মেট্রোরেলের মতো অবকাঠামো নির্মাণে জোর দিচ্ছে জাইকা

জাপান আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার (জাইকা) সিনিয়র এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট মিয়াজাকি কাতসুরা বাংলাদেশের উন্নয়ন সম্ভাবনা, কৌশলগত গুরুত্ব ও জাইকার সহযোগিতার বিভিন্ন আওতা নিয়ে কথা বলেছেন প্রথম আলোর সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক মোস্তফা ইউসুফ

প্রথম আলো:

জাইকা বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ উন্নয়ন অংশীদার। জাইকা ও বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের এ সম্পর্ক কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?

মিয়াজাকি কাতসুরা: আমরা বাংলাদেশের সঙ্গে সহযোগিতা শুরু করেছি স্বাধীনতার ঠিক দুই বছর পর অর্থাৎ ১৯৭৩ সাল থেকে। তখন থেকে জাইকা স্বাস্থ্য, জ্বালানি, কৃষি, পরিবহন, শিক্ষা, পরিবেশসহ আরও বিভিন্ন খাতে আমরা সহযোগিতা সম্প্রসারণ করেছি। গত পাঁচ দশকে বাংলাদেশের অভাবনীয় ও উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন হয়েছে। বাংলাদেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পেরে আমরা গর্বিত।

যেসব দেশকে জাইকা বৈশ্বিকভাবে সহযোগিতা করে, তাদের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে উত্তরণ ঘটাচ্ছে, তাই আমরাও আমাদের সহযোগিতার ধরন পাল্টাচ্ছি। আমরা এখন বাংলাদেশের টেকসই ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছি। গত বছরের আগস্টে সরকার পরিবর্তনের পর আমরা বিনিয়োগ পরিবেশের উন্নয়নের দিকে মনোযোগ দিচ্ছি। এ মুহূর্তে টেকসই উন্নয়নের জন্য বিনিয়োগ সহায়ক পরিবেশের উন্নয়ন করা প্রয়োজন।

প্রথম আলো:

বাংলাদেশ কেন জাইকার জন্য গুরুত্বপূর্ণ?

মিয়াজাকি কাতসুরা: নানা কারণে বাংলাদেশ জাইকার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের বিশাল জনসংখ্যা ও তরুণ জনগোষ্ঠী আছে। জনসংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশ অষ্টম বৃহৎ দেশ। উৎপাদন ও ভোক্তার বাজার হিসেবে এর আকার বিরাট। এ ছাড়া বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক অবস্থান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশ ভালো নেতৃত্ব পেয়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ ও জাপান সরকারের দ্বিপক্ষীয় কৌশলগত অংশীদারত্বকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার বিষয়ে একমত হয়েছে। বাংলাদেশ ও জাপানের জনসাধারণ ও কোম্পানিগুলোর মধ্যে যোগাযোগ বেড়েছে। যেমন বাংলাদেশে কর্মরত জাপানি কোম্পানির সংখ্যা বেড়েছে। অন্যদিকে গত ১০ বছরে জাপানে বাংলাদেশিদের সংখ্যা বেড়েছে চার গুণ।

প্রথম আলো:

ইতিবাচক পরিবর্তন আনা জাইকার প্রকল্প কী ভূমিকা রাখছে?

মিয়াজাকি কাতসুরা: আমরা উচ্চ গুণগত মানসম্পন্ন অবকাঠামো প্রকল্পে গুরুত্ব দিচ্ছি। প্রাথমিক নির্মাণ ব্যয় যদি কম হয় এবং এর মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ খরচ বেশি হয়। তাহলে এ ধরনের প্রকল্প প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। উচ্চ গুণগত মানসম্পন্ন অবকাঠামো হলো, যার প্রাথমিক নির্মাণ ব্যয় বেশি, কিন্তু রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামত ব্যয় কম। এটার উদাহরণ হলো, যেমন ঢাকা মেট্রোরেল। এটি উচ্চ গুণগত মানসম্পন্ন প্রকল্পের একটি উদাহরণ। এ ছাড়া আছে ঢাকা বিমানবন্দরের থার্ড টার্মিনাল ও মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর।

জাইকা যেকোনো প্রকল্প নেওয়ার আগে আন্তর্জাতিক পরামর্শক নিয়োগ দিয়ে সেটার সম্ভাব্যতা যাচাই করে। জাইকার জন্য সুষম পরিকল্পনা আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। প্রকল্পের জন্য আমাদের সামাজিক ও পরিবেশগত একটা নীতিমালা আছে। প্রতিটি প্রকল্পকে সে নীতিমালার আলোকে কাজ করতে হয়, যাতে পরিবেশ ও স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জীবন–জীবিকার ওপর কোনো ধরনের নেতিবাচক প্রভাব না পড়ে।

প্রকল্পের পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণ যাতে টেকসই হয়, সেটি নিশ্চিত করে জাইকা। যেমন ঢাকা মেট্রোরেল। এর পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণে জাইকার অর্থায়নে প্রশিক্ষণ প্রদান ও প্রাযুক্তিক সহযোগিতা অব্যাহত রেখেছে।

***সিঙ্গারসহ আটটি কোম্পানি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছে
প্রথম আলো:

অবকাঠামো ছাড়া আর কোন কোন খাতে জাইকা সহযোগিতা করছে?

