করবে।

এই তথ্যভান্ডারের ওপর ভিত্তি করে ভবিষ্যতের লেনদেনগুলো আবর্তিত হবে। ক্ষুদ্রঋণ ও সঞ্চয় যেটা প্রচলিত ব্যাংকিং সেবায় সম্ভব নয়, সেটি আমাদের চালু করতে সহযোগিতা করবে এই তথ্যসম্ভার। তা ছাড়া গ্রাহকের ক্রেডিট রেটিং বা ঋণমান তৈরি হওয়া এবং সেই ঋণমানের ভিত্তিতে ‘বাই নাউ পে লেটার’ (এখন কিনুন, পরে টাকা দিন)–এর মতো সুবিধা তখন সবার জন্য উন্মুক্ত হয়ে যাবে। ফলে ক্রেডিট কার্ড–সেবার বাইরে যাঁরা রয়েছেন, তাঁরাও তখন আগে পণ্যসেবা কিনে পরে কিংবা মাসে মাসে টাকা পরিশোধের সুবিধা পাবেন। আমি তো স্বপ্ন দেখি, এই সুবিধা নিয়ে কৃষক এখন সার কিনে ফসল ফলানোর পর তার দাম পরিশোধ করতে পারবেন। কিংবা একজন ছাত্র এখন ল্যাপটপ কিনে আউটসোর্সিংয়ের আয় থেকে কিস্তিতে তার মূল্য পরিশোধ করতে পারবেন। আর এসবই বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বাড়তি গতি সঞ্চার করবে। নিশ্চিত হবে স্বচ্ছতা, আর টাকা ছাপানো ও সেটির ব্যবস্থাপনার যে খরচ, তা সাশ্রয় হয়ে আমাদের জাতীয় অর্থনীতিতে যুক্ত হবে।

২০১৯ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক গবেষণায় উঠে এসেছিল, দেশের মোট ছাপা টাকা ব্যবস্থাপনার জন্য বছরে ৯ হাজার কোটি টাকা খরচ হয়। আমি তো বলি এই টাকার পুরোটাই সঞ্চয় করা সম্ভব, যদি আমরা ছাপা টাকার বদলে ইলেকট্রনিক টাকাকে জনপ্রিয় করতে পারি।

এখানে ডিজিটাল ব্যাংকের ভূমিকা রাখতে পারে। আমাদের আশপাশের সব দেশেই এখন ডিজিটাল ব্যাংক চালু আছে। এখানে আমরা সামান্য পিছিয়ে পড়েছি। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক যেহেতু তিন–চতুর্থাংশ লেনদেন ছাপা টাকাবিহীন করার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে, সেহেতু এর ধারাবাহিকতায় ডিজিটাল ব্যাংকও চলে আসবে। ইতিমধ্যে নিয়ন্ত্রক সংস্থা ডিজিটাল ব্যাংক নিয়ে কাজ শুরু করেছে। আমরাও রয়েছি এই উদ্যোগের সঙ্গে। নীতিমালা চূড়ান্ত হয়ে গেলে নগদ সবার আগে ডিজিটাল ব্যাংক নিয়ে হাজির হবে, যা স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

লেখক: মোবাইলে আর্থিক সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান নগদ-এর প্রতিষ্ঠাতা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক।