ঋণমানের নেতিবাচক আভাস কী বার্তা দিচ্ছে বাংলাদেশকে

অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকাররা বলছেন, এর ফলে বৈদেশিক বাণিজ্য ও লেনদেনে খরচ বেড়ে যেতে পারে।  

ঋণমান যাচাইয়ের জন্য আন্তর্জাতিকভাবে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য যে তিনটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে, তার দুটি থেকে দুই মাসের মধ্যেই দুটি খারাপ সংবাদ পেল বাংলাদেশ। একটি প্রতিষ্ঠান সরাসরিই বাংলাদেশের ঋণমান কমিয়ে দিয়েছে। আরেকটি ঋণমানের পূর্বাভাস নেতিবাচকে নামিয়ে বার্তা দিয়েছে, বহিঃস্থ পরিস্থিতির উন্নতি না ঘটলে বাংলাদেশের ঋণমান কমানো হতে পারে।

সর্বশেষ খারাপ খবরটি এসেছে এসঅ্যান্ডপি (স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড পুওর) গ্লোবালের পক্ষ থেকে। তারা জানিয়েছে, বাংলাদেশবিষয়ক ঋণমান আভাস বা রেটিং আউটলুক কমিয়ে ‘নেতিবাচক’ করা হয়েছে। আগে এই আউটলুক ছিল ‘স্থিতিশীল’। এর আগে মে মাসের শেষে মুডিস ইনভেস্টরস সার্ভিস বাংলাদেশের ঋণমান এক ধাপ কমিয়ে বিএ৩ থেকে বি১-এ নামানোর ঘোষণা দেয়।

‘আসলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা যে খারাপ থেকে খারাপতর হচ্ছে, মুডিসের পর এসঅ্যান্ডপির সর্বশেষ পদক্ষেপ সেটিই প্রমাণ করছে’, বলেছেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের লেনদেন সক্ষমতার ব্যাপারে বিশ্ববাজারে উদ্বেগ বাড়ছে।’

অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুরের কথার প্রতিধ্বনি শোনা গেল বাণিজ্যিক ব্যাংকের নিবার্হীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান আনিস এ খানের কণ্ঠেও। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘আমাদের অর্থনীতিতে যে নিম্নগতি চলছে, ঋণমান কমানো তারই প্রতিফলন।’

বিশ্লেষকেরা একমত যে ঋণমান কমে যাওয়ায় এখন বাংলাদেশের জন্য আন্তর্জাতিক বিভিন্ন উৎস থেকে ঋণ করার খরচ বেড়ে যাবে।

বিশ্বে তৃতীয় বড় যে ঋণমান যাচাইকারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে, সেটি ফিচ রেটিংস। বাংলাদেশের ব্যাপারে এখন পর্যন্ত শুধু তাদের কাছ থেকে কোনো বার্তা পাওয়া যায়নি।

কী বলেছে এসঅ্যান্ডপি

এসঅ্যান্ডপি গ্লোবাল বাংলাদেশের ব্যাপারে তাদের ঋণমান এখনো কমায়নি। সার্বভৌম ঋণমান দীর্ঘ মেয়াদে ‘বিবি মাইনাস’ ও স্বল্প মেয়াদে ‘বি’ নিশ্চিত করেছে তারা। কিন্তু তারা বাংলাদেশের ব্যাপারে ঋণমানের আউটলুক কমিয়েছে। অর্থাৎ বাংলাদেশের ‘বৈদেশিক লেনদেনের ক্ষেত্রে দুর্বলতা বেড়েই চলেছে’, এমন বার্তা দিয়ে সংস্থাটি বলেছে, তারা সামনে বিপদের আশঙ্কা করছে।

এ ক্ষেত্রে দুটি কারণ দেখিয়েছে এসঅ্যান্ডপি—প্রথমত, বিদেশি মুদ্রায় স্বল্প মেয়াদে বাংলাদেশ সরকারের যে অর্থ পরিশোধের বাধ্যবাধকতা আছে, তার অবস্থা আগামী বছর আরও খারাপ হতে পারে; দ্বিতীয়ত, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ চাপের মুখে আছে।

ডলার–সংকটের কারণে আন্তর্জাতিক লেনদেনে হিমশিম খাওয়ার বিষয়টির বাইরেও বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিও ভাবাচ্ছে এসঅ্যান্ডপিকে। তারা বলেছে, দেশটির রাজনীতিতে মেরুকরণ রয়েছে, আর বেশির ভাগ ক্ষমতা আওয়ামী লীগের হাতে। সংসদে বিরোধী দলের প্রতিনিধিত্ব খুবই কম, ফলে সরকারের ওপর নজরদারি সীমিত। ২০২৪ সালে নির্বাচন হবে; কিন্তু বিএনপি অংশ নেবে কি না, তা পরিষ্কার নয়।

মুডিসের যুক্তি কী ছিল

মুডিস ইনভেস্টরস সার্ভিস গত মে মাসে সরাসরিই বাংলাদেশের ঋণমান কমিয়ে দিয়েছে। এই পদক্ষেপ নেওয়ার পক্ষে যুক্তি হিসেবে সংস্থাটি বলেছিল, বৈদেশিক লেনদেনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে এখন উঁচু মাত্রার দুর্বলতা ও তারল্যের ঝুঁকি রয়েছে। একই সঙ্গে চলমান অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা প্রকাশ পেয়েছে।

গত ৩০ মে প্রতিষ্ঠানটি জানায়, পরিস্থিতি খানিকটা সহজ হলেও বাংলাদেশে ডলার-সংকট চলমান এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বা মজুত কমে যাচ্ছে, যা দেশের বৈদেশিক লেনদেন পরিস্থিতির ওপর চাপ অব্যাহত রেখেছে। সেই সঙ্গে আমদানির ক্ষেত্রে নানা ধরনের বাধা তৈরি হয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা কী মনে করেন

গবেষণা প্রতিষ্ঠান পিআরআইয়ের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর মনে করেন, বাংলাদেশের বৈদেশিক লেনদেন পরিস্থিতি ‘খারাপ থেকে খারাপতর’ হচ্ছে, ঋণমান বিষয়ে এসঅ্যান্ডপির সিদ্ধান্ত থেকে তা বোঝা যায়। তিনি প্রশ্ন রাখেন, ‘কিন্তু প্রকৃত চিত্র আমরা বুঝতে পারছি না। আমাদের সর্বমোট দায় কত? একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে আমাদের কত অর্থ পরিশোধ করতে হবে?’

আহসান এইচ মনসুর বলেন, বৈদেশিক লেনদেনের ক্ষেত্রে যে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে, তা কমিয়ে আনতে সরকারের পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। আমাদের মূল সমস্যা পর্যাপ্ত ডলার নেই, তাই অর্থ পরিশোধের ক্ষেত্রে আমরা বাছাইয়ের দিকে যাচ্ছি। সরকারের উচিত পাওনাদারদের সঙ্গে বসা; আর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বসা উচিত ব্যাংকগুলোর সঙ্গে।

এ ছাড়া আরও তিনটি পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ দেন এই অর্থনীতিবিদ। এগুলো হলো রপ্তানি ও প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স বাড়িয়ে বৈদেশিক মুদ্রার আয় বাড়ানোর ব্যবস্থা নেওয়া, চলতি হিসাবের ঘাটতি কমিয়ে আনা ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ানোর ব্যবস্থা করা।

অন্যদিকে এবিবির সাবেক চেয়ারম্যান আনিস এ খান বলছেন, ডলার–সংকটের কারণে আমদানিতে আগের চেয়ে বেশি অর্থ খরচ করতে হচ্ছে। অন্যদিকে জ্বালানির জন্য বিল পরিশোধ করা হচ্ছে ডলারে। ফলে আমাদের বহিঃস্থ খাতে চাপ রয়েছে। এখন অর্থনীতির ওপর আরও বেশি চাপ অনুভূত হবে।

আনিস এ খান বলেন, ঋণমান কমানো বা আউটলুক নেতিবাচক হওয়ার ফলে ঋণের ক্ষেত্রে ‘রিস্ক প্রিমিয়াম’ বা ঝুঁকিজনিত খরচ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। কারণ, যেসব উৎস থেকে বাংলাদেশ ঋণ নেয়, তারা আগের তুলনায় কিছুটা বেশি সুদ চাইতে পারে। এ ছাড়া ব্যবসা করার খরচও বেড়ে যাবে। যখন কোনো ঋণপত্র খোলা হয়, তখন বিদেশি ব্যাংকের মাধ্যমে তা নিশ্চিত করতে হয়। এর জন্য একটি চার্জ বা মাশুল রয়েছে। ঋণমান কমে যাওয়ায় বিদেশি ব্যাংকগুলো এখন বাড়তি মাশুল আদায় করতে পারে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক কী বলছে

এসঅ্যান্ডপির সিদ্ধান্তের পর বাংলাদেশ ব্যাংক এখনো এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি। তবে মুডিস বাংলাদেশের ঋণমান কমিয়ে দেওয়ার পর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার ‘আমাদের কিছু যায় আসে না’ বলে ওই পদক্ষেপকে নাকচ করেছিলেন।

গত মাসের মাঝামাঝি মুদ্রানীতি ঘোষণার সময় গভর্নর সাংবাদিকদের বলেন, ‘যেটা করা হয়েছে, সেটাকে পিওর ইকোনমিক রিপোর্টিং বলা যাবে না। এটা ভূরাজনৈতিক কারণে হয়েছে। আমাদের ঋণমান  কমানোর মতো কিছু হয়নি।’

ভূরাজনৈতিক কারণের বিষয়ে ব্যাখ্যা দেওয়ার জন্য বলা হলেও গভর্নর ‘এ ব্যাপারে আর বিস্তারিত না বলাই ভালো’ বলে মন্তব্য করেন।