অর্থনীতির জন্য এখন তিন মাসের একটি কর্মসূচি দরকার

অর্থনীতির বর্তমান সংকটময় পরিস্থিতি ও উত্তরণের উপায় নিয়ে প্রথম আলো আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা বলেছেন, বড় ধরনের সংস্কার ছাড়া বর্তমান অর্থনীতির সংকট মোকাবিলা করা কঠিন হবে। নির্বাচনের আগে সরকারের পক্ষে বড় ধরনের সংস্কার সম্ভব নয়। তবে নির্বাচনের পর সংস্কারের কৌশল কী হবে, তা এখনই ঠিক করতে হবে। গতকাল মঙ্গলবার প্রথম আলো কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এ বৈঠকে ছিলেন চার অর্থনীতিবিদ, একজন সাবেক ব্যাংকার ও একজন ব্যবসায়ী।

দেশে আগামী তিন মাসে নতুন বিনিয়োগ হবে বলে মনে হয় না। ব্যাংক খাতের সংস্কারও এর মধ্যে সম্ভব হবে না। তাই তিন মাসের জন্য একটা স্বল্প মেয়াদি  এজেন্ডা বা কর্মসূচি ঠিক করা উচিত। এর মূল লক্ষ্য হবে, মূল্যস্ফীতি কমানো ও রিজার্ভ বাড়ানো।

আমাদের দেশের নীতি নির্ধারকদের একটা সাধারণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, তাঁরা ঘটনা ঘটার পর পদক্ষেপ নেন, আগে নেন না। সংকট ঘনীভূত হওয়ার পর পদক্ষেপ নেওয়ার কারণে পরে জনসাধারণকে অনেক মূল্য দিতে হয়। ইংরেজিতে একটা প্রবাদ আছে, ‘রোগ নিরাময়ের চেয়ে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাই উত্তম’- এতে যেন তাঁদের কোনো আস্থা নেই।

ভুল পথে থেকেও ‘সঠিক পথেই আছি’ বলে বলা হয় এখানে। ফলে ক্ষতি যা হওয়ার তা হয়েই যায় এবং ভবিষ্যতে আরও বেশি ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এর খেসারত চূড়ান্ত অর্থে দিতে হয় সাধারণ মানুষকে।
মুস্তফা কে মুজেরী, সাবেক মহাপরিচালক, বিআইডিএস; সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ, বাংলাদেশ ব্যাংক

সামস্টিক অর্থনীতির চলকগুলো একটা আরেকটা ওপর নির্ভরশীল। একটা খারাপ হলে অন্যগুলোর ওপরও তার প্রভাব পড়ে। তবে আপাতত তিনটা সমস্যা মোকাবিলা করা এখন জরুরি। এগুলো হচ্ছে– মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, বিনিময় হার ঠিক করা ও রিজার্ভ পরিস্থিতির উন্নয়ন।

মূল্যস্ফীতির কথাই যদি ধরি, সরকারের দিক থেকে এর দায় অন্যদের ওপর চালানোর প্রবণতা দেখা গেছে। মূল্যস্ফীতি বেশি হওয়ার জন্য প্রথমে বলা হয়েছে কোভিড-১৯ দায়ী। পরে দায় চাপানো হয়েছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ওপর। বলা হয়েছে, এ সমস্যা বাইরে থেকে আসা এবং আমদানি ব্যয় ও পরিবহন খরচ বেড়ে গেছে ইত্যাদি ইত্যাদি। এ সব বলতে বলতে মূল্যস্ফীতি এখন এত বেড়ে গেছে যে বিশ্ব পরিস্থিতি ভালো হলেও আমাদের যেন ভালো হওয়ার কোনো লক্ষণ নেই। অথচ ভারত, শ্রীলঙ্কা এমনকি পাকিস্তানও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে নিয়ে এসেছে।

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে একটাই অস্ত্র আছে। সেটা হচ্ছে ব্যাংকের সুদের হার বাড়ানো। বাংলাদেশ ব্যাংক যদি প্রথম দিকে সুদের হার বৃদ্ধির পদক্ষেপ নিত তা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ভালো ভূমিকা রাখতে পারত।

নিজেদের দুর্বলতা এড়িয়ে বা অস্বীকার করে এমনও দেখা গেছে, ভুল পথে থেকেও ‘সঠিক পথেই আছি’ বলে বলা হয় এখানে। ফলে ক্ষতি যা হওয়ার তা হয়েই যায় এবং ভবিষ্যতে আরও বেশি ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এর খেসারত চূড়ান্ত অর্থে দিতে হয় সাধারণ মানুষকে।

ব্যাংক খাতের দুর্বলতার মূল কারণ আমাদের জানা। সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকগুলোর এমন পরিস্থিতির কথা নানা জায়গা থেকে বারবার বলা সত্ত্বেও ব্যাংক খাতের দুর্বলতাকে অস্বীকার করা হয়েছে। ফলে দুর্বলতা দূর করার পদক্ষেপই নেওয়া হয়নি।

সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক যে এ খাতের দুর্বলতার ছয়টি কারণ চিহ্নিত করেছে, তার একটা হচ্ছে করপোরেট সুশাসনের অভাব। আগে তো সরকারি ব্যাংকগুলোর স্বাস্থ্য খারাপ ছিল, এখন বেসরকারি ব্যাংকগুলোর স্বাস্থ্যও ক্রমান্বয়ে খারাপ হতে শুরু করেছে। এ সংকুচিত ব্যাংক ব্যবস্থা নিয়ে কতটা সামনে এগোনো যাবে, তা চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

রিজার্ভ যখন বেশি ছিল তখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক দিনের পর দিন রিজার্ভ অর্থাৎ মার্কিন ডলার বিক্রি করেছে। এ ছাড়া টেকসই নয়, এমন মুদ্রা বিনিময় হার ব্যবস্থা ধরে রাখার চেষ্টা করেছে। আর তা করতে করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক একপর্যায়ে মুদ্রা বিনিময় হারকে টেকসই করার সক্ষমতাই হারিয়ে ফেলেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে শুরু করে প্রায় সব আর্থিক প্রতিষ্ঠানই দুর্বল করে ফেলা হয়েছে। তাদের কর্ম সক্ষমতা এখন নিম্নমুখী। সংকট কাটাতে যথাযথ পদক্ষেপ না নেওয়া হলে তা আরও বিস্তৃতি লাভ করার আশঙ্কা থাকে।

  • মুস্তফা কে মুজেরী
    সাবেক মহাপরিচালক, বিআইডিএস; সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ, বাংলাদেশ ব্যাংক