মিয়াজাকি কাতসুরা: অবকাঠামো ছাড়া জাইকা বাংলাদেশের শিক্ষা, তথ্যপ্রযুক্তি ও স্বাস্থ্য খাতে সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে। স্বাস্থ্য খাতে জাইকা বর্তমানে নার্সিং এডুকেশন, অসংক্রামক রোগ মোকাবিলা ও হাসপাতাল নির্মাণে সহযোগিতা দিচ্ছে। শিক্ষা খাতে জাইকা প্রাথমিক শিক্ষাকে গুরুত্ব দিচ্ছে। ২০ বছর ধরে প্রাথমিকের পাঠ্যক্রমে (কারিকুলাম) গণিত ও বিজ্ঞান শিক্ষার উন্নয়নে সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে।

জাইকা বর্তমানে দেশের ৪৯৫টি উপজেলা ও ১২টি সিটি করপোরেশনের স্থানীয় সরকার কর্মকর্তাদের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহযোগিতা করছে।

এ ছাড়া জাইকা ৫৬০ সরকারি কর্মকর্তাকে জাপানে উচ্চশিক্ষার জন্য বৃত্তি প্রদান করে। এই সক্ষমতা উন্নয়ন কৃষি, নদী ব্যবস্থাপনা, খাদ্যনিরাপত্তা, প্রযুক্তি ও কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মতো খাতে বাস্তবায়িত হচ্ছে। অবকাঠামোর বাইরেও জাইকা এসব খাতে তাদের সহযোগিতা সম্প্রসারণ করছে।

তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বাংলাদেশের বিপুল সম্ভাবনা আছে। এ খাতে বাংলাদেশের অনেক মেধাবী ব্যক্তি আছেন এবং তাঁরা খুবই দারুণ করছেন। আমরা তথ্যপ্রযুক্তি খাতের মহাপরিকল্পনা ও রোডম্যাপ করতে বাংলাদেশ সরকারকে সহযোগিতা করছি। এ খাতে প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ জনবল তৈরি করে তাঁদের জাপানে কর্মসংস্থান করা হচ্ছে। এমন ২৫০ জন তথ্যপ্রযুক্তি প্রকৌশলীকে প্রশিক্ষণ দিয়ে জাপানে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

***জাপানের জনপ্রিয় কোম্পানি লায়ন দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে প্রথম বিনিয়োগের জন্য বাংলাদেশকে বেছে নিয়েছে
প্রথম আলো:

জাপানের নতুন নতুন বিনিয়োগ কী আসছে?

মিয়াজাকি কাতসুরা: বাংলাদেশকে তৈরি পোশাকশিল্পের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। এটা অনস্বীকার্য যে এ শিল্প বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের চালিকা শক্তি। টেকসই অর্থনীতির জন্য অন্যান্য শিল্পের বিকাশ ঘটাতে হবে। বাংলাদেশ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল শিল্পের বৈচিত্র্য ঘটাতে অনুঘটকের কাজ করবে। সিঙ্গারসহ আটটি কোম্পানি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সিঙ্গার এরই মধ্যে ফ্রিজ বানানো শুরু করেছে। আর সামনে শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্রও বানাবে।

জাপানের জনপ্রিয় কোম্পানি লায়ন দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে প্রথম বিনিয়োগের জন্য বাংলাদেশকে বেছে নিয়েছে। তারা বাংলাদেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় অত্যাবশ্যকীয় পণ্য উৎপাদনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। লায়ন হচ্ছে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে কারখানা নির্মাণ করা দ্বিতীয় কোম্পানি। চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, বাংলাদেশে অর্থনৈতিক অঞ্চলের ভূমি উন্নয়ন ব্যয় অনেক বেশি। বন্যা থেকে সুরক্ষার জন্য জাইকা ওডিএ ঋণের মাধ্যমে বাংলাদেশের বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের জমি চার মিটার উঁচু করা হয়েছে।

কার্বন নিরপেক্ষ ও নবায়নযোগ্য জ্বালানিকে উৎসাহিত করতে জাইকার সহযোগিতায় বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মহাপরিকল্পনা হয়েছে। আমাদের অর্থায়নের ৯৫ শতাংশ যায় সরকারের কাছে। মাত্র ৫ শতাংশ যায় প্রাইভেট কোম্পানিতে। বিশ্বব্যাংকের আইএফসির মতো পিএসআইএফ (প্রাইভেট সেক্টর ইনভেস্টমেন্ট ফাইন্যান্স) গঠন করেছে জাইকা। যেমন আমরা সবুজ অর্থায়নকে উৎসাহিত করতে ব্র্যাক ব্যাংককে ৯ কোটি ডলার দিয়েছি। পরিবেশবান্ধব ইস্পাত তৈরিতে বিএসআরএমকে পাঁচ কোটি ডলার দেওয়া হয়েছে।

টেকসই উন্নয়নের জন্য বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি গবেষণা অংশীদারত্ব নিয়ে জাপান ও বাংলাদেশের মধ্যে একটা কাঠামো চুক্তি আছে। বাংলাদেশি ও জাপানি গবেষকদের মধ্যে সহযোগিতা বাড়াতে এর আওতায় আমরা ছয়টি প্রকল্প শুরু করেছি।