সাক্ষাৎকার

নতুন ড্যাপে ভারসাম্য আনা দরকার 

দেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় শিল্পগোষ্ঠী আনোয়ার গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান আনোয়ার ল্যান্ডমার্ক দীর্ঘদিন ধরে আবাসন খাতে সুনামের সঙ্গে ব্যবসা করছে। পুরান ঢাকা থেকে শুরু করে অভিজাত এলাকায় আবাসিক ও বাণিজ্যিক প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে প্রতিষ্ঠানটি। আবাসন খাতের সাম্প্রতিক চ্যালেঞ্জ নিয়ে কথা বলেছেন আনোয়ার গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হোসেন খালেদ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শুভংকর কর্মকার। 

হোসেন খালেদ, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, আনোয়ার গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ

প্রশ্ন :

নতুন ড্যাপ কার্যকর হলে আবাসন খাত সংকটে পড়বে—এমন শঙ্কার কথা বলছেন আবাসন ব্যবসায়ীরা। আর নগর–পরিকল্পনাবিদেরা বলছেন, নতুন ড্যাপ বাস্তবায়নে ঢাকা বাসযোগ্য হবে। আপনার মতামত কী? 

হোসেন খালেদ: নতুন ড্যাপের প্রসঙ্গে আসার আগে আমি কয়েকটি কথা বলি। আবাসন ও নির্মাণ খাত কয়েক বছর ধরেই বাংলাদেশের জিডিপিতে ১৭ শতাংশ অবদান রাখছে। এই খাতের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক অনেক খাত ও উপখাত ওতপ্রোতভাবে জড়িত। দক্ষ, আধা দক্ষ ও অদক্ষ অনেক শ্রমিকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা আবাসন ও নির্মাণ খাতে হয়েছে। এখান থেকে দক্ষতা অর্জন করে অনেকে দক্ষ শ্রমিক হিসেবে বিদেশে যাচ্ছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগের ‘মাস্টারপ্ল্যান’ থেকে আমার অনেক দূরে সরে এসেছি। সেটা যদি আমরা অনুসরণ করতাম, তাহলে আজকে ঢাকা ইটপাথরের জঙ্গল হতো না। মাস্টারপ্ল্যানে প্রতিটি আবাসিক এলাকায় পার্ক, পুকুর ও খোলা জায়গার পরিকল্পনা ছিল, যা আমরাই নষ্ট করেছি। যখন একটা এলাকায় অতিরিক্ত মানুষ বসবাস শুরু করে, তখন সেটা আর টেকসই হয় না। সে জন্যই পুরান ঢাকা এখন বেহাল। ধানমন্ডির মতো ঢাকার মধ্যাঞ্চলেও একই সংকট দেখা দিয়েছে। অথচ ধানমন্ডিসহ কিছু এলাকার পরিকল্পনা সুন্দরভাবে করা হয়েছিল। যদিও সেখানে বাণিজ্যিক, স্কুল-কলেজ ও হাসপাতালের জন্য আলাদা জোন রাখা হয়নি। তাতে যেটি হয়েছে, আজকে ধানমন্ডি থেকে ভালো স্কুলের জন্য উত্তরা কিংবা আশুলিয়া যেতে হচ্ছে। 

রাজধানীর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) নতুন ড্যাপ করেছে। ঢাকা শহরের ওপর মানুষের চাপ কমানো ও উন্নত নাগরিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিতসহ যেসব উদ্দেশ্য নিয়ে এই ড্যাপ করা হয়েছে। তার সঙ্গে আমি দ্বিমত করছি না। আমরাও আগামী প্রজন্মের জন্য একটা বাসযোগ্য ঢাকা রেখে যেতে চাই। তবে এই ড্যাপ বাস্তবায়িত হলে বড়লোক আরও বড় হবে। আর মধ্যবিত্ত শ্রেণি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। 

প্রশ্ন :

বিষয়টি একটু ব্যাখ্যা করে বলবেন...

হোসেন খালেদ: নতুন ড্যাপে বারিধারা এলাকায় আরও বেশি তলার ভবন নির্মাণের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। গুলশান-বনানীর মতো এলাকায় ভবনের উচ্চতা সামান্য কমানো হয়েছে। অন্যদিকে শহরের মধ্যাঞ্চল অর্থাৎ ধানমন্ডি থেকে মগবাজার-কাকরাইলে আগে যেখানে নিচতলার ওপরে নয়তলা করা যেত, এখন করা যাবে মাত্র ছয়তলা। ফলে আগে যেখানে ১৮টি অ্যাপার্টমেন্ট হতো, সেখানে এখন হবে ১২টি। তার মানে জমির মালিক ও আবাসন কোম্পানির হিস্যা কমবে। খরচও কয়েক গুণ বাড়বে। বাংলাদেশের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে। কিন্তু অ্যাপার্টমেন্ট কেনার মতো ক্রয়ক্ষমতা কয়জনের আছে? আবার নতুন ড্যাপ অনুযায়ী, গুলশানে বাণিজ্যিক ভবন ২০ তলার পরিবর্তে ১৩ তলা করতে হবে। ঢাকার এই অভিজাত এলাকার জমির খুবই ব্যয়বহুল। যখন ভবনের উচ্চতা কমে যাবে, তখন ব্যয় অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাবে। আমি ভবন বানিয়ে যাব, কিন্তু বিক্রি করতে পারব না—তাহলে তো কোনো লাভ হবে না। কাউকে না কাউকে তো কিনতে হবে। সাম্প্রতিক সময়ে নির্মাণসামগ্রীর দাম ৩৫-৪০ শতাংশ বেড়ে গেছে। এখনো সেই খরচই আমরা ক্রেতাদের ওপর দিতে পারিনি। আমি আবারও বলছি, নতুন ড্যাপের কারণে শহরের মধ্যাঞ্চল বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। গত চার মাসে সেখানকার কোনো জমিতে নতুন প্রকল্প নেওয়া যায়নি। জমির মালিক ও আবাসন প্রতিষ্ঠান—উভয় পক্ষই বিভ্রান্তির মধ্যে রয়েছে। সে কারণে ব্যবসা স্থবির হয়ে আছে। 

প্রশ্ন :

কী করলে এ অচলাবস্থা কাটবে? 

হোসেন খালেদ: নতুন ড্যাপ কার্যকর হলে মধ্যবিত্ত মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ধনীরা আরও ধনী হবে। সে কারণে একটা ভারসাম্য আনা দরকার। ড্যাপের মূল উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য বাস্তবভিত্তিক পরিকল্পনা জরুরি। নতুন ড্যাপে ২ একরের বেশি জমিতে কনডোমিনিয়াম প্রকল্প করতে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। তবে ঢাকার ভেতরে এত বড় জমি কোথায় পাব আমরা। দুঃখজনক বিষয়, আমরা ব্যবসায়ীরা এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত ছিলাম না। রাজউক ও মন্ত্রণালয়ের যেসব কর্মকর্তা প্রক্রিয়াটির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তাঁদের উচিত ছিল ব্যবসায়ীসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে আরও বেশি সংলাপ করা। এখনো সেটি করার সুযোগ রয়েছে। সংলাপ করে ড্যাপ সংশোধন করার উদ্যোগ নেওয়া দরকার। আরেকটি কথা বলতে চাই, শুধু ড্যাপ বাস্তবায়ন করলে রাজধানীমুখী মানুষের স্রোত বন্ধ করা যাবে না। তাতে কেবল ভোগান্তিই বাড়বে। ড্যাপের পাশাপাশি অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে হবে। সরকার বিভিন্ন জেলায় অর্থনৈতিক অঞ্চল করছে। সেখানে দেশি-বিদেশি উদ্যোক্তারা শিল্পকারখানা গড়ে তুলছেন। তার পাশাপাশি সেখানে আবাসন, স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল ও বিনোদনের ব্যবস্থা করা না গেলে কাজ কিন্তু কিছুই হবে না। সবাই সেখানে গিয়ে কাজ করবে, কিন্তু পরিবার রাখবে ঢাকায়। তাই সমন্বিত পরিকল্পনা দরকার এখনই। 

প্রশ্ন :

সরকারের প্লট প্রকল্পে সমাজের প্রভাবশালীরাই জমি বরাদ্দ পেয়েছেন। আবার সরকারি আবাসন প্রকল্পের অ্যাপার্টমেন্টের দাম সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষের আবাসনের বিষয়ের সরকার কিছু করতে পারছে না কেন? 

হোসেন খালেদ: হয়তো সরকার নিজেদের ভিশন বা রূপকল্পের মধ্যে এটিকে অন্তর্ভুক্ত করতে পারেনি। তবে কাজটি খুব কঠিন কিছু না। সরকার নিম্নমধ্যবিত্তের জন্য পিপিপি মডেলে আবাসন প্রকল্প করতে পারে। সরকার জমি দেবে আর বেসরকারি আবাসন প্রতিষ্ঠান নিজেদের খরচে ভবন নির্মাণ করবে। শেষ পর্যন্ত যাতে দাম নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়, সে জন্য স্বচ্ছ নীতিমালা থাকবে। তা ছাড়া বিশ্বের অনেক দেশেই ৩০ বছরের জন্য গৃহঋণ পাওয়া যায়। এসব ঋণের সুদহার ৪ শতাংশ। এভাবে স্বল্প সুদে দীর্ঘ মেয়াদে গৃহঋণ দেওয়ার জন্য সরকার একটি পুনঃ অর্থায়ন তহবিল গঠন করে আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে তা বিতরণের দায়িত্ব দিতে পারে। 

প্রশ্ন :

বর্তমান চ্যালেঞ্জের মধ্যে আবাসন ব্যবসায় আপনাদের পরিকল্পনা কী? 

হোসেন খালেদ: করোনার ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হয়েছে। সব মিলিয়ে তাই নানামুখী চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে। খুব তাড়াতাড়ি এসব চ্যালেঞ্জ থেকে বের হতে পারব বলে মনে হয় না। ফলে ২০২৪ সাল পর্যন্ত মুনাফা নয়, টিকে থাকাই হবে মূল লক্ষ্য। ব্যবসা সম্প্রসারণ করতে হবে বুঝেশুনে। আমরা আনোয়ার ল্যান্ডমার্ক শুরু থেকেই নিম্ন, মধ্যম ও বেশি আর্থিক মূল্য—এমন আবাসন প্রকল্প নিয়ে থাকি। বর্তমানে ধানমন্ডিতে আমাদের তিনটি বাণিজ্যিক প্রকল্প আছে। তা ছাড়া ধানমন্ডি, গুলশান, বারিধারা, বসুন্ধরা, বনানী ও উত্তরায় আমাদের অ্যাপার্টমেন্ট প্রকল্প রয়েছে। আমরা মূল ঢাকার পাশে অথচ যোগাযোগব্যবস্থা খুব ভালো, তেমন এলাকায় বড় জমি নিয়ে কনডোমিনিয়াম প্রকল্প হাতে নিয়েছি।